ভাস্কর সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছিলেন চিলেকোঠা থেকে নিজের সংসার ঘরে, যেখানে কেউ রান্নাঘরে নির্দেশ দিচ্ছেন: মাসি আরও ডালবড়া ভাজুন। যেখানে দুর্খেইম এসে হাজির। বিনুনি দুলিয়ে সোনাঝুরি মেয়েটি গান গাইছে, শাড়ি পরেছে, দুলছে খুব একা। বন্ধুরা ডাকছে তাসের আড্ডায়। নবীন যুবা গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে বহুদ্দূরে। সেদিন যারা ভাস্করের হাত থেকে উপহার পেয়েছিলেন জিরাফের ভাষা, প্রায় সবার বইতেই একটা অদ্ভুত তারিখ লেখা ছিল। ৭ জুলাই, ২০০৬!
আমার একটু দেরিই হয়ে গিয়েছিল। কখনওই ঠিক সময়ে ঠিক জায়গামতো পৌঁছতে পারি না। ছাত্র-ছাত্রীরা ঘড়ি দেখে। সেইসব দূরদূরান্তের গঙ্গা পার করে আসা ছেলেমেয়েদের কতকালের দীর্ঘশ্বাসেই হয়তোবা আমার কাগজের ডিঙিপথ উল্টে যায়। সেদিনও তাই হবে। জুলাই মাসের ৭ তারিখ। ২০০৫ তখন ঘনিয়ে এসেছে।বরানগরের বাজারটা পেরিয়ে, ১৭/৫ বেনিয়াপাড়া লেনে পৌঁছে বুঝলাম– বাংলা কবিতার এক দৃশ্য আমার সামান্য ভুলে চিরকালের জন্য মেঘে ঢাকা পড়ে গেল। তবে সে দৃশ্যের জন্ম বারবার আমাদের মনে নানা চেহারায় দেখা দিয়ে যাবে।
বই নিয়ে আশ্চর্য সেন্সেটিভিটি ছিল একদিন বাংলা কবিতায়। এখন হাজার হাজার ডক্টর হাজরার ভিড়ে আসল-নকল চেনা শক্ত, বিটকেল এক হাসির শব্দ খামোকা কানে লেগে থাকে। শঙ্খ ঘোষের ইচ্ছে ছিল প্রকাশিত বইয়ের প্রথম কপি (বোধহয় দ্বিতীয়, প্রথমটি ‘ইভা’-কে? সে-উত্তর দিতে পারে এমন কাউকে আজ পাই কোথায়!) উৎসর্গের পাতায় নাম লেখা মানুষটিকে দেওয়া। দেওয়া মানে একেবারে বাড়িতে গিয়ে অবাক করে দেওয়া! এরকম অসম্ভব সৌন্দর্য বাংলা ভাষার লেখালিখির চৌহদ্দির মধ্যে দেদার ছিল। যেমন জার্নাল বইটি নিয়ে শঙ্খ ঘোষ আর ভাস্কর চক্রবর্তী চলেছেন জয় গোস্বামী-র কাছে, সেই দিনের স্মৃতি আমি ভাস্কর আর জয় দু’জনের কাছেই শুনেছি। এর মধ্যে অসম্ভব গোপনীয়তা ছিল, সেই গোপন আনন্দের। বিস্ময়ের। বন্ধুদের আড়াল করা দেনা-পাওনার ব্যাপার নয় সে-সব। ভাস্করের নিজের বই নিয়ে, লেখা নিয়ে যে-আনন্দময় এক খেলা চলত, তার সঙ্গে ভাষা প্রেমিকের যোগ ছিল। পাঁচ-সাত বছর ধরে বাঘের মুখের সামনে বসে লেখা কবিতা যে শেষমেশ হাতবোমা না হয়ে রংমশাল হয়ে যেত, তাও ওই ভালোবাসায়।
