ইসলামের প্রতি রামকৃষ্ণের আগ্রহ আশৈশব। হিন্দুধর্মের সব ধারার মতো বিশুদ্ধ ইসলামের উদার ভাবের প্রতিও তাঁর বরাবরের আকর্ষণ। তাঁর জন্মভূমি কামারপুকুরে মুসলমান পরিবারের সংখ্যা নগণ্য। কিন্তু মান্দারণ, আনুড়, অমরপুর ইত্যাদি পার্শ্ববর্তী গ্রামে অনেক ঘর মুসলমানের বাস। সেখানে ছিল গদাধরের নিয়মিত যাতায়াত।
দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণী মন্দিরের কাছেই গাজিপীরের স্থান। একদিন ভোরবেলা মসজিদের দরজা খুলে দেখা গেল, সামনে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছেন। পরনে একগজ কাপড়, কাছার বালাই নেই। মুসলমান ভক্তরা বললেন, কে তুমি? কোথায় থাকো?
একজন চিনতে পারলেন। বললেন, ইনি রাসমণির মন্দিরে থাকেন, পুজো করেন। নাম রামকৃষ্ণ।
রামকৃষ্ণ বললেন, তিনি ওঁদের সবার সঙ্গে নমাজ পড়তে চান।
চাইলেই তো হবে না। অন্য ধর্মের মানুষ মসজিদে নমাজ পড়বে কী করে? কিন্তু রামকৃষ্ণের মধ্যে এমন এক আন্তরিক আকূতি ছিল, তাঁরা সমাদর করে তাঁকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। সেদিন থেকে পরপর তিনদিন তিনি পাঁচ তক্ত নমাজ পড়েছিলেন।
সময়টা ১৮৬৬ সাল নাগাদ। রামকৃষ্ণ তখন বিশিষ্ট সুফি সাধক ওয়াজেদ আলি খান ওরফে গোবিন্দরায়ের কাছে্ কলমা নিয়েছেন।
গদাধরের প্রস্তুতি
ইসলামের প্রতি তাঁর আগ্রহ হঠাৎ নয়। আশৈশব। হিন্দুধর্মের সব ধারার মতো বিশুদ্ধ ইসলামের উদার ভাবের প্রতিও তাঁর বরাবরের আকর্ষণ। তাঁর জন্মভূমি কামারপুকুরে মুসলমান পরিবারের সংখ্যা নগণ্য। কিন্তু মান্দারণ, আনুড়, অমরপুর ইত্যাদি পার্শ্ববর্তী গ্রামে অনেক ঘর মুসলমানের বাস। সেখানে ছিল গদাধরের নিয়মিত যাতায়াত।
ইদ্-উদ্-জোহার দিন বন্ধু শেখ উমেদ আলির নিবাস গড় মান্দারণের ইদগাহে হাজির হয়েছিলেন একবার। তারপর থেকে মান্দারণে পিরোওর ইসমাইল গাজি লস্কর সাহেবের আস্তানায় আর ছোট দরগার ফকির সাহাবের কাছে, আনুড় নাহিরপাড়ায় মৌলবি কাজি আবদুলের কাছে তাঁকে প্রায়ই ধর্মকথা শুনতে দেখা যেত। শ্রীপুরে গোঁসাইরা ব্যঙ্গ করে বলত, গদাই নেড়েদের ঘরে যায়, ওর জাতপাত নেই। গদাইয়ের তাতে থোড়াই কেয়ার। তিনি টিকিধারী ওই সব বামুন আর ধর্মান্ধ মুসলমানদের বরাবর একই দলে ফেলেন। শ্লেষের সঙ্গে বলতেন, ওরা সব ছোট থাকের লোক!
