এই এগজিবিশনে বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল ফ্রিদার করা (প্রথম দিকের) জল রং, যা সাধারণত প্রদর্শিত হয় না। বস্তুত চলচ্চিত্রের রূপায়ণের ফলে এবং চোখে দেখার আগ পর্যন্ত এক ধরনের ভুল ধারণা ছিল যে, ফ্রিদা বিশাল ক্যানভাসে কাজ করতেন। অথচ একমাত্র ‘দ্য টু ফ্রিদাস’ ছাড়া প্রায় সব ছবিই ছোট– ১ ফুট বা ২ ফুট সাইজের। এবং বেশিরভাগ কাজ ক্যানভাসেও নয়– মেটাল, উড ও ম্যাসোনাইট বোর্ডে, যা ক্যানভাসের চেয়ে অনেকটাই সস্তা। ফ্রিদা কেন বিভিন্ন ধরনের সারফেস ব্যবহার করতেন, তা ঠিক পরিষ্কার নয়,
ফ্রিদা আজীবন, ফ্রিদা আমরণ
২০০৫ সাল, ততদিনে সালমা হায়েক অভিনীত হলিউডের ছবি ‘ফ্রিদা’ (জুলি তেমোর, ২০০২) রিলিজ করেছে ও বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। এছাড়া মেক্সিকান শিল্পী ফ্রিদা কাহলো-র জন্মশতবার্ষিকী আগতপ্রায়। ফলে ‘দেয়ার ওয়াজ ফ্রিদা ইন দি এয়ার’। সেসময়ে অবশ্য ফ্রিদা নিয়ে এত বই, ছবি, ওয়েবসাইট ছিল না, থাকলেও আমাদের হাতের কাছে ছিল না। যেমন ১৯৮৩-তে লেখা লরা মালভি ও পিটার ওয়ালেন-এর ব্যাখ্যান, বা হেইডেন হেরেরা-র বই। যদিও সাধারণভাবে জানা ছিল যে ফ্রিদা সুররিয়ালিস্ট পেইন্টার ও ক্যুইয়ার-ফেমিনিস্ট। এবং কমিউনিস্টও বটে। মোটের ওপর বাজারে তখনও ফ্রিদা টি-শার্ট, ফ্রিদা ব্যাগ, ফ্রিদা হেয়ারব্যান্ড, ফ্রিদা ড্রেস মেটেরিয়াল, ফ্রিদা ব্লাউস, ইত্যাদি ইত্যাদি ছেয়ে যায়নি। ফ্রিদা-কে নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা ছিল, এবং ছিল অনেকটা ম্যাজিক।
যে সময়ে ‘ফ্রিদা’ ছবিটি রিলিজ করে, মোটামুটি সেই সময়ে আমার হাতে আসে গীতা কাপুরের বই ‘হোয়েন ওয়াজ মডার্নিজম’ (২০০০)। বইটির ফিল্ম/ন্যারেটিভ অংশটি ফিল্ম স্টাডিজের জন্যে জরুরি হলেও, আমি পড়তে শুরু করি প্রথম অধ্যায়– ‘বডি অ্যাজ জেসচার: ওমেন আর্টিস্ট অ্যাট ওয়ার্ক’। অর্থাৎ যে শিল্পীদের কাজের কেন্দ্রে রয়েছে শরীর– শুধুমাত্র ছবি বা ইমেজের কেন্দ্রে নয়, সম্পূর্ণ কাজের পরিধির মধ্যেই শরীর। গীতা এই লেখায় অমৃতা শের-গিল, ফ্রিদা কাহলো, নলিনী মালানি ও অর্পিতা সিংহের ছবি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
আপাতত ফ্রিদার কথায় আসি।