জিরাফের ভাষা লেখা হয়েছিল অনেক দিন ধরে। আমরা কয়েকজন সেইসব কবিতা কখনও টাটকা শুনতে পেতাম ছাপার আগেই। পত্র-পত্রিকায় একসঙ্গে পড়তাম। পাণ্ডুলিপিটা ২০০৫-এর ফেব্রুয়ারি মাস নাগাদ চোখেও দেখেছি। তারপর কী হল তার? জানি না! শুধু এটুকু জানতাম সে-বই আছে কোথাও। কোথায় কার কাছে– তার একটা আন্দাজ করতে ভালো লাগত। কিন্তু প্রশ্নের উত্তরে সেই জিরাফের ভাষা ! ভাস্করের চিকিৎসা কিন্তু মোটামুটি ২০০৪ থেকেই চলছিল। রোগটা তখনও ধরা না পড়লেও তার আন্দাজ ভাস্করের অনেক দিন ছিল। সেকথা এখন থাক। ২০০৫-এর ১৬ জুন ভাস্করকে ঠাকুরপুকুরে ভর্তি করার সময়েও আমরা বইয়ের খবর জানতাম না। কথাটা বলছি এ-জন্য, অবসানের দোরগোড়াতেও একজন প্রকৃত কবি কতখানি রহস্যে-খেলায় মগ্ন হতে পারেন, সেই অপূর্ব কথাটা আরেকবার মনে করে নিলে আমাদের চারপাশে হাফপ্যান্টের দেশে একটু হাঁফ ছাড়তে পারবে ছেলেমেয়েরা। একটা বোকামির শ্যাওলা মন্তব্যে কথায় আর চকরাবকরা তমসায় ঘনাচ্ছে।
………………………………………………………………………………
কবিতা নং : ৪৫
এতটা অসহনীয়, এতটা তিরিক্ষি, জেদি, পৃথিবী কি ছিল কোনোদিন?
যে আগুনে পুড়বো আমি, সে আগুন, কিছুটা আলাদা করে
বইয়ের পাতার মধ্যে সরিয়ে রেখেছি–
কলুটোলা যেতে হবে মোটাসোটা কমিটির মন বুঝে নিতে–
পৃথিবী তেমনভাবে পাল্টাবে না যেরকমভাবে ভাবো তুমি।
(রচনা তারিখ: ২৬.৬.২০০৪)
………………………………………………………………………………
স্যর আর অরিজিৎ কুমার– দু’জনে মিলে দিন পনেরোর মধ্যে তৈরি করে তুলছিলেন ‘জিরাফের ভাষা’। কথাটা দু’-একজন ছাড়া জানত না কেউ। এরই মধ্যে প্রচ্ছদ-প্রুফ-সাইজ-কাগজ সব ঠিক হয়েছিল। স্যর কে? তাঁকে নিয়ে কোনও কথা লেখা অসম্ভব! তিনি একাই একশো। এই একটি মাত্র বই যার ছাপাখানার কোনও পর্যায়ে কোনও কাজ ভাস্কর করেননি। যার প্রকাশ কে করছেন, কবে করছেন, ভাস্কর জানতেন না। যিনি জানতেন, তিনি এ-কথাও জানতেন হয়তো জুলাই মাসের পর আর সময় থাকবে না। ভাষা থাকবে, জিরাফ থাকবে না।
ভাস্করের মৃত্যুর ঠিক ১৬ দিন আগে, ৭ জুলাই শঙ্খ ঘোষ, গৌতম সেনগুপ্ত আর ‘প্যাপিরাস’ প্রকাশনার কর্ণধার অরিজিৎ কুমার দুপুরবেলা এসে পৌঁছন ভাস্করের ঘরে। সেই পুরনো ছোট্ট ঘরটার কথা ভাবলেই মনে পড়ে পুবে দরজা আর পশ্চিমের জানলা। ছাতে অপটু হাতে তৈরি প্লাস্টিক আর চটে ঢাকা জোড়াতালি দেওয়া বাথরুম।অসুস্থ কবি তিনতলা থেকে একতলায় নামতে পারবেন কী করে? সারাক্ষণ-ই প্রায় অক্সিজেন চলছে তখন।
…………………………………………………………..
কবিতা নং : ৪৮
এই সব সারেগামা পেরিয়ে তোমার কাছে দু-ঘণ্টা বসতে ইচ্ছে করে।
আমার তৃতীয় চোখ হারিয়ে গিয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে যে উঠে আসছে আজ আমি তার মুখও দেখিনি।
তোমাকে দুঃখিত করা আমার জীবনধর্ম নয়
চলে যেতে হয় বলে চলে যাচ্ছি, নাহলে তো, আরেকটু থাকতাম।
(রচনা তারিখ: ২৬.৬.২০০৪)
…………………………………………………………..
