সম্প্রতি শ্রীময়ী সিং-এর একটি তথ্যচিত্র ‘‘অ্যান্ড, টুয়ার্ডস হ্যাপি এলিস’’ দেখে সেন্সরশিপ বস্তুটা আরও প্রকট হয়ে উঠল। সিনেমাটি শ্রীময়ী বানিয়েছেন ইরানের জীবন, ইরানের মানুষের সিনেমা-যাপন নিয়ে। সিনেমাটি দেখানো হল মুম্বই ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সৌজন্যে। সিনেমাটির ওয়ার্ড প্রিমিয়ার হয়েছে বার্লিনেল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে, ২০২৩ সালে।
সেন্সরশিপের বাংলা প্রতিশব্দ কী? অভিধান বলে শব্দটি ‘বিবাচন’ অথবা ‘প্রহরতা’। কিন্তু এ দেশে বাস করে আমরা হাড়ে হাড়ে বুঝি সেন্সরশিপ কী। আমাদের বড় হওয়ার প্রতিটি পদে আমাদের এই শব্দের সঙ্গে পরিচয় ঘটেছে। সেন্সর মানেই শুধু সিনেমার দৃশ্য বাদ দেওয়া নয়। বাড়ির বড়রা যেভাবে ঠিক করে দেন বাড়ির মেয়ে ঠিক কতটা ছোট জামা পরলে রাস্তায় বেরনোর যোগ্য অথবা ছেলেরা কানে দুল পরতে পারে কি না, সেটাও এক ধরনের সেন্সরশিপ। যেভাবে কী কথা বলব, কোন শব্দ লিখব, কোন বই পড়ব, কোন মাংস খাব, কোন পানীয় গ্রহণ করব– সেসবও এখন নির্দেশের আওতায়। আমরা বুঝে বুঝে, চারিপাশ দেখেশুনে রাস্তা পার করি। অনেকে আবার রাস্তায় বেরনো বন্ধ করে দিয়েছে।
সম্প্রতি শ্রীময়ী সিং-এর একটি তথ্যচিত্র ‘অ্যান্ড, টুয়ার্ডস হ্যাপি এলিস’ দেখে সেন্সরশিপ বস্তুটা আরও প্রকট হয়ে উঠল। সিনেমাটি শ্রীময়ী বানিয়েছেন ইরানের জীবন, ইরানের মানুষের সিনেমা-যাপন নিয়ে। সিনেমাটি দেখানো হল মুম্বই ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সৌজন্যে। সিনেমাটির ওয়ার্ড প্রিমিয়ার হয়েছে বার্লিনেল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে, ’২৩ সালে।
এই সিনেমার সব থেকে বড় পাওনা জাফর পানাহি। ছবিটিতে আমরা দেখতে পাই জাফর পানাহি গাড়ি চালাচ্ছেন, পাশের সিটে বসে পরিচালক শ্রীময়ী। জাফর বলে চলেন তাঁর কথা, তাঁর দেশের মুক্তমনা মানুষের কথা, ইরানের শিল্পীরা কীভাবে তিলে তিলে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন সিনেমা বানানোর জন্য।
জাফর পানাহি-র ‘অফসাইড’ (২০০৬)-এ আমরা দেখেছি কীভাবে কয়েকটি মেয়ে একটি স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলা দেখতে লুকিয়ে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে। লুকিয়ে কারণ ইরানে ফুটবল স্টেডিয়ামে ইরানি মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। এই সিনেমার পরে সরকারের নজর তাঁর দিকে পড়ল আরও তীব্রভাবে। তার ফলাফল স্বরূপ জাফর পানাহি ২০১০ সালে প্রথম জেলে যান, তাঁর স্ত্রী-কন্যা এবং আরও ১৫ জন বন্ধুর সঙ্গে। রাষ্ট্র জাফর পানাহি-র বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে রাষ্ট্রবিরোধী প্রোপাগান্ডা চালানোর অপরাধ। কয়েক মাস পরে জেল থেকে ছাড়া পেলেও, ২১ বছরে জন্য সিনেমা বানানো, চিত্রনাট্য লেখার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। জেল থেকে বেরলেও তাঁকে দীর্ঘদিন গৃহবন্দি হয়ে থাকতে হয়েছে। তাঁর ‘দিস ইজ নট আ ফিল্ম’ সিনেমায় তাঁর গৃহবন্দি সময়ের কথা কিছুটা দেখতে পেয়েছি। একটা মানুষ সিনেমাকে কতটা ভালোবাসলে মেঝেতে দাগ কেটে সিনেমার দৃশ্য আঁকতে থাকে। তারপর কেঁদে ফেলেন। শুধুমাত্র সিনেমা না বানানোর যন্ত্রণা কোনও মানুষকে এতটা আঘাত করতে পারে, তা হয়তো আমাদের ততটাও জানা ছিল না।
………………………………………………………………….
ইরানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রাচীন। আমাদের ভাষায়, খাদ্যাভ্যাসে, সংগীতে ইরানের সঙ্গে আমাদের প্রাচীন সম্পর্ক রয়েছে, তা পোলাও অথবা পিলাফ হোক অথবা সেতার– মিল প্রচুর। তবে শুধু ভালো দিকগুলো নয়, খারাপ মিলগুলো আছে। যেমন আমাদের সেকুলার সমাজ হোক, বা ইরানের ইসলামি সমাজ, দুই দিকেই এখনও নারীদের পর্দায় রাখার চেষ্টা অব্যাহত। কখনও তা ধর্মের নামে, কখনও বা পারিবারিক সম্মানের নামে।
………………………………………………………………….
আরেক পরিচালক মহম্মদ রাসুলফকে জেলে পাঠানোর বিরুদ্ধে জাফর পানাহি প্রতিবাদ করেছেন বলে তাঁকে আবার গ্রেফতার করা হয় ২০২২ সালে। এবার প্রায় ৬ মাসের জন্য জেল, জেলে থাকাকালীন জাফর পানাহি অনশন শুরু করলে সরকার বাধ্য হয় তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দিতে। কাকতালীয়ভাবে যখন শ্রীময়ীর সিনেমাটি প্রিমিয়ার হচ্ছিল ’২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বার্লিনেল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে, সেই ফেব্রুয়ারি মাসেই জাফর পানাহি জেল থেকে মুক্তি পান।
সিনেমার এক জায়গায় ইরানি চিত্রপরিচালক মহম্মদ শিরভানি তাঁর ইন্টারভিউ দিতে দিতে কথা বলছিলেন। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, শিরভানির সিনেমাকে ইরানের সেন্সর বিভাগ একটু বাঁকা চোখেই দেখে, কারণ ওঁর সিনেমায় মানুষের শরীর খুব গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। কাপড়ের আবরণে জড়ানো মানুষের দেহ নয়, বরং কাপড়ের সেন্সর ছিড়ে ফেলে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করা মানুষের দেহ শিরভানির সিনেমার বিষয়।
শ্রীময়ীর প্রশ্নের উত্তরে উনি যখনই কথা বলতে শুরু করেন, তখনই পাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসে এক তীব্র ড্রিলিং মেশিনের আওয়াজ। শিরভানি মজা করে বলেন যে, হয়তো পাশের বাড়ির লোকটি জানে যে শিরভানি এমন কিছু কথা বলবেন, যা সেন্সর করা প্রয়োজন, তাই তিনি কথা বলতে শুরু করলেই ড্রিলিংয়ের শব্দ তীব্র হয়, কিন্তু শিরভানি যদি ধর্মীয় বিশ্বাসের কথা বলেন, তাহলে ড্রিলের শব্দ থেমে যাবে। কথা প্রসঙ্গে, শিরভানি বলেন যে, সেন্সর শুধুমাত্র রাষ্ট্র আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয় এমন নয়, এর বাইরেও সেন্সর আছে। রাষ্ট্রের সেন্সরের বিরুদ্ধে হয়তো কথা বলা যায়, আন্দোলন করা যায়, কিন্তু আমাদের মনের মধ্যে পুষে রাখা অজ্ঞাত যে সেন্সরের চশমায় আমরা সব সময় কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক– বিচার করে চলেছি সেই সেন্সরের কী হবে?
শ্রীময়ীর সিনেমায় এক জায়গায় দেখা যায়, শ্রীময়ী শুটিংয়ের সময় সাউন্ড রেকর্ডার হাতে থাকায় নিজের মাথার চাদর ধরতে পারেনি, ফলে সেটি মাথা থেকে সরে, রাস্তায় পড়ে যায়। ঠিক তখনই কোথা থেকে একটি ছোট ছেলে সাইকেল চালিয়ে এসে মন্তব্য করে যে, মেয়েদের মাথায় চাদর সরানো উচিত নয়। দৃশ্যটি দেখে আমার মনে পড়ল কয়েক বছর আগে প্রকাশিত আমাদের দেশের একটি খবর, হরিয়ানার খাপ-পঞ্চায়েত একটি ফরমান জারি করেছিল, মেয়েদের চাউমিন খাওয়া বা মোবাইল ব্যবহার করা উচিত নয়, এতে তাদের চরিত্র নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
শ্রীময়ীর সিনেমায় উঠে এসেছে ফোরো ফারুকজাদ-এর কবিতা। অ্যাকাডেমিশিয়ান এবং নারী-সাহিত্যকর্মী জিনোস নাজোখর বলেছেন, কীভাবে ফারুকজাদের কবিতা আধুনিক মুক্তমন ইরানি নারীর ভাষা হয়ে উঠেছে। সিনেমার একটি দৃশ্যে শ্রীময়ী ফারো ফারুকজাদের কবরে গেছেন তাঁর এক বন্ধুর সঙ্গে, বন্ধু যেই কবরের পাশে বসে তাঁর পার্শিয়ান সিতার বাজাতে শুরু করেছেন, এমন সময় কোথা থেকে জানি কিছু লোক এসে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করল এবং গাছ কাটতে শুরু করল, যাতে সিতার বাজানোয় ব্যাঘাত ঘটে।
………………………………………………………………..