গীতা সুররিয়ালিস্টদের গুরু আন্দ্রে ব্র্যতোঁ-র কথা উল্লেখ করেছেন; আন্দ্রের মতে: ‘The art of Frida Kahlo is a ribbon around a bomb’। গীতা অবশ্য আন্দ্রের এই উক্তি ‘রোমান্টিক ইমাজিনেশন অফ দি ফেমিনিন’ বলে খণ্ডন করেছেন। উল্টোদিকে তিনি ফ্রিদার ছবির আইকনোগ্রাফি, মেটাফর ও ‘ফেমিনিন অ্যাজ মাসকারেড’ (ছদ্ম-আবরণ) নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। কিন্তু আমার চোখে পড়ল একটি ফুটনোট। প্যারিস এগজিবিশন (১৯৩৯)-এর সময়ে ফ্রিদা লিখছেন: So I had to wait days and days just like an idiot till I met Marcel Duchamp (marvelous painter), who is the only one who has his feet on the earth, among all this bunch of coocoo lunatic sons of bitches of the surrealists… I am so sick and tired of the whole affair that I have decided to send everything to hell, and scram from this rotten Paris…। সংক্ষেপে বললে, ফ্রিদা তাঁর প্রদর্শনীর সময়ে সুররিয়ালিস্টদের নানা কটূক্তি করেন, ও অবশেষে বীতশ্রদ্ধ হয়ে প্যারিস ত্যাগ করেন। আরও বোঝা গেল, ফ্রিদার কাজে সুররিয়ালিজমের কিছু উপাদান থাকলেও তিনি নিজেকে সুররিয়ালিস্ট মনে করতেন না। বরং, তাঁর মতে, তিনি তাঁর দেখা বাস্তবটাই চিত্রায়িত করেছেন। ফ্রিদা তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন: They thought I was a Surrealist but I wasn’t. I never painted dreams. I painted my own reality। যেমন তাঁর ছবিতে তাঁর পোষ্য– দু’টি বাঁদর ও একটি টিয়া– অনায়াসে বিচরণ করে। তাছাড়াও, তাঁর কাজে প্রাচীন অ্যাজটেক ভাবধারার ও জনপ্রিয় মেক্সিকান লোককাহিনির প্রভাব রয়েছে। অর্থাৎ, ফ্রিদার কাজ, কাজের ধারা ও ধরন বুঝতে গেলে ইউরোপীয় বাস্তবতা ও মেহিকোর বাস্তব পরিস্থিতির তফাতগুলো বুঝতে হবে। বুঝতে হবে তাঁর মেক্সিকান পরিচয় ও রাজনৈতিক চিন্তন।
……………………………………………………………………………………………………………..
আমি যখন ২০০৫-এ কাজের সূত্রে লন্ডন গিয়ে উপস্থিত হই, তখন যে ফ্রিদার গুরুত্বপূর্ণ এগজিবিশন চলছে, জানা ছিল না। ৭ জুলাই, বন্ধুরা মিলে তৈরি হয়ে, চা খেয়েই বেরব বেরব করছি। সেসময় এক বন্ধু বলল: ‘চট করে নিউজটা দেখো তো, অদ্ভুত সব মেসেজ আসছে’। টিভি খোলা হল, জানা গেল লন্ডনের চারটে প্রধান জায়গায় বম্বিং হয়েছে। বাইরে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।
………………………………………………………………………………………………………………
২০০৫, জুলাই, টেট মডার্ন, লন্ডন
