মায়ের হাতের ভেটকির কাঁটা চচ্চড়িই ছিল উত্তমকুমারের সবচেয়ে পছন্দের। বাজারে মাছের দর চড়া, তাই ভেটকি মাছের কয়েকটি কাঁটা নিয়ে ফিরেছিলেন উত্তমকুমারের বাবা সাতকড়িবাবু। ছেলেদের পাতে কী দেবেন ভাবতে থাকা মায়ের মনের গবেষণাগারে জন্ম নিল ভেটকির কাঁটা চচ্চড়ি। ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে থাকাকালীন শনি-রবিবার মহানায়ক ভবানীপুরে চলে আসতেন এই কাঁটা চচ্চড়ির টানে।
পোর্ট ট্রাস্টের এক সাধারণ কেরানি থেকে অরুণ চট্টোপাধ্যায় হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির ম্যাটিনি আইডল, অদ্যাবধি তিনিই বাংলা ছবির সেরা ‘পোস্টার বয়’। চলে যাওয়ার সাড়ে চার দশক পরেও তিনি অবিসংবাদী, মহানায়কের আসনটিতে আজও কাউকে বসাতে পারেনি বাঙালি। অভিনয়ের পারদর্শিতা, দৈহিক সৌন্দর্য্য-সৌষ্ঠব ছাড়াও আরেকটি জিনিস বাঙালির মনে তাঁকে পাকাপাকিভাবে গেঁথে দিয়েছে, তা হল আদ্যন্ত বাঙালিয়ানা। কেবল ধুতি-পাঞ্জাবি নয়, তিনি যেন আটপৌরে বেশে বাঙালিয়ানাকেই ধারণ করেছিলেন। সেই বাঙালিয়ানার অংশ ছিল খাওয়া-দাওয়াও। ‘আনন্দ আশ্রম’ ছবিতে, ডাক্তারি পড়ে গ্রামে ফিরে বাবার সঙ্গে বসে মাছের মাথা-সহ পঞ্চব্যঞ্জনে খাওয়া হোক বা ‘বাঘবন্দী খেলা’-র ভবেশ বাড়ুয্যের গুনে গুনে মাছ, মাংস খাওয়া, আবার ‘নায়ক’-এ সাহেবি কায়দায় ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে পাউরুটিতে মাখন লাগানো–প্রতিটি দৃশ্যই সাবলীল, জীবন থেকে তুলে আনা। উত্তমকুমার বাস্তব জীবনেও খাদ্যরসিক ছিলেন। ‘ভোজনবিলাসী’ বললেও ভুল বলা হয় না। মহানায়কের পছন্দের খাবারগুলি দেখলে বোঝা যায়, বাঙালি খাবারই ছিল তাঁর পছন্দের তালিকায় শীর্ষে। মাছের নানা পদ, ঘরোয়া খাবার, সেই সঙ্গে বাইরের ফ্রাই, ভাজাভুজি থেকে শুরু করে মিষ্টি– খেতেন সবই। সে’সময় নায়কদের তো আর সিক্স প্যাক রাখার দায় ছিল না।
মহানায়ক সাধারণ বাড়ির ছেলে, ফলত আর্থিক অভাব-অনটন নিয়েই তাঁর বেড়ে ওঠে। বাবা মেট্রো সিনেমার অপারেটর সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের অভাবের সংসারের নিত্যদিনের পদই হয়ে উঠেছিল মহানায়কের পছন্দের খাবার, ছোট্টবেলায় খাওয়া কলাই ডাল আর আলু পোস্তকে তিনি কোনও দিন ভোলেননি। পোস্তর প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল আজীবন। ছোটভাই তরুণকুমারকে বলতেন, ‘কলাই ডাল আর আলু পোস্ত, এই দুটো রান্নাকে কখনও অবহেলা করিস না। এরা আমাদের অভাবের দিনের সাথী। সুখের দিনে এদের ভুলে যাওয়া অন্যায়।’ মা চপলাদেবীর হাতের থোড়ের ছেঁচকি, বড়ি-নারকোল দিয়ে পালং শাকের ঘণ্ট, ডুমুরের তরকারি, ডিমের রসা আর রসকরা ছিল তাঁর প্রিয়। মায়ের হাতের ভেটকির কাঁটা চচ্চড়িই ছিল উত্তমকুমারের সবচেয়ে পছন্দের। এই পদটির জন্মও অভাবের তাড়নায়। বাজারে মাছের দর চড়া, তাই ভেটকি মাছের কয়েকটি কাঁটা নিয়ে ফিরেছিলেন সাতকড়িবাবু। ফিলে হিসেবে মাছ নিয়ে যাওয়ার পর যেটুকু কাঁটা পড়ে থাকে আর কী!
ছেলেদের পাতে কী দেবেন ভাবতে থাকা মায়ের মনের গবেষণাগারে জন্ম নিল ভেটকির কাঁটা চচ্চড়ি। ময়রা স্ট্রিটের বাড়িতে থাকাকালীন শনি-রবিবার মহানায়ক ভবানীপুরে চলে আসতেন এই কাঁটা চচ্চড়ির টানে। পাঁচ ফোড়ন আর আদা, রসুন বাটা দিয়ে নাড়াচাড়া করা মাছের কাঁটার স্বাদেই তৃপ্তি পেতেন। ঘরোয়া সাধারণ খাবারের প্রতি মহানায়কের এহেন প্রেমই আর পাঁচটা সাধারণ বাড়ির গপ্পের সঙ্গে তাঁকে মিলিয়ে দেয়।
………………………………………………………………………
মহানায়ক সাধারণ বাড়ির ছেলে, ফলত আর্থিক অভাব-অনটন নিয়েই তাঁর বেড়ে ওঠে। বাবা মেট্রো সিনেমার অপারেটর সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের অভাবের সংসারের নিত্যদিনের পদই হয়ে উঠেছিল মহানায়কের পছন্দের খাবার, ছোট্টবেলায় খাওয়া কলাই ডাল আর আলু পোস্তকে তিনি কোনও দিন ভোলেননি। পোস্তর প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল আজীবন। ছোটভাই তরুণকুমারকে বলতেন, ‘কলাই ডাল আর আলু পোস্ত, এই দুটো রান্নাকে কখনও অবহেলা করিস না। এরা আমাদের অভাবের দিনের সাথী। সুখের দিনে এদের ভুলে যাওয়া অন্যায়।’
………………………………………………………………………
অন্যান্য মাছের মধ্যে কাতলার ঝাল, চিংড়ির পাতুরি ছিল তাঁর প্রিয়। পাঁঠার মাংসর পাশাপাশি মুরগির নানাবিধ পদ ছিল তাঁর পছন্দের তালিকায়। অভিনেত্রী কাজুরী গুহর রেসিপি লঙ্কা মুরগি, সুপ্রিয়া দেবীর হাতে রাঁধা কাজু চিকেন খেতে খুব ভালবাসতেন। উত্তমকুমারের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ তিন নারীই ছিলেন রন্ধনপটিয়সী, মা চপলাদেবীর রান্না খেয়ে উত্তমের বড় হয়ে ওঠা। স্ত্রী গৌরীদেবীর রান্নার হাতও ছিল চমৎকার আর সুপ্রিয়া দেবীর রান্নার কথা তো সর্বজনবিদিত। একটা সময় মহানায়কের দুপুরের খাবার আসত তাঁর ময়রা স্ট্রিটের বাড়ি থেকে, নিজে হাতে রান্না করে খাবার পাঠাতেন সুপ্রিয়া দেবী। কোনও দিন ইলিশ, কখনও চিংড়ি, কখনও মুরগির পাতলা ঝোল। অন্য শিল্পীদের সঙ্গে ভাগ করে খেতেন মহানায়ক। যদিও প্রথমবার হার্ট অ্যাটাকের (১৯৬৭) পর খাওয়ার বিষয়ে খানিক সংযত হয়েছিলেন তিনি। রান্নায় তেল-মশলা কমে গিয়েছিল, কবজি ডুবিয়ে মাংস খাওয়া লোকটা বিনা মশলার মুরগির পদকে আপন করে নিয়েছিলেন। রসগোল্লা খেতেন ওপরে নুন ছিটিয়ে, সরাসরি চিনি এড়ানোর ফন্দি এভাবেই এঁটেছিলেন তিনি। তাঁর প্রিয় খাবার হয়ে উঠেছিল স্যুপ। স্টুডিয়োতে সুপ্রিয় দেবী প্রায়ই স্যুপ বানিয়ে আনতেন বা পাঠাতেন। একটা বড় গ্লাসে করে স্যুপ খেতেন মহানায়ক, সঙ্গে থাকত ব্রেড।
ঘরের খাবারের পাশাপাশি প্রিয় ছিল বাইরের বিভিন্ন খাবার, বিশেষ করে নানা ফ্রাই আইটেম। উত্তর কলকাতার অ্যালেন কিচেনের চিংড়ির কাটলেট, চাচার হোটেলের ফাউল কাটলেন, ধীরেন কেবিনের ফিশ কবিরাজি ছিল অন্যতম প্রিয়। আজও বইপাড়ার প্যারামাউন্টের দেওয়ালে বোর্ডে জ্বল জ্বল করছে মহানায়কের নাম। শরবতের স্বর্গরাজ্যে তিনিও যেতেন গলা ভেজাতে। এ প্রসঙ্গে বলি, মহানায়ক মদ্যপানও করতেন। মাঝে মাঝে ফ্লুরিজ-এও ঢুঁ মারতেন, ভীম নাগের মিষ্টির প্রতি ভালবাসা ছিল। সিউড়ির মোরব্বার প্রেমে পড়েছিলেন, পরিচিত কেউ বীরভূম গেলেই মোরব্বা আনার বরাত দিতেন মহানায়ক। সন্দেশখালিতে অমানুষ ছবির শুটিং করতে গিয়ে বসিরহাটের কাঁচাগোল্লার প্রেমে পড়েছিলেন মহানায়ক উত্তমকুমার, তারপর থেকে মহানায়কের প্রাতরাশের জন্য প্রায়ই বসিরহাট থেকে কাঁচাগোল্লা যেত।
