কেরিমার বাবা (পাবলো তারিমান) স্পষ্ট মনে করতে পারেন মেয়ের সঙ্গে তাঁর শেষবার দেখা হওয়ার দিনটাকে। বাড়িতে নয়, অন্য কোথাও দেখা করতে চেয়েছিল তাঁর মেয়ে, গোপনে। তখনই পাবলো বুঝে গিয়েছিলেন যে বিরাট কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে কেরিমা। দেখা হওয়ার পর (শেষবারের মতো) নিজের ছেলেকেও একবার দেখতে চেয়েছিলেন। দু-জনেই এই শেষবারের মতো কেরিমাকে দেখলেন। না! ঠিক বলা হল না। এরপরও একবার দু-জনে দেখেছিলেন তাঁকে। মানে তাঁর মৃত শরীরটাকে। সেটা ২০২১ সালের অগাস্ট মাস।
১৮.
কেরিমা লোরেনো তারিমান। ফিলিপিনস/২
গতসপ্তাহের পর…
বেঁকে যাওয়া পিঠ
মশার কামড়
বাচ্চা কেঁদেই চলেছে
ভাঙা হাঁটু
শস্তা সিগারেট
দামি সার
ধারের টাকা
ভগবান শাপ দেবে—
এই সবকিছুর ফলস্বরূপ
বেশ ঘনঘোর একটা
নীতিগল্পের আড়ালে
তৈরি হয় কৃষক আর
লালযোদ্ধাদের রূপকথা।
ইশকুলের পড়া শেষ হতেই ভর্তি হয়েছিলেন ফিলিপিনস হাইস্কুল ফর আর্টস-এ, সৃজনশীল লেখক গবেষক হিসাবে। আর ১৯৯৬-তে বের হল তাঁর প্রথম কবিতা-সংকলন। কেরিমার বয়স তখন ১৬। তাঁর ছিল কবিতার সঙ্গে বাঁচা। কিন্তু রক্তক্ষরণও কি অবিরত ছিল না?
বিপ্লবের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়নি তখনও। শুনতে পান, তাঁর পাহাড়ের ঢালে গরিবগুর্বোদের কুঁড়েতে, শহরের বস্তিতে অচেনা মহল্লায়, এমনকী চেনাশোনা মানুষজনের ঘরে সে আসে, যায়— বিপ্লবের সঙ্গে তাঁর সংলাপ বকেয়াই থেকে যায়। কিন্তু শতাব্দী-শেষের ফিলিপিনসে বিপ্লবের সঙ্গে একজন কবির দেখা না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। বিশেষ করে যে কবিকে সময় বিব্রত করে, বিক্ষত করে। সে-কথা দিব্যি বোঝা যায় তাঁর নিজের লেখা থেকে— প্রথমবারের জন্য যখন সত্যিকারের দেশটাকে খুঁজে পেতে গ্রামাঞ্চলে পাড়ি জমিয়েছিলেন— ‘প্রথম যখন গ্রামের দিকে গেলাম কৃষকদের সঙ্গে একাত্ম হব বলে, সরকারের সেপাইরা আমাকে হাতেকলমে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিল কীভাবে ফাশিজ়ম, প্রতিবিপ্লব আর মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ কাজ করে। যাতে এর কোনোকিছুই আমি ভুলে না যাই তা নিশ্চিত করতে আমাকে ওরা উপহার হিসাবে দিইয়ে দিয়েছিল হালকা গ্রেনেডের একটা খুদে ক্ষত, আর সোনার হাতঘড়িওলা একটা লোকের দীর্ঘ ছায়া (ডিকটেটর রদরিগো দুতার্তে), এর পর থেকে সব জায়গাতেই যে ছায়া আমাকে নজরে রাখবে।’
দিনক্ষণ মেপে না বলা গেলেও এটা ঠিক, বিপ্লব আর প্রেম কেরিমার জীবনে এসেছিল হাত ধরাধরি করে। এরিকসন অ্যাকোস্তা-র সঙ্গে যখন তাঁর প্রণয় (ও পরিণয়), সেই পর্বে— কবি উইম নাদেরার ভাষায়— ‘কেরিমা মানুষ, স্বভূমি আর কবিতার গভীরতাকে বুঝত। কবি হিসাবে সে সংঘর্ষের গুরুত্বটাও বুঝত। তাই সে চেয়েছিল, তার কাজ কবিতার চেয়ে বেশি মূল্যবান হয়ে উঠুক।’ পুরোপুরি বিপ্লবের কাজে নিজেকে জড়িয়ে নিচ্ছেন যখন, কবি হিসাবে কিন্তু তখন তিনি যথেষ্ট খ্যাত। সাংবাদিক লেন ওলিয়ার মতো অনেকেই কেরিমাকে মনে করতেন– ‘আমাদের প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ কবি।’ শুধু প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী আর লাল-মহলেই নয়, সিএনএন-ফিলিপিনস-এর মতো পুঁজিবাদী মিডিয়ার তালিকাতেও ‘২০১৮-র সেরা দশটি বই’-এর একটি ছিল কেরিমা লোরেন তারিমানের কবিতা সংকলন ‘সময়ের প্রতিবিম্ব: নতুনকে নিয়ে পুরনো কবিতা’। ২০১৭-য় প্রকাশিত এই বইটিই কেরিমার শেষতম কবিতা-সংকলন। আরও কবিতা লেখার সময় কি ছিল না?
