অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের ওথেলো-ভিত্তিক ছায়াছবি ‘অথৈ’-এর শেষ কিছু মিনিটে কয়েকটা শট দেখে ওঁর কথাগুলো মনে পড়ছিল: সোহিনী সরকার, যিনি দিয়া/ডেসডেমোনার ভূমিকায় রয়েছেন, তিনি দাঁড়িয়ে, দর্শকের দিকে তাকিয়ে, তার পিছনে পর পর কলকাতার বিভিন্ন আইকনিক প্রতিষ্ঠান (নন্দন, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, শহিদ মিনার) টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে। ‘ভদ্রলোকোচিত ইমাজিনেশন’-এর ওপর এই আক্রমণটাই ‘অথৈ’-এর মিশন এবং এই মিশনে অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের ছবি ভীষণভাবেই সফল বলে মনে হল।
কয়েক সপ্তাহ আগে, পরিচালক ইন্দ্রনীল রায়চৌধুরী বাঙালি মধ্যবিত্তের সংকট এবং সিনেমায় কীভাবে সেটা তুলে ধরা যায়, তা নিয়ে একটা লেকচার দেন। তাঁর বক্তব্য ইউটিউবে রয়েছে। সেখানে তিনি বুঝিয়েছেন যে, বাঙালি মধ্যবিত্ত নামক ইমারতটি দাঁড়িয়ে থাকলেও তার ভেতরটা ফাঁপা হয়ে গেছে পুঁজিবাদ আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায় তথা ব্যাকওয়ার্ড কাস্ট গ্রুপের উত্থানের যৌথ আক্রমণে।
অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের ওথেলো-ভিত্তিক ছায়াছবি ‘অথৈ’-এর শেষ কিছু মিনিটে কয়েকটা শট দেখে ওঁর কথাগুলো মনে পড়ছিল: সোহিনী সরকার, যিনি দিয়া/ডেসডেমোনার ভূমিকায় রয়েছেন, তিনি দাঁড়িয়ে, দর্শকের দিকে তাকিয়ে, তার পিছনে পর পর কলকাতার বিভিন্ন আইকনিক প্রতিষ্ঠান (নন্দন, অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টস, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, শহিদ মিনার) টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে। ‘ভদ্রলোকোচিত ইমাজিনেশন’-এর ওপর এই আক্রমণটাই ‘অথৈ’-এর মিশন এবং এই মিশনে অর্ণ মুখোপাধ্যায়ের ছবি ভীষণভাবেই সফল বলে মনে হল।
এই আক্রমণটা শুরু হয় ওপেনিং ক্রেডিটস থেকেই– যখন কলাকুশলীদের নাম দেখানোর সময় পদবিটা বাদ দেওয়া হচ্ছে: অনির্বাণ অনির্বাণ, অনির্বাণ ভট্টাচার্য নয়, ইত্যাদি। ওথেলোর ভেনিস হয়ে গিয়েছে কাল্পনিক গ্রাম ভিনসুরা। ওথেলোর ভিলেন ইয়াগো এখানে গোগো, অনির্বাণ অভিনয় করছেন। শুরুতেই বাইকে চড়ে গোগো ভিনসুরা ঘুরে দর্শকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছে, গ্রামের অতীত এবং গল্পের প্রেক্ষাপট বোঝাচ্ছে গোগোর আখ্যান, যেটা গোটার ফিল্মটার ফ্রেমওয়ার্ক, কোনও সময় নষ্ট না করেই জাতির রাজনীতিতে ঢুকে পরে এই ছবি। জাত নিয়ে এত অকপট বাংলা ছায়াছবি বোধহয় আমি এর আগে কখনও দেখিনি। গোগো ফোর্থ ওয়াল ব্রেক করে ঘোষণা করে যে, সে কুলীন ব্রাহ্মণ, অথৈ/ওথেলো (অর্ণ) দলিত, গোগোর বাবার দয়ায় তার বাড়িতে তারই সঙ্গে বড় হয়ে ঠিকই, কিন্তু প্রেম, খেলাধুলা, পড়াশুনা– প্রতিটা ব্যাপারেই অথৈ সবসময় এগিয়ে ছিল গোগোর থেকে। গোগোর ঈর্ষা ছোটবেলা থেকেই শুরু: একটা সিনে ইঙ্গিত দেওয়া হয়ে যে, গোগো ঘুমিয়ে থাকা অথৈর ওপর প্রস্রাব করে।
ফিল্মটা যেমন উচ্চবর্ণের নোংরামি দেখাতে দ্বিধা বোধ করেনি, সেরকমই ক্যামেরা মুভমেন্টের মধ্যেও একটা হিংস্রতা, একটা আকস্মিকতা কাজ করেছে। আলো পরিকল্পনা এবং সম্পাদনা সবসময়ই একটা অস্থির পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে। যেন অর্ণ মুখোপাধ্যায় (এবং সৃজনশীল পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্য) সিনেমার গঠন এবং বিষয়বস্তু– দুটোতেই আগুন লাগিয়ে কলকাতার মধ্যবিত্ত বাঙালি দর্শককে ঝাঁকাতে চায়।
কারণ ওথেলোর গল্প সকলেরই জানা। প্রায় পৌরাণিক কাহিনিতে পরিণত হয়ে যাওয়া গল্প নিয়ে আপনি নতুন কী করবেন?