ঠিক কী হয়েছিল ছোট্ট বইটা হাতে নিয়ে? ভাস্করের তো সত্যি সত্যিই কথা বলার সাধ্য ছিল না সেদিন। বলেননি কিছু? স্যর-কে? এই যে অপার্থিব সৌন্দর্যের জন্ম হল দু’-তিনজন মানুষের ভেতর এর কি বর্ণনা দেবে তুমি? হ্বিটগেনস্টাইন বলেছিলেন, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না, তাতে নৈঃশব্দ্যেরই অধিকার। এই নিঃশব্দের এলাকা থেকেই সত্যিকারের কবিদের জন্ম হয়। তাতে জন্ম-মৃত্যু-বিষাদ-নিঃসঙ্গতার তকমা সকল ঝরে পড়ে। ভাষাহীন এক ভাষার হাওয়া বাতাসে আমরা শ্বাস নিতে পারি একটু।
ভাস্কর সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছিলেন চিলেকোঠা থেকে নিজের সংসার ঘরে, যেখানে কেউ রান্নাঘরে নির্দেশ দিচ্ছেন: মাসি আরও ডালবড়া ভাজুন। যেখানে দুর্খেইম এসে হাজির। বিনুনি দুলিয়ে সোনাঝুরি মেয়েটি গান গাইছে, শাড়ি পরেছে, দুলছে খুব একা। বন্ধুরা ডাকছে তাসের আড্ডায়। নবীন যুবা গাড়ি ছুটিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে বহুদ্দূরে। সেদিন যারা ভাস্করের হাত থেকে উপহার পেয়েছিলেন জিরাফের ভাষা, প্রায় সবার বইতেই একটা অদ্ভুত তারিখ লেখা ছিল। ৭ জুলাই, ২০০৬!
ভাস্কর ভুল করেছিলেন? ইচ্ছে করেই বসিয়েছিলেন ওই আসন্ন বছরের চিহ্ন, যা তাঁর জীবনে আসবেই না কোনও দিন? কী-যে ভুল, ভুলে যেতে হয় কত কিছু। কিন্তু, মৃত্যুর পরেও আমি কবিতা লিখে পাঠিয়ে দেব তোমাদের– সেই কবেই তো কথা দিয়েছিলেন ভাস্কর। মৃত্যুকে পেরিয়ে গিয়ে এই এক বেঁচে থাকার সংকেত। এই হল ইশারাময় নৈশঃব্দ্যের এলাকা, যে রহস্যের সমাধান কেউ কোনও দিন করতে পারবে না। যা তুমি ভাষায় বলতে পারা যায় না বলে ফেলে গেলে, কবি সেইখানেই শুরু করলেন তাঁর এলাকা।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পড়তে পারেন অরণি বসু-র লেখা: বুদ্ধদেবদাকে চিনতাম আদ্যন্ত কবিতার জন্য, সিনেমা বানানোর ইচ্ছের কথা জেনেছি অনেক পরে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বাংলা কবিতায় এই মূক প্রাণীটিকে যিনিই প্রথম নামিয়ে এনে থাকুন, তাকে ভাষা থেকে রক্তমাখা তুলে এনেছেন ভাস্কর। তাকে ছেড়ে দিয়ে গিয়েছেন ভাষার ভেতরে। কীভাবে সে ঘোরাফেরা করল সেসব কথা আরেকদিন বলা যাবে। আমি দেরি করেছিলাম সেদিন, দেখতে পাইনি স্যর আর ভাস্কর-কে মুখোমুখি। একজন লিখেছিলেন, চুপ কর শব্দহীন হও। আর অপরজন দেখেছেন: পৃথিবী মানুষমুগ্ধ পৃথিবী আপনমুগ্ধ নিজেই আনন্দ হয়ে আছে। এই আনন্দময় দ্বৈততাহীন আধার ভাস্কর আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন। যেখানে ভাষার অবসান, যেখানে নতুন ভাষার শুরু।
দেরি হয়ে গেলেও শুরু-র তো শেষ নেই কোনও।
……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………
পশ্চিমবঙ্গের একশ্রেণির মানুষ বলতেন, ওঁরা তো ভোটে না জিতে নেতা হয়েছেন। হ্যাঁ, সীতারাম ইয়েচুরি কখনও ভোটে জিতে মন্ত্রী বিধায়ক হননি। তারপরও দলমত নির্বিশেষে যে গ্রহণযোগ্যতা ও মর্যাদা তিনি দেশের সীমা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অর্জন করেছিলেন, সেটা ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত।