নাগপুরের এক সিনেমা হলে টিকিট কেটে দেখা যাবে ভোটের রেজাল্ট। সিনেমাহলে দিব্যি লোকে টিকিটও কেটেছেন সোৎসাহে! তবে? এই যে এত নির্বাচন-টির্বাচন– এইসব কি সিনেমারই উপাদান নাকি? জনতার কাছে সবথেকে বড় ফিলিম তো তবে এই? পাঁচ বছরে একটা করে সুপারহিট দিয়ে সেই কবে থেকে টিকে আছে আমাদের ভোটচ্ছবি। নিন, তবে পাশে দাঁড়ান।
‘সভ্যতা’ শব্দের অর্থ আবিষ্কারে সভায় এসে হাজির হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ‘সভার মধ্যে আপনাকে পাওয়া, সকলের মধ্যে নিজেকে উপলব্ধি করার’ মিলনতত্ত্ব স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ হয়ে উঠেছিল। ‘জনপ্রিয়তা’ শব্দটিকেও এইভাবে দেখা যেতে পারে। জনতা মিশে আছে এর ভিতর। অতএব যা কিছু জনতার প্রিয়, তার মধ্যে নিজেকে পাওয়া বা চিহ্নিত করা, জনতার প্রেক্ষিতে নিজেকে বা নিজের অবস্থানকে উপলব্ধি করা মন্দ কিছু নয়। তবু, বহু ক্ষেত্রে দেখা যায় জনপ্রিয়তার প্রতি অস্বাভাবিক এক সন্দেহবোধ থেকে যায়। যা কিছু জনপ্রিয়, তা সার্থক সৌন্দর্যরচনায় সক্ষম কি-না, এবং সেই সূত্রে তা সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করতে পারে কি-না, সে আলাদা বিষয়। তবে উন্নাসিকতায় জনপ্রিয়কে দূরে সরিয়ে রাখার অর্থ জনতাকেই অনেকাংশে অস্বীকার করা। স্বয়ং সত্যজিৎ রায় নাকি ‘বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না’-কে এই উন্নাসিকতায় দূরে ঠেলতে চাননি। বরং অনেকে যা দেখছেন, তার মধ্যে কী আছে, তা তলিয়ে দেখা উচিত বলেই মনে করেছিলেন। বহুদিন পর, খানিকটা সেরকমই একটা কথা বলতে গিয়ে অনুরাগীদের কোপের পড়লেন অনুরাগ কাশ্যপ। ‘অ্যানিম্যাল’-এর মতো ছবি, যার বিরুদ্ধে টক্সিক ম্যাসকুলিনিটিকে প্রমোট করার অভিযোগ প্রবল, সেই ছবি কী করে বহুজনের কাছে গ্রহণীয় হয়ে উঠছে, সেই বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে দেখা জরুরি বলে মনে করেছিলেন তিনি। অর্থাৎ, বহুজনতার ভিতরে অপূর্ব একা হয়ে থাকা ব্যক্তিগত চয়েস হতে পারে, কিন্তু যেখানে জনতা জড়িয়ে সেখানে ছাই উড়িয়ে দেখাই বাঞ্ছনীয়। কেননা জনতার মন আদতে দেশবাসীর মনের ভিতর প্রতিদিন পাল্টাতে থাকা দেশেরই ধারণা দেয়, আগেকার তত্ত্বে তাকে তেমন ধরা যায় না।
সিনেমা তাই নতুন পথ ধরে সেই দেশের জায়মান ধারণাটিকে আয়ত্ত করতে চায়। এই তো ক’-দিন আগে কান-এ ‘মন্থন’ দেখানোর পর, নাসিরুদ্দিন শাহ বললেন, আজকালকার ছবির বিষয় হয়ে ওঠা উচিত ধর্ম। সেরকম ছবিতেই তিনি কাজ করতে চান। আসলে ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা বা রাজনীতির মানে-বইয়ে ধর্মের যে অপব্যাখ্যা, তা জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে আমাদের মনের অনেকখানি দখল করে ফেলেছে। ধর্মের সূত্র ধরেই কোনও পরিচালক