২০০০ থেকেই নিজের কবিতায় মেটাফরের আড়াল পুরোপুরি ঘুচিয়ে কবিতাকে ক্রমশ রাজনৈতিক ইশ্তেহার করে তুলছিলেন কেরিমা। ‘শুদ্ধ কবিতা’-র পাঠকদের তা স্বাদু লাগবে না জেনেই। কবি যখন গেরিলা হন, তিনি কবিতাকে অ্যাকশন হিসাবে দেখবেন যে সেটাই তো স্বাভাবিক। এমানুয়েল লাকাবা-র সেই দুটো পঙক্তির মতো—
তার হাতের বলপেন দোনলা বন্দুকের মতো দীর্ঘ হয়ে ওঠে,
বদলে যাওয়ার লড়াই তার নিজের ভিতরেও চলতে থাকে।
কেরিমার বাবা (পাবলো তারিমান) স্পষ্ট মনে করতে পারেন মেয়ের সঙ্গে তাঁর শেষবার দেখা হওয়ার দিনটাকে। বাড়িতে নয়, অন্য কোথাও দেখা করতে চেয়েছিলেন তাঁর মেয়ে, গোপনে। তখনই পাবলো বুঝে গিয়েছিলেন যে বিরাট কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চলেছেন কেরিমা। দেখা হওয়ার পর (শেষবারের মতো) নিজের ছেলেকেও একবার দেখতে চেয়েছিলেন। দু’জনেই এই শেষবারের মতো কেরিমাকে দেখলেন।
না। ঠিক বলা হল না। এরপরও একবার দু’জনে দেখেছিলেন তাঁকে। মানে তাঁর মৃত শরীরটাকে। সেটা ২০২১ সাল। অগাস্ট মাসের ২০ তারিখ দুপুরবেলায় এক পরিচিত মানুষ ফোনে পাবলোকে জানালেন— আজ ভোর ছ’টায় নেগ্রোস আইল্যান্ডে ফিলিপিনস আর্মির ৭৯-তম ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে কমিউনিস্ট নিউ পিপলস আর্মি-র ৩৫ মিনিটের একটা সংঘর্ষ হয়েছেন। এতে রাষ্ট্রীয় আর্মির একজন এবং পিপলস আর্মির দু’জন প্রাণ হারিয়েছেন। এই দু’জনের একজন কিন্তু নারী গেরিলা, নাম তার বলা হচ্ছে ‘কা এলা’, দ্বিতীয়জনের নাম ‘পাবলিং’। সন্ধ্যার মধ্যে সিপিপি (ফিলিপিনসের কমিউনিস্ট পার্টি) বিবৃতি দিয়ে নিশ্চিত করে যে ‘কা এলা’ হচ্ছেন কেরিমা লোরেন তারিমান— বয়স ৪২ বছর, কবি, লেখক, শিল্পী এবং নিউ পিপলস আর্মি-র রোসেলিন জিন পেলে কম্যান্ডের অগ্রণী পার্টি-সদস্য।
স্বর্গের কোন আইন,
মর্ত্যের কোন আইন,
কোন কর্কশ জাদু
অথবা খিদের কোন তীক্ষ্ণ ব্যথা
আমাদের এনে দাঁড় করিয়েছে
এইদিকে? জনতার দিকে?
যা লেখা হয়েছে,
যা বলা হয়েছে,
যা খোদাই করা হয়েছে,
যা গড়া হয়েছে…
তার কিছুই নেই এখানে।
কোনও বই না,
কোনও মহাকাব্য না।
এখানে দাঁড়িয়ে আমরা
শুধিয়ে চলেছি—
কোন আইন? কোন আইন?
আমরা। আকাশ ছুঁয়ে
যে ঢেউ আসছে, আমরা তাতে
কয়েকটা ফোঁটা-মাত্র।
পুনশ্চ: পাবলো তারিমান যখন নিশ্চিত হলেন যে কা এলা-ই তাঁর আদরের কেরিমা, তখন কেরিমার ছেলে, ১৮ বছরের এমানুয়েল (সে দাদুর কাছে থেকেই পড়াশোনা করত) পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছিল। পাবলোর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল এটা ভাবতে যে কী করে এমান-কে তার মায়ের মৃত্যুসংবাদ জানানো হবে! ওকে জাগিয়ে যখন জানানো হল যে তার মা মারা গেছে— কী আশ্চর্য— এমানুয়েল শান্ত গলায় বলেছিল, ‘মারা যায়নি তো! শহিদ হয়েছে। আমি জানতাম…।’