রানার ক্ষোভ, আগে সংবাদপত্রে একটা হেডলাইনার ছবি হত। প্রথম পাতার একটা আট বা ছয় কলমের ছবি। তখনকার দিনে ফোটোগ্রাফারদের মধ্যে একটা চ্যালেঞ্জ ছিল ফ্রন্ট পেজে নিজের ছবি পাঠানোর। এখন সেই ছবির গুরুত্ব না থাকায়, চিত্র সাংবাদিকদের ভালো ছবি তোলার ইচ্ছেটাই হারিয়ে গিয়েছে। এটাও জানালেন, আজকাল খবরের কাগজে সাংবাদিকদের বলা হয় লেখার সঙ্গে ছবিও তুলে আনতে। ‘কিন্তু সে তো শুধু তার লেখাটা দিয়ে কথা বলাতে পারবে, ছবিটা দিয়ে তো পারবে না। তাই বলছি এখন আর ছবির গুরুত্ব নেই।’
ধর্মতলার এক সরু নাম না জানা গলি। ক্যামেরার জন্য বিখ্যাত মেট্রো গলি আর জামা বানানোর আরও বিখ্যাত গজকুমারের মাঝের ছোট্ট এই গলিতে ঢুকে সোজা হেঁটে বাঁ-দিকের শেষ বাড়িটা। ভাঙাচোরা সিঁড়ি দিয়ে হোঁচট খেতে খেতে একতলায় উঠে বাঁ-দিকে তাকালেই দেওয়ালে ঠেকানো মোটা কাঠের একটা মই চোখে পড়ে। লম্বা সেই মই বেয়ে উঠে যেতে হয় মাচার মতো ছোট্ট একটা ঘরে। স্বল্প আলোকিত ঘরটির তিন দেওয়ালে তিনটে টেবিল, কিছু তাক। আর উপচে পড়া বিভিন্ন বহরের ক্যামেরা ও যন্ত্রপাতি। মেঝেতেও পা ফেলার জো নেই। আর এরই মাঝে একটি চেয়ারে বসে বছর আটষট্টির রানা পাত্র। ফোটোগ্রাফি জগতের ‘রানাদা’।
ঘরের অবস্থা দেখে আমার ভয় ভয় প্রশ্ন, ‘এত ক্যামেরা, এত পার্টস, সব এক জায়গায়। আপনার ভয় করে না কোন ক্যামেরার পার্টস কোনটাতে লাগিয়ে দেবেন ভুল করে?’ অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে রানা উত্তর দেন, “এটা তো আমার বরাবরের অভ্যেস, যার জন্য আমাকে শুনতে হত– ‘তোমার মাথায় কি কম্পিউটার আছে?’ যখন আমি ক্যামেরা ঠিক করি, আমার একটা স্ক্রুও ভুল হবে না। আমার এই মনে রাখার ক্ষমতাটা আছে।”
ক্যামেরা খারাপ হয়ে গেলে রানাদার মতো কেউ নেই এই শহরে। আর অ্যানালগ ক্যামেরা সারানোয় ওঁর মতো পারদর্শী মানুষ এই দেশে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। খোদ কলকাতা ছাড়াও বেঙ্গালুরু, ত্রিপুরা, মণিপুর– সব জায়গা থেকে রানার কাছে ক্যামেরা আসে সুস্থ হওয়ার জন্য।
আটের দশক থেকে ক্যামেরা সারানোর কাজ করছেন রানা।
‘আমি যে সময় সারানোর কাজে এসেছি, তখন ইলেকট্রনিক্স ক্যামেরা সবে বাজারে আসছে, আটের দশকের গোড়াতেই। এগুলো সব ইলেক্ট্রোম্যাগ্নেটিক্স শাটার ক্যামেরা। কিন্তু সেই সময় এই ক্যামেরাগুলো সারানোর কোন লোক ছিল না সারা ভারতে। আমার এক বন্ধু জানত যে আমি ইলেকট্রনিক্সে ভালো কাজ জানি। সেই আমাকে প্রথম যোগাযোগ করে। তখন আমি ছবিও তুলতাম, আর ও আমাকে বাড়িতে সারানোর কিছু কাজ দিয়ে যেত। তারপরে ১৯৮৬ সালে আমাকে একজন বলেন যে তুমি ধর্মতলায় এসো। এত ভালো কাজ জানো, বাড়িতে বসে থেকে কী করবে? উনি আমাকে প্রথম নিয়ে এসে ধর্মতলায় বসান।’
………………………………………………………
তবে ক্যামেরা সারানোর সঙ্গে রানার আরেকটি পরিচয় আছে। ‘আমি বেসিকলি ফোটোগ্রাফার। আমি ক্যামেরা সারানোর সময়েও ফোটোগ্রাফি করতাম। তার আগেও করতাম। আগে সিনে-ফোটোগ্রাফি করতাম। তারপর স্টিল। তারপর ক্যামেরা রিপেয়ারিং আর স্টিল-ফোটোগ্রাফি দুটো একসঙ্গেই চলত।’ মাঝে ন’বছর, ২০০৬ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ‘The Sunday Indian’-এ চিত্র সাংবাদিকের ভূমিকায় কাজও করেছেন রানা।
……………………………………………………….