ফ্রিদার জীবনের বিশেষ ঘটনাগুলি মোটামুটিভাবে অনেকের জানা। ১৯০৭-এ জন্ম, বাবা মেক্সিকান, মা জার্মান (হাঙ্গেরিয়ান অরিজিন),ছেলেবেলায় পোলিওয়ে আক্রান্ত হন, মস্ত মেক্সিকান আইকনিক (মিউরাল) শিল্পী দিয়েগো রিভেরার সঙ্গে দু’-দু’বার বিয়ে, একাধিক সম্পর্ক (এমনকী, লিও ট্রটস্কি-র সঙ্গেও), এবং ১৯২৫-এর প্রায় প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা, যার ফলে তাঁর শরীর বিদীর্ণ হয়ে যায়। এই দুর্ঘটনায় তাঁর কলারবোন, ডান পা, মেরুদণ্ড, পাঁজর, শ্রোণী– সবই– ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে যায়। এবং একটি রড তাঁর শরীরের বাঁদিক দিয়ে গিয়ে তাঁর যোনি দিয়ে বেরিয়ে যায়। এরপর ফ্রিদা মারা যাবেন– এমনটা ধরে নেওয়া হলেও, ফ্রিদা বেঁচে থাকেন এবং মানুষকে ভালোবাসেন, ঘৃণা করেন, প্রেমে পড়েন, প্রেম করেন, রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকেন ও ছবি আঁকেন। তাছাড়া, পরবর্তীকালে, প্রথমে ফ্রিদার ডান পায়ের আঙ্গুল কেটে বাদ দেওয়া হয়, এবং অবশেষে, ডান পা বাদও যায়। এহেন মানুষের কাজের কেন্দ্রবিন্দু যে শরীরের যন্ত্রনা এবং রাগ, দুঃখ, ভালোবাসা, বিদ্বেষ, অবসাদ, আকাঙ্ক্ষা, যৌনতা ও জীবনের জয়গান থাকবে সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক।
আমি যখন ২০০৫-এ কাজের সূত্রে লন্ডন গিয়ে উপস্থিত হই, তখন যে ফ্রিদার গুরুত্বপূর্ণ এগজিবিশন চলছে, জানা ছিল না। ৭ জুলাই, বন্ধুরা মিলে তৈরি হয়ে, চা খেয়ে বেরব বেরব করছি। সেসময় এক বন্ধু বলল: ‘চট করে নিউজটা দেখো তো, অদ্ভুত সব মেসেজ আসছে’। টিভি খোলা হল, জানা গেল লন্ডনের চারটে প্রধান জায়গায় বম্বিং হয়েছে। বাইরে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। এদিকে, আমি রীতিমতো ছটফট করতে লাগলাম, এগজিবিশন যদি বন্ধ হয়ে যায়? দিন কতক সব অচল ছিল, তারপর আবার ছন্দে ফেরা। অবশেষে, এক সপ্তাহ পরে আমার টেট মডার্ন যাওয়া হল– ‘ফ্রিদা’ দেখতে।
এই এগজিবিশনে ফ্রিদার ৮০টি কাজ প্রদর্শিত হয়, তার মধ্যেই ছিল তাঁর বিখ্যাত সব ছবি– ‘সেলফ-পোর্ট্রেট ইন আ ভেলভেট ড্রেস’ (১৯২৬), ‘হেনরি ফোর্ড হসপিটাল’ (১৯৩২), ‘আ ফিউ স্মল নিপ্স’ (১৯৩৫), ‘সেলফ-পোর্ট্রেট উইথ মনকি’ (১৯৩৮), ‘দ্য টু ফ্রিদাস’ (১৯৩৯), ‘সেলফ-পোর্ট্রেট উইথ ক্রপড হেয়ার’ (১৯৪০), ‘দ্য ব্রোকেন কলাম’ (১৯৪৪), ‘দ্য লিটল ডিয়ার’ (১৯৪৬), এবং আরও অসংখ্য সেলফ-পোর্ট্রেট। ১১টি ভাগে বিভক্ত, এবং দু’টি ঘরে শুধুমাত্র ফ্রিদার সেলফ-পোর্ট্রেট। দেখা হল ‘সেলফ পোর্ট্রেট উইথ মনকি অ্যান্ড প্যারট’ (১৯৪২), ‘সেলফ পোর্ট্রেট উইথ লুজ হেয়ার’ (১৯৪৭), ও আরও অনেক ছবি।