যদি সেই মনের দিকে ক্যামেরা বসান, তবে দেশের একটা স্পষ্ট ছবি উঠে আসে। সে চেষ্টা যে একেবারে হয়নি, তা নয়। ধরুন, একটি চোখা সংলাপ লেখা হল এইরকম: ওরা চায় মা বোনেদের গলার মঙ্গলসূত্র কেড়ে নিয়ে বহিরাগত, যারা বেশি বাচ্চা বিয়োয় তাদের হাতে তুলে দিতে। এই কাজ কে করতে পারেন? যিনি মি. ইন্ডিয়া নন। মি. ইন্ডিয়া তো বড়লোকের টেবিল থেকে খাবার তুলে নিয়ে গরিবের মুখে জোগায়। ভারতে সেটাই রীতি। তা যে ভাঙতে চায়, সে তাহলে ভারতের মজ্জাগত সংস্কৃতির বিরুদ্ধেই। তবে এটাও ভাবতে হবে যে, এই সংলাপ যার-তার মুখে মানায় না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
জাতপাতের কথাটাও আজকাল ক্লিশে। জাতের নামে বজ্জাতিটা নিউ নরম্যাল হয়ে গিয়েছে বহু বহুদিন আগে। অতএব চিত্রনাট্য ফিরে আসে সেই গোড়ার কথায়। জনতার কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধির গলায় তুলে দেওয়া একখানা প্রশ্ন: আপনি হিন্দু-মুসলমানে ভাগাভাগি করছেন? উত্তরদাতা বলেন, জীবনে তা করেননি। আর করবেনও না। করলে জনতার সামনে আর মুখ অব্দি দেখাবেন না। এরপর থেকে গোটাটা জুড়েই এই কথাটা বাজতে থাকে, নানা প্রসঙ্গে, নানা জায়গায়। তর্কে-বিতর্কে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সাতের দশকের অমিতাভ বচ্চনকে যদি লার্জার দ্যান লাইফ ধরা যায়, তাহলে এই সংলাপ বলা নায়ককে হতে হবে লার্জার দ্যান লার্জার দ্যান লাইফ। নইলে ১৩০-১৪০ কোটি মানুষের অন্তত অর্ধেককেও এক সংলাপে জাগিয়ে তোলা সম্ভব নয়। খেয়াল করে দেখুন, যেখানে এই সংলাপ রাখা হচ্ছে, তা কিন্তু রামগড়, ফুলেরার মতো কাল্পনিক ছোট জনপদ নয়। বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড; বহু বৈচিত্র সেখানে, বহু মানুষ; তাদের হাতে রচিত ইতিহাস নানা ভাবে বদলাতে বদলাতে সেই মানুষকেই একটা পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে এসেছে। আপাতত যে বিন্দুতে সকলে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে বড় এক বদলের দিকেই বেঁকে যেতে হবে। তা সমৃদ্ধি হতে পারে, হতে পারে আত্মধ্বংসী বিপর্যয়। এরকম এক প্রেক্ষাপট থেকেই শুরু হচ্ছে এই সংলাপের অবতারণা।
চিত্রনাট্যের ব্যাকরণ মেনেই আর একদল লোক বললেন, এ আবার কেমন কথা! এ তো বলা হচ্ছে এক জিনিস, আড়ে আরে তার অর্থ হচ্ছে আর-এক। নিয়ম অনুসারে, একে ‘আয়রনি’ বলে। অতএব তাঁরা মানুষকে এই আয়রনি সম্পর্কে সচেতন করতে লাগলেন। তাঁরা কারা? তাঁরা মূলত এই জনপদের এক একটি অটোর লাইন। অনেকে একসঙ্গে, অথচ প্রত্যেকে নিঃসঙ্গ। নিঃসঙ্গতার সেই বহুত্ব নিয়ে তাঁরা বহুকাল কাটিয়ে এসেছেন। তবে সেভাবে চলতে থাকলে চিত্রনাট্য তার প্রার্থিত দ্বন্দ্ব পায় না। তা না থাকলে, দ্রুত দৃশ্যবদলে অভিঘাত তৈরির উপায় না থাকলে, দর্শকের