তাহলে বৃহৎ থাক কারা? ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে গদাধরের চেনা সব প্রকৃত সাধুরাই। যেমন, গড়বেতার মুনশি এনাতুল্লা সাহেব– বড় সঙ্গীতজ্ঞ, সেতার বাজিয়ে গজল গাইতেন; তিনি গদাধরের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, তার সাগ্রহ কোরান শ্রবণ দেখে বলেছিলেন, এই ছেলেটি অসাধারণ মেধাবী। শুধু কান দিয়েই ও শোনে না, ও চোখ দিয়েও শোনে।
উমেদ আলিকে সঙ্গে নিয়েই গদাধর একবার গেলেন গোঘাট এলাকায় আমডোবা গ্রামের পাশে আশালহরী গ্রামে পীরের মেলা দেখতে। সেখানে দরবেশদের কথা আর গান শুনতে শুনতে উমেদ দেখে তার বন্ধুর দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে হু হু করে। পরে সে জিজ্ঞেস করে, হ্যাঁ গো ঠাকুর, সেদিন তুমি অমন করছিলে কেন? গদাই বলে, ফকিরদের গান শুনে মনে হল আমরা কত ছোট বুদ্ধি নিয়ে থাকি, কত ভেদাভেদ করি। আসলে তো সবই মাটি। শরীর ছেড়ে যখন প্রাণ চলে যাবে, তখন কারই বা পুকুর– কারই বা ডাঙা? (যুগপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ)
……………………………………………………………..
রামকৃষ্ণ পরে ঘনিষ্ঠ ভক্তদের কাছে স্মৃতিচারণ করেছিলেন, ‘‘ঐ সময় ‘আল্লা’ মন্ত্র জপ করিতাম, মুসলমান দিগের ন্যায় কাছা খুলিয়া কাপড় পরিতাম, ত্রিসন্ধ্যা নমাজ পড়িতাম এবং হিন্দুভাব মন হইতে এই কালে লুপ্ত হওয়ায় হিন্দু দেবদেবীকে প্রণাম দূরে থাকুক, দর্শন পর্যন্ত করিতে প্রবৃত্তি হইত না। এই ভাবে তিন দিবস অতিবাহিত হইবার পর ঐ মতের সাধনফল সম্যক্ হস্তগত হইয়াছিল।’
……………………………………………………………..
কলমা গ্রহণ
সুতরাং ইসলাম ধর্মের প্রতি রামকৃষ্ণের আকর্ষণ আবাল্য। কিন্তু এখন এই ১৮৬৬ সালে তাঁর সাগ্রহ ইসলাম সাধনার অন্য এক প্রত্যক্ষ কারণ রয়েছে। মা জগদম্বাকে সামনে রেখে দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ইত্যাদি নানা রূপের সাধনায় তিনি সিদ্ধিলাভ করেছেন, সিদ্ধিলাভ করেছেন তন্ত্র মতেও, তারপর তোতাপুরীকে গুরু মেনে ১৮৬৫ সালে বেদান্ত সাধনাতেও তিনি উত্তীর্ণ হন। এখন জন্মেছে তাঁর স্থির প্রত্যয়: ঈশ্বর যেমন সগুণে প্রকাশিত, তেমনই নির্গুণেও। এবার সত্যসন্ধানী রামকৃষ্ণ বুঝি চাইলেন ইসলামের নির্গুণ চর্চার সারাৎসার তিনি উপভোগ করবেন।
সুযোগ এসে গেল ওয়াজেদ আলি খান সেই সময় কয়েক দিনের জন্য দক্ষিণেশ্বরে আসায়। মথুরবাবুর বদান্যতায় তখন ভবতারিণী মন্দিরে সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের সংসারত্যাগীদের জন্য আতিথেয়তার দরাজ আয়োজন। সেই সূত্রেই ওয়াজেদ আলি দক্ষিণেশ্বরে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন জাতিতে ক্ষত্রিয়। পারসি ও আরবি ভাষায় তাঁর বিশেষ ব্যুৎপত্তি। সেই সূত্রেই তিনি ইসলাম ধর্মগ্রন্থ পাঠ করেন, সুফি মতের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন। রামকৃষ্ণ এঁকেই গুরু হিসেবে উপযুক্ত মনে করেন, ইসলাম ধর্মের মূলমন্ত্র বা কলমা গ্রহণ করেন। ইসলাম সাধনায় মুহূর্তে তিনি এত বুঁদ হয়ে যান যে, গো-মাংস খাওয়ারও ইচ্ছে প্রকাশ করেন।