বিগত ৩৮ বছর ধরে ধর্মতলাতেই আছেন রানা। নিজের দোকান খোলেন ১৯৮৯ সালে। তখন যদিও কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হত না। ২০১৫-তে পুরনো দোকানের ঠিকানা পাল্টে মাচার মতো এই ঘরটিতে চলে আসেন। ঘরের এক কোণে ইলেকট্রিক কেটলি, ইনডাকসান কুকার, জলের জাগ– সব মিলে এক ছোট্ট সংসার। বাড়ি সোনারপুরে। সারা বছর সোম থেকে শুক্র, এই ছোট্ট দোকানটিতে থাকেন। সপ্তাহান্তে বাড়ি যান।
তবে ক্যামেরা সারানোর সঙ্গে রানার আরেকটি পরিচয় আছে। ‘আমি বেসিকলি ফোটোগ্রাফার। আমি ক্যামেরা সারানোর সময়েও ফোটোগ্রাফি করতাম। তার আগেও করতাম। আগে সিনে-ফোটোগ্রাফি করতাম। তারপর স্টিল। তারপর ক্যামেরা রিপেয়ারিং আর স্টিল-ফোটোগ্রাফি দুটো একসঙ্গেই চলত।’ মাঝে ন’বছর, ২০০৬ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ‘The Sunday Indian’-এ চিত্র সাংবাদিকের ভূমিকায় কাজও করেছেন রানা।
ছবি তোলার উৎসাহ যদিও ছোটবেলা থেকেই। ‘ক্লাস এইট থেকে ছবি তুলছি। সেই সময় আমার পিসেমশায় আমাকে একটা আগফা আইসোলেট (Agfa Isolette), একটা জার্মান ক্যামেরা যাতে ১২০ ফিল্ম লাগে, সেটা দিয়েছিলেন। সেটা নিয়ে তখন শখের ফটোগ্রাফি করতাম। কখনও কোনও কাকার কাছে টাকাপয়সা জোগাড় করে ফিল্ম কিনতাম। সেই ফোটোগ্রাফিতে হাতেখড়ি।’
পরে অবশ্য রানা একজনের কাছে ছবি তোলা শিখেছেন এবং ১৯৭৭-এ সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ফিজিক্সে গ্রাজুয়েশন করে তাঁরই স্টুডিওতে কাজ করতে শুরু করেন। ‘কিন্তু আমার ফোটোগ্রাফি হাইয়ার এডুকেশন হয় কমল নায়াকের কাছে, একজন নাম করা সিনে-ফোটোগ্রাফার। পরবর্তীকালে ওঁর সঙ্গে আমি দীর্ঘদিন কাজ করেছি।’
ক্যামেরা সারানোর কাজ রানাকে আরও পোক্ত ফোটোগ্রাফার বানিয়ে তোলে। গর্বের সঙ্গে জানান যে, তিনি একমাত্র ফোটোগ্রাফার যিনি শাটারের আওয়াজ শুনে বলে দিতে পারেন কত শাটার চলছে, ফ্ল্যাশ সিঙ্ক করল কি না সেটা ক্যামেরা চললে বলে দিতে পারেন এবং কোন লেন্সে কতটা ভালো ছবি হবে, সেটা লেন্স দেখেই বুঝতে পারেন। এই জ্ঞান অনেক ফোটোগ্রাফারেরই নেই। তাঁরা ছবি তোলার পর বুঝতে পারেন, সেটি কেমন এসেছে।
ছবি তোলাটা যেহেতু ভীষণ ভালোবাসেন, তাই বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেন অন্যান্য চিত্রগ্রাহকদের সাহায্য করার। গল্প করতে করতে জানালেন যে, অনেক চিত্র সাংবাদিক তাঁর কাছে আসতেন বিপদে-আপদে। অ্যাসাইনমেন্টে যেতে হবে, কিন্তু ক্যামেরা খারাপ হয়ে গেছে। তাঁরা জানতেন রানার কাছে গেলে সমস্যার সমাধান হবে। নিজের ক্যামেরা দিয়ে দিতেন, যাতে তাঁদের কাজ না আটকে যায়। ‘এক সময় আমার কাছে প্রচুর ক্যামেরা থাকত। আমি নিজেও প্রচুর ক্যামেরা কিনেছি। কী করব, কেউ বিপদে আটকে গেলে না করতে পারতাম না। আর আমি নিজেও তো ফোটোগ্রাফি ভালোবাসি। কেউ অসুবিধায় পড়লে বলতাম, যাও, আমার ক্যামেরা নিয়ে যাও।’