মহানায়কের খাদ্যপ্রীতির কথা বলতে গেলে, আরেকটি দিকের কথা না বললেই নয়! জীবনে চলার পথে, অসাধ্য সাধন করতে খাবারকে নানাভাবে ব্যবহার করেছেন মহানায়ক। একবার ছেলেবেলায় ভাইদের নিয়ে ঠাকুরের চক্ষুদান দেখার খুব সখ হয়েছিল তাঁর, কিন্তু পটুয়ার ঠেকে ছিল দারোয়ানের বাধা। এক ঠোঙা গরম গরম তেলেভাজার গন্ধে হিন্দুস্থানী দারোয়ানজির মন গলিয়ে, ঢুকে পড়েছিলেন ঠাকুর গড়ার স্টুডিওতে। চক্ষুদান চাক্ষুষও করেছিলেন। আরেকবার ভাইদের নিয়ে মামাবাড়ি যাচ্ছেন, ট্রামে সুটকেস হাওয়া। ট্রাম চেকারের থেকে সুটকেস আদায় করলেন, সুটকেসের ভিতরে থাকা টিফিন বক্স ভর্তি মায়ের হাতে রাঁধা রসকরার প্রমাণ দিয়ে। রসকরা খেয়ে ট্রাম চেকার মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন। তৃতীয় ঘটনাটি অবশ্য বড়বেলার, উত্তম তখন স্টুডিও পাড়ায় নিত্য যাতায়াত করছেন। ব্যঙ্গবিদ্রুপ চলছে তাঁকে নিয়ে, কলির ভীম, নিউ দুর্গাদাস ইত্যাদি বিশেষণ ছুটে আসতে থাকল। বিদ্রুপকারীদের বাগে আনতে সিগারেট, বাটার-টোস্টের অস্ত্র প্রয়োগ করলেন উত্তম। খাবারে কাজ হল, উত্তমের পক্ষে চলে এসেছিলেন বিদ্রুপকারীরা।
………………………………………………………………….
আরও পড়ুন সম্বিত বসুর লেখা: তুমি কৃত্রিম হইলে আমি উত্তম হইব না কেন?
………………………………………………………………….
মহানায়ক যে কেবল নিজে খেতে ভালবাসতেন তাই নয়, খাওয়াতেও ভালবাসতেন। যা বাবা সাতকড়ি চট্টোপাধ্যায়ের থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছিলেন উত্তমকুমার। বাড়ির লক্ষ্মী পুজোয় ভিয়েন বসিয়ে পান্তুয়া, দরবেশ ও গজা তৈরি করাতেন। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে নিমন্ত্রিতদের খাওয়াতেন। তারপর নিজে খেতে বসতেন। লুচি, ছোলার ডাল, বেগুন বাসন্তী, আলুর দম, ধোকার ডালনা, ছানার ডালনা, মিষ্টি দিয়ে অতিথি আপ্যায়ন চলত। পুজোর পরদিন দরিদ্র নারায়ণ সেবা করতেন মহানায়ক। নিজেই সকলের পাতে খাবার পরিবেশন করতেন। উত্তমকুমার হয়ে ওঠার আগে, কিশোর বয়সেও তিনি নারায়ণ সেবা করিয়েছিলেন। তখন তেতাল্লিশের মন্বন্তরের সময়, চাঁদা তুলে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছিলেন উত্তম ও তাঁর বন্ধুরা। কলকাতার বিখ্যাত রাঁধুনি চিন্তামণি ঠাকুরকে দিয়ে খিচুড়ি, লাবড়া গোছের একটা তরকারি আর চাটনি রাঁধিয়ে বেশ কিছুদিন লোক খাইয়েছিলেন তাঁরা। সেসময় উত্তমদের আয়োজনে গিরিশ মুখার্জী রোডের উপর বসে পাঁচ-ছ’হাজার লোক খেত প্রতিদিন।
…………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………
মহানায়ক ইমেজের ঘেরাটোপে থেকেও যে, তিনি আম দর্শকের ঘরের লোক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন; তার জন্য অনেকখানি দায়ী ছিল ওঁর বাঙালিয়ানা সত্তা। যার ছাপ ওঁর অভিনীত সব চরিত্রেই কমবেশি রয়েছে। সেই পুরোদস্তুর বাঙালিয়ানা সত্তা অন্যতম এক উপাদান হয়ে উঠেছিল তাঁর রসনাবিলাস। যাকে উপজীব্য করে রিল ও রিয়েলের মেলবন্ধন ঘটেছিল।