এখানে একটি কথা স্পষ্ট বোঝা দরকার, রামকৃষ্ণ কিন্তু ধর্মান্তরিত হননি, হতে চানওনি। তিনি চেয়েছিলেন, স্বচ্ছ দীঘির যে ঘাট থেকে তিনি জল নিতে অভ্যস্ত, তার থেকে খানিক দূরে মুসলমানদের ঘাট থেকে পানি সংগ্রহ করে নিশ্চিত হতে যে উভয় অভিন্ন।
রামকৃষ্ণ পরে ঘনিষ্ঠ ভক্তদের কাছে স্মৃতিচারণ করেছিলেন, ‘‘ঐ সময় ‘আল্লা’ মন্ত্র জপ করিতাম, মুসলমান দিগের ন্যায় কাছা খুলিয়া কাপড় পরিতাম, ত্রিসন্ধ্যা নমাজ পড়িতাম এবং হিন্দুভাব মন হইতে এই কালে লুপ্ত হওয়ায় হিন্দু দেবদেবীকে প্রণাম দূরে থাকুক, দর্শন পর্যন্ত করিতে প্রবৃত্তি হইত না। এই ভাবে তিন দিবস অতিবাহিত হইবার পর ঐ মতের সাধনফল সম্যক্ হস্তগত হইয়াছিল।’ (শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ)
মনে করিয়ে দেওয়া যাক, তোতাপুরীর কাছে অদ্বৈত সাধনকালেও রামকৃষ্ণ তিনদিনে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন কৌশিক দত্ত-র লেখা: দ্বিধাগ্রস্ত বিবেকানন্দকে পথ দেখিয়েছিল যে কন্যাকুমারী
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
নিয়মিত যোগাযোগ
সিদ্ধিলাভের পরেও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ ও শ্রদ্ধায় কোনও ভাঁটা পড়েনি। প্রত্যক্ষদর্শী শশিভূষণ সামন্ত স্মৃতিচারণ করেছেন যে শ্রীরামকৃষ্ণ প্রতিদিন সকালে আবার কখনও-বা বিকেলে গাজিবাবার স্থানে সেলাম জানিয়ে আসতেন। (যুগপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ) এই আস্তানা দেখভাল করতেন যে ফকির ওস্তাগর, তাঁর সঙ্গে রামকৃষ্ণের গভীর সৌহার্দ্য ছিল। তিনি প্রায়ই আসতেন রামকৃষ্ণের কাছে। কোরানের কথা শোনাতেন। রামকৃষ্ণ শোনাতেন ভক্তিগীতি। দু’জনের চোখই ভিজে যেত। যাওয়ার বেলায় রামকৃষ্ণের কাছ থেকে মা-কালীর প্রসাদ নিয়ে যেতেন ওস্তাগর।
ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য তাঁর ‘ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ’ গ্রন্থে মন্মথনাথ ঘোষ নামে আর এক প্রত্যক্ষদর্শীর স্মৃতি সংগ্রহ করেছেন: শ্রীরামকৃষ্ণ সেদিন ভাইপো রামলালকে নিয়ে এক গাড়ি ভাড়া করে কালীঘাট দর্শনে গিয়েছিলেন। ফেরার সময় দেখা গেল দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের কাছে মসজিদের সামনে এক ফকির (সম্ভবত ফকির ওস্তাগর-ই হবেন) গভীর আবেগে ডাকছেন, ‘প্যারে আজাও আজাও’। সেই শুনে রামকৃষ্ণ গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে গেলেন সেই ফকিরের কাছে। দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরলেন গভীর ভালোবাসায়।
তখন আর কীসের বিবাদ, কারই পুকুর– কারই বা ডাঙা!
ঋণ:
‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণলীলাপ্রসঙ্গ’। স্বামী সারদানন্দ। উদ্বোধন
‘শ্রীরামকৃষ্ণ ও ইসলাম’। তড়িৎ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। সূত্রধর