রিমিক্স করবেন! ‘অথৈ’ দেখে অনেকেই বলে উঠতে পারে যে, সিনেমাটা বড্ড বেশি স্টাইল ওভার সাবস্টেন্স হয়ে গিয়েছে, কিন্তু এখানে স্টাইলটাই সাবস্টেন্স। অর্ণ যেরকম একটা নতুন দৃষ্টিকোণ দিয়ে গল্পটা দেখছেন, ইয়াগোর চোখ দিয়ে। অর্ণ ইয়াগোকে একটা উচ্চবর্ণের ধূর্ত নিপীড়ক পিশাচ বানিয়েছেন, তার চোখ দিয়ে আমরা ভিনসুরাকে দেখছি; যেন একটা অশুভ শক্তি গোটা গ্রাম এবং ফিল্মটাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে, যেমন এফ. ডব্লিউ. মুরনুর ‘ফাউস্ট’ (১৯২৬) ছবিতে সেটান তার কালো চাদর দিয়ে একটা গ্রামকে ঢেকে ফেলে।
……………………………………………………………..
অর্ণ মুখোপাধ্যায় যেভাবে দ্বিতীয়ার্ধের শেষ চল্লিশ মিনিট টেনেছেন, সম্ভবত এই ভয়ে যে, দর্শক ওথেলো এবং ডেসডেমোনার ট্র্যাজেডির সঙ্গে সংযুক্ত বোধ করবে না, কারণ ছবিটার বেশিরভাগই উন্মত্ত গতিতে ছুটেছে, সেটা বেশ দুঃখজনক। আমি নিজেই দেখি যে দর্শকরা, যারা এতক্ষণ পর্যন্ত সিট কামড়ে চুপ করে বসেছিল, তারা অস্থির হয়ে শেষ তিরিশ মিনিটে স্মার্টফোন ঘাটা শুরু করে দিয়েছে।
……………………………………………………………..