জাফর পানাহির ‘দিস ইজ নট আ ফিল্ম’ সিনেমায় তাঁর গৃহবন্দি সময়ের কথা কিছুটা দেখতে পেয়েছি। একটা মানুষ সিনেমাকে কতটা ভালোবাসলে মেঝেতে দাগ কেটে সিনেমার দৃশ্য আঁকতে থাকে। তারপর কেঁদে ফেলেন। শুধুমাত্র সিনেমা না বানানোর যন্ত্রণা কোনও মানুষকে এতটা আঘাত করতে পারে, তা হয়তো আমাদের ততটাও জানা ছিল না।
………………………………………………………………..
প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, ইরানের রাস্তায় বা পার্কে বা যে কোনও পাবলিক জায়গায় মিউজিক বাজানো নিষেধ না হলেও কবরস্থানে মিউজক বাজানোকে সমাজের নীতিপুলিশেরা ভালো চোখে দেখে না। রাস্তার ধারে কখনও হয়তো দেখা যায় কিছু ছেলে গান-বাজনা করছে, হয়তো কখনও দেখা যায় কোনও মেয়েও বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছে, কিন্ত মেয়েদের প্রকাশ্য রাস্তায় গান গাওয়া নিষিদ্ধ।
সিনেমার কোথাও সরাসরি পুলিশ কিংবা ইসলামিক মোল্লারা এসে শ্রীময়ীকে প্রশ্ন করেন না। কিন্ত যখনই সিনেমাটিতে দেখা যায় এমন কিছু ঘটনা ঘটছে, যা ইরানের নীতির বিরুদ্ধে, তখনই দেখা যায় কিছু অজানা লোক এসে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। যাদের সরকার বলেনি ব্যাঘাত ঘটাতে, কিন্তু কোনও এক অদ্ভুত বাঁধনে সাধারণ মানুষের মধ্যে এমনভাবে এই নীতিপুলিশ ঢুকে গিয়েছে, যা বারবার বেরিয়ে আসে তার নীরব অথচ আগ্রাসী মুখ নিয়ে।
তথ্যচিত্রের এক জায়গায় জাফর বলেন যে, তাঁর কাছে হয়তো সুযোগ ছিল ইরান ছেড়ে বেরিয়ে অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে নেওয়ার, তাহলে হয়তো বেঁচে থাকা এবং নিজের মতো সিনেমা বানানো একটু সুবিধার হত। যেরকম অনেক ইরানি শিল্পী কিংবা ফিল্মমেকার করেছেন। কিন্ত জাফর উল্টে প্রশ্ন করেন, কেন যাবেন তিনি এই দেশ ছেড়ে, তাঁর নিজেদের মানুষদের ছেড়ে, যে মানুষের গল্প তাঁর সিনেমায় উঠে এসেছে, সেই মানুষের সঙ্গ ছেড়ে তাঁর পক্ষে থাকা সম্ভব হবে না। ইরানের মানুষের সঙ্গে সঙ্গে পথ না চললে তিনি সিনেমার ভাষা হারিয়ে ফেলবেন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন সুমন সাহা-র লেখা: পুরুষ মানেই সে শাসক আর নারী মানেই সে শোষিত, এই একপেশে সমীকরণ ‘লাপতা লেডিজ’ বিশ্বাস করে না
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তথ্যচিত্রটি দেখতে দেখতে বারবার এই প্রশ্নটা আমাদের মাথায় ঘুরপাক খায়। এই যে ভালো-মন্দের যে ভেদাভেদ আমরা আমাদের মাথার মধ্যে সযত্নে পুষে রাখি, তার হিসেব কে রাখবে? এই মানসিক ব্যাধিকে আমাদের মন থেকে সরাবে কে?
ইরানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক প্রাচীন। আমাদের ভাষায়, খাদ্যাভ্যাসে, সংগীতে ইরানের সঙ্গে আমাদের প্রাচীন সম্পর্ক রয়েছে, তা পোলাও অথবা পিলাফ হোক অথবা সেতার– মিল প্রচুর। তবে শুধু ভালো দিকগুলো নয়, খারাপ মিলগুলো আছে। যেমন আমাদের সেকুলার সমাজ হোক, বা ইরানের ইসলামি সমাজ, দুই দিকেই এখনও নারীদের পর্দায় রাখার চেষ্টা অব্যাহত। কখনও তা ধর্মের নামে, কখনও বা পারিবারিক সম্মানের নামে।
……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………
শ্রীময়ীকে ধন্যবাদ এরকম একটা ছবি বানানোর জন্য। এই মানুষগুলোর সঙ্গে আমাদের সিনেমার বাইরের রোজকার জীবনে দেখা করানোর জন্য।
জীবনের বাকি শাখা-প্রশাখা থেকে বাদুড়ের মতো ঝুলতে দেখা যায়, ‘অকৃতজ্ঞ’, ‘বিশ্বাসঘাতক’, ‘তঞ্চক’ নামের নানা কুটিল শব্দবন্ধকে। যারা উদর নয়, হৃদয়কে তাক করে। বারবার। যন্ত্রণার ক্ষেপণাস্ত্র চালিয়ে বুকের বাঁ দিকটা এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে থাকে সুযোগ পেলে।