আবেগের তার ঝালায় পৌঁছয় না। থ্রিলার হোক বা পর্নোগ্রাফি, দর্শককে এই এক পদ্ধতিতে দৃশ্যের অন্তর্গত স্পেসের ভিতর ঢুকিয়ে নেওয়া যায়। সুতরাং, এখানেও চিত্রনাট্য অনেকগুলো অটোর লাইনকে একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে সেই দ্বন্দ্বের জায়গাটা জোরদার করল। এবার তাহলে একটা সামগ্রিক লড়াই পাওয়া যাবে। একটা বনাম খাড়া যাবে। মি. ইন্ডিয়া বনাম বাকি ইন্ডিয়া। কিন্তু এখানে মেইনস্ট্রিম সিনেমার ফরমুলা থেকে একটু প্রস্থান আছে। সেখানে হিরো আর ভিলেন নিয়ে দর্শকের মনে সংশয় থাকে না। এখানে থাকে। পরন্তু এখানে দুই পক্ষই নিজেদের নায়ক, অন্যকে ভিলেন সাব্যস্ত করতে উঠেপড়ে লাগে।
ফলত ব্যাপারটা আদতে জমেই যায়। অন্তত বেশ খানিকটা সময়পর্বের জন্য। টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি চলে আসে ‘অ্যানিমাল’-এর মতোই। কে কবে হাতে চুড়ি পরে বসে থাকবে আর থাকবে না– তা নিয়ে উত্তাল হয় সভ্যতা। এদিকে চোখা চোখা সংলাপে ধর্মের বাণে আকাশ প্রায় অন্ধকার। তবে একতরফা ধর্ম-যুদ্ধে চিত্রনাট্যের ভারসাম্য হারিয়ে যেতে পারে। ফলত পরিমাণমতো নিম্নবর্গের কথা আনা হয়। বেকারত্ব, দুর্দশা, জল, আলো, স্বাস্থ্য, শিক্ষার কথা অল্প অল্প ছড়িয়ে থাকে। ক্রিটিক্যালি অ্যাক্লেমড হওয়ার এগুলো আবশ্যিক শর্ত। তা ছাড়া, অনেক গবেষকই সিনেমায় নিম্নবর্গের অবস্থান নিয়ে কাজ করে থাকেন বা করতে পারেন। সুতরাং তাঁদের খাতিরেই অল্প হলেও এই প্রসঙ্গ থাকে। এর ভিতরই দু’-চারটে স্ক্যান্ডেল ফাঁস হয়। যৌন কেলেঙ্কারিও থাকে। একটু ঢি-ঢি পড়ে বইকি। তবে, সেভাবে আজকাল আর দুর্নীতি আলোড়ন তুলতে পারে না। সে এককালে ছিল, যখন ভাইয়ের ধনদৌলতের বিপরীতে মা-কে তুলে ধরা যেত। কিংবা হাতে যদি অন্য কেউ লিখে দেয় যে, তোর বাপ চোর, তাহলে অদম্য প্রতিশোধস্পৃহায় নিজেকেই হাউয়ের মতো জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেওয়া যেত। সে জমানা গিয়েছে। নীতি আর দুর্নীতি দুই নিয়েই যে মানুষের মাথাব্যথা নেই, তা চিত্রনাট্য বেশ জানে। অতএব সে প্রসঙ্গে বেশিক্ষণ থিতু হওয়া যায় না।
জাতপাতের কথাটাও আজকাল ক্লিশে। জাতের নামে বজ্জাতিটা নিউ নরম্যাল হয়ে গিয়েছে বহু বহুদিন আগে। অতএব চিত্রনাট্য ফিরে আসে সেই গোড়ার কথায়। জনতার কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধির গলায় তুলে দেওয়া একখানা প্রশ্ন: আপনি হিন্দু-মুসলমানে ভাগাভাগি করছেন? উত্তরদাতা বলেন, জীবনে তা করেননি। আর করবেনও না। করলে জনতার সামনে আর মুখ অব্দি দেখাবেন না। এরপর থেকে গোটাটা জুড়েই এই কথাটা বাজতে থাকে, নানা প্রসঙ্গে, নানা জায়গায়। তর্কে-বিতর্কে। অনুসন্ধিৎসু জনরা খুঁজে খুঁজে তুলে আনেন এর পাল্টা। অর্থাৎ যেখানে ওই চরিত্রটির মুখে বিভাজনের কথা শোনা গিয়েছিল। ফল হয় এই যে, চরিত্রটিকে তখন আর কিছু করতে হয় না। দেখা যায়, জনপদে যাঁরা তার উল্টোদিকে রয়েছেন, তাঁরাই যেন তাঁর হয়ে কাজটা অনেক সহজ করে দিচ্ছেন। উল্টে এমন কথা বলে ফেলছেন যাতে জনতাও বিভ্রান্ত, এদিকে দর্শকও। তার পরেও এক সময় মনে হয় যে, নিঃসঙ্গ ক্ষেত্রগুলো দানা বেঁধে হয়তো একটা বড় ধাক্কা দিতে পারে। মজা এখানেই যে, এই চিত্রনাট্য বিশ্বাস আর অবিশ্বাসের দোলাচলটিকে প্রতি মুহূর্তে জাগিয়ে রাখতে পারে। ফলত আর বলতে হয় না যে, এই সিনেমার পাশে এসে দাঁড়ান। মানুষ স্বভাবতই এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন সরোজ দরবার-এর লেখা: কিন্তু সেদিন সিংহটা রুখে দাঁড়ায়নি
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই গল্পটি নতুন নয়। তবে, বছর পাঁচেক ছাড়া ছাড়া দেখা যায় একই গল্প নিয়ে নানাজন কাজ করছেন। পরিবেশনার পার্থক্যেই তা প্রতিবার গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। এবং এ কথাও সত্যি যে, এই গল্প শেষ অব্দি যে বিন্দুতে পৌঁছয় তা অনেক ক্ষেত্রেই চমকপ্রদ হয়ে ওঠে। সুতরাং, আমাদের আলোচনা যে প্রসঙ্গে ছিল, সেই জনপ্রিয়তাকে একেবারে খাটো করে দেখা যায় না। জনতার মন যেখানে দারুণভাবে জড়িয়ে, সেই সূত্রে যা আমাদের উঠে আসে, তাকে আরও তলিয়ে বিশ্লেষণ করাই দরকারি। শুধু অশিক্ষিতের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিলে নিজের আয়না স্বচ্ছন্দে উলটে রাখা যায়, এই আর কী! সভার ভিতর আপনাকে পাওয়ার মতোই এই বিপুল জনতার মধ্যে প্রত্যেকের নিজের অবস্থান যদি খতিয়ে দেখা যায়, তাহলে রাহাজানি-দ্বিচারিতার ব্যক্তিগত এবং সামূহিক রূপটি আরও খোলতাই হয়। এই চিত্রনাট্য তাই বেজায় জনপ্রিয় হয়েও, প্রতিবার আমাদের আত্মানুসন্ধানের দিকেই ঠেলে দেয়। বলতে থাকে, সেখান থেকেই বিচ্যুতিই একই চিত্রনাট্যের জন্ম দেয় কয়েক বছর ছাড়া ছাড়া। সে চিত্রনাট্য বদলে দেওয়ার ক্ষমতা কিন্তু আছে জনতারই।
এখন, এই সিনেমা বা চিত্রনাট্যটিকে আপনারা যদি অন্য কোনও নামে ডাকতে চান, ডাকতেই পারেন। যদি অন্য কোনও কিছুর সঙ্গে এর সাদৃশ্য খুঁজে পান, তা একেবারেই কাকতাল নয়। তবে, সাদৃশ্য থাকলেই সব একই হবে তার কোনও মানে নেই। একটি পপুলার উদাহরণই দেওয়া যাক। রীনা রায় আর সোনাক্ষী সিন্হা নাকি অনেকটা একই রকম দেখতে। তা বলে দুজনেই তো আর এক মানুষ নন!
…………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………..
আমাকে মাঝে মাঝে বম্বে ডাইং-এর ফ্যাক্টরিতে পাঠাতেন মিসেস ওয়াড়িয়া। তোয়ালে, বিছানা চাদর, বালিশের ওয়াড় এমনকী, লুঙ্গিরও ডিজাইন। শিল্পের এই বিচিত্র ব্যবহার ভুলব না। লোকে বলে, ফ্যাশন ধনীদের জন্য। আসলে সমস্ত কিছুই শেষ পর্যন্ত চাপানো হয় দরিদ্র শ্রেণি আর সাধারণ নাগরিকের ঘাড়ে।