আগে একবার যখন নিজের ক্যামেরা সারানোর কাজে রানার কাছে গেছিলাম, তখন দেখেছিলাম এক তরুণ অত্যুৎসাহে ওঁর কাছে এসেছেন। উৎসাহের কারণ একটা নতুন ধরনের ফিল্ম। দোকানের মালিকও সেই উৎসাহে তাল দিয়ে ফিল্মের গল্প জুড়ে দিলেন। দেখে মনে হল ফোটোগ্রাফার এবং রিপেয়ারম্যানের পাশাপাশি রানার আর একটি পরিচয় নিশ্চয়ই শিক্ষকের। সে-কথা জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘হ্যাঁ, অনেকেই ফোটোগ্রাফি শিখেছে আমার কাছ থেকে। পরবর্তীকালে তাঁরা নামও করেছে। এই ধরুন বিভাস ব্যানার্জি, সন্দীপন চ্যাটার্জি, বিভাস লোধ, আমার ছেলেও আছে, আশুতোষ পাত্র। ও তো প্রতিদিনেই কাজ করত।’
জানালেন, এখন নতুন করে আবার কিছু তরুণ ফোটোগ্রাফি শিখতে চাইছে তাঁর কাছে। ডিজিটাল নয়। অ্যানালগ। সোশাল মিডিয়াতে আজকাল মাঝে মাঝেই অ্যানালগ ফোটোগ্রাফি দেখা যায়। সেটার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে কি না জিজ্ঞেস করতেই রানা বলে ওঠেন, ‘না, না। আসলে অ্যানালগের কিছু সুবিধা আছে। যারা বুঝতে পারছে তারা বুঝে করছে। তবে কিছু মানুষ না বুঝেও করছে। এখন তো ইন্টারনেটের যুগ। সবাই সব কিছু ঘরে বসে জানতে পারে। এই যেমন ধরুন হলিউডে ৪০ শতাংশ ছবি অ্যানালগে হয়। এবার যেহেতু ওপেনহাইমার অ্যানালগে ১০ খানা প্রাইজ পেয়ে গেছে, যার ফলে সবাই এখন সেইরকম কাজ করতে চাইছে।’ কিন্তু রানার মতে না শিখে ফিল্মে ছবি তোলাটা কঠিন ব্যাপার। ‘দেখবেন নেগেটিভ সাদা হয়ে গেল বা কালো হয়ে গেল।’ তবে নতুন প্রজন্মের এই উৎসাহ রানাকে খুব একটা নাড়া দেয় না। প্রায় চার দশক ধরে বিভিন্ন চিত্রগ্রাহকদের সঙ্গে কাজ করার পর, আজকে দাঁড়িয়ে রানার মনে হচ্ছে যে, ফোটোগ্রাফারদের মধ্যে এখন ফোটোগ্রাফি করার ইচ্ছেটাই নষ্ট হয়ে গেছে। ‘আগে ছবিগুলোর একটা বক্তব্য ছিল। ছবির তো একটা গল্প চায়। ছবিতে যদি গল্প না থাকে, তাহলে সেই ছবিটা আর ছবি নয়। বিশেষ করে নিউজের ক্ষেত্রে।’
ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন যে, আগে সংবাদপত্রে একটা হেডলাইনার ছবি হত। প্রথম পাতার একটা আট বা ছয় কলমের ছবি হত। তখনকার দিনে ফোটোগ্রাফারদের মধ্যে একটা চ্যালেঞ্জ ছিল ফ্রন্ট পেজে নিজের ছবি পাঠানোর। এখন সেই ছবির গুরুত্ব না থাকায়, চিত্র সাংবাদিকদের ভালো ছবি তোলার ইচ্ছেটাই হারিয়ে গিয়েছে। এটাও জানালেন, আজকাল খবরের কাগজে সাংবাদিকদের বলা হয় লেখার সঙ্গে ছবিও তুলে আনতে। ‘কিন্তু সে তো শুধু তার লেখাটা দিয়ে কথা বলাতে পারবে, ছবিটা দিয়ে তো পারবে না। তাই বলছি এখন আর ছবির গুরুত্ব নেই।’
চিত্র সাংবাদিক ছাড়াও মধ্যবিত্তদের আর্থিক ক্ষমতা বাড়ার ফলে ফোটোগ্রাফারদের সংখ্যা বহুল পরিমাণে বেড়ে গেছে কিন্তু সেই অনুপাতে ছবি নেই, এমনটাই মনে হয় রানার। ‘ছবি তোলাটা সহজ হয়েছে তাই প্রচুর লোক ছবি তুলছে। আগে লোকে একটা ক্যামেরা কিনতে ভয় পেত। ভালো করে শিখে তবে কিনত। ক্যামেরা কেনাও সহজ ছিল না। এখন ক্যামেরা পাওয়া সহজ। তাই ফোটোগ্রাফার প্রচুর আছে, ফোটোগ্রাফি নেই। ছবির কোনও কম্পোজিশনও নেই।’
ক্যামেরা সারানোর ক্ষেত্রেও একই মুশকিল। অ্যানালগ ক্যামেরা সারানো কঠিন, ধৈর্যসাপেক্ষ, দীর্ঘদিন সময় দিতে হয়। তাই কেউ আর ঢুকতে চায় না এই কাজে। রানার কথায়, ‘ডিজিটাল ক্যামেরা রিপেয়ার করা খুব সহজ। তাই বেশিরভাগ ছেলেপুলে সেই কাজটাই করতে চায়। পয়সাও ডিজিটালে বেশি।’
………………………………………………………
আরও পড়ুন গৌরবকেতন লাহিড়ীর লেখা: শুধু যন্ত্রটাকে দেখব বলেই বাউল-ফকিরের পিছু নিতাম
………………………………………………………
‘মাথা ঘোমটা দেওয়া ক্যামেরা’ থেকে এআই, সব কিছুই দেখেছেন বিগত চার দশকে। সব মিলিয়ে রানার এখন ভয়, ‘ফোটোগ্রাফি প্রফেশনটাই না শেষ হয়ে যায়।’ ওঁর আক্ষেপ দেখে প্রশ্ন না-করে পারলাম না, আজকের প্রজন্মের ফোটোগ্রাফারদের যদি কোনও বার্তা আপনাকে দিতে হয়, তাহলে কী বলবেন তাঁদের?
‘সাহিত্য পড়ো। আজকাল ছবি তোলার জন্য বেশি কিছু করতে হয় না। শুধু কম্পোজিশনটা জানতে হয়। আমার গুরু বলতেন, আগে সাহিত্য পড়ো, তবেই ছবি বেরবে হাত থেকে। আমিও তাই বলব। সাহিত্য না পড়লে ছবির বোধটাই আসবে না। ক্যামেরাটা কিনলেই হবে না, ছবিটাকে ভালোবাসো।’
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………
পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণির মানুষ বলতেন, ওঁরা তো ভোটে না জিতে নেতা হয়েছেন। হ্যাঁ, সীতারাম ইয়েচুরি কখনও ভোটে জিতে মন্ত্রী বিধায়ক হননি। তারপরও দলমত নির্বিশেষে যে গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা তিনি দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অর্জন করেছিলেন, সেটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।