ক্রমাগত হতাশাবাদ এবং অশ্লীলতা, এবং তার সঙ্গে চাঞ্চল্যকর গঠনশৈলী– অর্ণ এবং অনির্বাণের ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা সমসাময়িক বাংলা সিনেমার দর্শককে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার জন্য। সিরিয়াল-এর মতো বাংলা ছবি দেখা অভ্যস্ত দর্শক, যারা দেখে এসেছে ক্যামেরা পাঁচ মিনিট ধরে ড্রয়িংরুমে একটা কোনায় বাবু হয়ে বসে, গল্পগুলোও তেমনই সুশীল আর শান্ত, তাদের তো ‘অথৈ’ একটা ডাবল-শট আইরিশ কফির মতো লাগবেই।
সৌমিক হালদারের সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে এখানে কিছু কথা বলা প্রয়োজনীয়। তার কাজ ছবিতে একটা ‘Grand Guignol’ থিয়েটারের স্বাদ এনেছে, যেখানে গল্পের ঘটনাগুলো যেন একটা অতিজাগতিক, অলৌকিক, দুঃস্বপ্নের দুনিয়ায় ঘটছে। বাংলা চলচ্চিত্রে চিরকালই সাহিত্য থেকে সমৃদ্ধ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমাদের ফিল্মগুলি প্রায়শই শব্দবাচক এবং সাহিত্যানুগ হয়ে ওঠে। কিন্তু নাটক থেকে ফিল্ম তৈরি হলে তার রূপ কীরকম হতে পারে? তখন স্টাইলাইজেশন বেড়ে যায়, অভিনয় আর আলো-অন্ধকারের খেলা একটা রক কনসার্টের মতো মনে হতে শুরু করে। এখানে ‘অথৈ’ বাংলা সিনেমা বানানোর একটা নতুন ভাষা দেখিয়েছে, যেটা সিরিয়াল সিরিয়াল সিনেমাও নয়, আবার সস্তা দক্ষিণী ছবির কপিও না, বরং একটা একশো ভাগ নিও-বাঙালি উদ্ভাবন।
এবার আসছি ‘অথৈ’-এর খামতিতে।
অর্ণ মুখোপাধ্যায় যেভাবে দ্বিতীয়ার্ধের শেষ চল্লিশ মিনিট টেনেছেন, সম্ভবত এই ভয়ে যে, দর্শক ওথেলো এবং ডেসডেমোনার ট্র্যাজেডির সঙ্গে সংযুক্ত বোধ করবে না, কারণ ছবিটার বেশিরভাগই উন্মত্ত গতিতে ছুটেছে, সেটা বেশ দুঃখজনক। আমি নিজেই দেখি যে দর্শকরা, যারা এতক্ষণ পর্যন্ত সিট কামড়ে চুপ করে বসেছিল, তারা অস্থির হয়ে শেষ তিরিশ মিনিটে স্মার্টফোন ঘাটা শুরু করে দিয়েছে। অর্ণ জানেন যে, আজকের দিনে ওথেলো বানালে তার একমাত্র ইউএসপি হতে পারে স্টাইল। সেখানে তিনি হঠাৎ করে কেন গল্পের গতি কমিয়ে প্লট আর চরিত্রের প্রণোদনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, বুঝলাম না। গোগোরই ভাষায় ছবির ষাট শতাংশ ধরে যদি স্লগ-ওভার ব্যাটিং করা হয়, তাহলে শেষে গিয়ে স্ট্রাইক রেট কমানো হলো কেন? ‘অথৈ’ ১৫৮ মিনিটের ফিল্ম। এর সঠিক দৈর্ঘ্য হওয়া উচিত ছিল ১২০ থেকে ১৪০ মিনিট।
এছাড়া অথৈ’-এর মতো একটা ছবি, যেটা প্রগতিশীল রাজনীতির ধ্বজা নিয়ে মাল্টিপ্লেক্সে এসেছে, তার মহিলা চরিত্রগুলি কীভাবে এত এজেন্সি-হীন মিনমিনে খুকি হতে পারল, বুঝছি না। একটা সময়ের পরে ফিল্মটার অবিচলিত নারী-বিদ্বেষ আপনাকে শ্বাসরুদ্ধ করে তুলবে। ডেসডেমোনা যদি তার দক্ষিণ কলকাতার ড্যাডির হোটেল ছেড়ে একটা গন্ডগ্রামে এসে দলিত ছেলের সঙ্গে সংসার পাততে পারে, তাহলে কোনও ছেলে তাকে টিটকিরি মারলে বা অসভ্যতা করলে, তাকে থাপ্পড় মারতে পারবে না? ‘অথৈ’ বলছে, না।
সবচেয়ে বড় কথা হল, এই যে, ‘অথৈ’ একটি প্রতিক্রিয়াশীল ফিল্ম। অর্ণ-অনির্বাণের উদ্দেশ্য হতেই পারে পা রঞ্জিত এবং নাগরাজ মনজুলের দ্বারা শুরু করা আধুনিক দলিত সিনেমার তরঙ্গে যোগদান করার, কিন্তু তাঁদের ছবি ‘অথৈ’ এই যুক্তি দিচ্ছে যে, ঘৃণাতে ভরা পৃথিবীতে প্রগতিশীল রাজনীতির কোনও ভবিষ্যৎ নেই। এ ব্যাপারে আমি একমত নই।
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………