বিশেষভাবে এখনও মনে পরে ‘ফ্রিদা কাহলো অ্যান্ড দিয়েগো রিভেরা’ (১৯৩১) ছবিটি (অয়েল পেইন্টিং, মোটামুটিভাবে তিন ফুট বাই আড়াই ফুট)। ফ্রিদার বিয়ের ছবি বা ফ্রিদার মনে বিয়ের যে ছবি ছিল, তার প্রতিচ্ছবি। পরনে সবুজ পোশাক, লাল শাল, পাশে দিগুণ আকারের দিয়েগো রিভেরা। দিয়েগোর ভার– বয়সের, খ্যাতির, অর্থের, সম্মানের, প্রতিপত্তি ফ্রিদা আজীবন বহন করেছেন। সেই টানাপোড়েন প্রায় তাঁর সব ছবিতেই প্রকট। বিশেষভাবে দুরূহ ছিল ১৯৩১ থেকে ১৯৩৫-এর সময়– আমেরিকায় অনিচ্ছা সত্ত্বেও থাকা, একাধিকবার গর্ভপাত, রক্তক্ষরণ, মায়ের মৃত্যু, তার বোনের সঙ্গে দিয়েগোর সম্পর্ক ও বিবাহ-বিচ্ছেদ। এই সময়কালের অনেক ছবি আমাদের চেনা– যেমন ‘হেনরি ফোর্ড হসপিটাল’, ‘মাই বার্থ’ (১৯৩৬), ‘আ ফিউ স্মল নিপ্স’, ‘মাই গ্র্যান্ডপেরেন্টস, মাই পেরেন্টস, অ্যান্ড আই’ (১৯৩৬) এবং প্রচুর সেলফ-পোর্ট্রেট।
সম্ভবত, আরও দুঃসহ ছিল ১৯৪০-এর পরবর্তী সময়ে: ত্রোৎস্কির হত্যা, নানান ব্যাধি, অসংখ্য অপারেশন ও আমেরিকায় অসফল অস্ত্রোপচার। অথচ, এই সময়ে ফ্রিদা অনেক বেশি কাজ করেছেন। এঁকেছেন ‘দ্য ব্রোকেন কলাম’, ‘দ্য লিটল ডিয়ার’, ‘দিয়েগো ইন মাই থটস’ (১৯৪৩) এবং ‘দিয়েগো অ্যান্ড আই’ (১৯৪৯); এছাড়া এই এগজিবিশন বহির্ভূত এক ভয়ানক ছবি– ‘উইথআউট হোপ’ (১৯৪৫)।
এই এগজিবিশনে বিশেষভাবে লক্ষণীয় ছিল ফ্রিদার করা (প্রথম দিকের) জল রং, যা সাধারণত প্রদর্শিত হয় না। বস্তুত চলচ্চিত্রের রূপায়ণের ফলে এবং চোখে দেখার আগ পর্যন্ত এক ধরনের ভুল ধারণা ছিল যে, ফ্রিদা বিশাল ক্যানভাসে কাজ করতেন। অথচ একমাত্র ‘দ্য টু ফ্রিদাস’ ছাড়া প্রায় সব ছবিই ছোট– ১ ফুট বা ২ ফুট সাইজের। এবং বেশিরভাগ কাজ ক্যানভাসেও নয়– মেটাল, উড ও ম্যাসোনাইট বোর্ডে, যা ক্যানভাসের চেয়ে অনেকটাই সস্তা। ফ্রিদা কেন বিভিন্ন ধরনের সারফেস ব্যবহার করতেন, তা ঠিক পরিষ্কার নয়, যদিও অনেক আর্টিস্টই (যেমন পিকাসো) সেরামিক-প্লেটে কাজ করেছেন, এবং ফ্রিদাও নানান রাউন্ড মেটাল শিটের ওপর ‘স্টিল লাইফ’ করেছেন।
একটি ছবি দেখে চমকে উঠেছিলাম– ‘মাই ড্রেস হ্যাংস দেয়ার’ (১৯৩৩, ম্যাসোনাইটের ওপর অয়েল ও কোলাজের কাজ)। ছোট একটি ছবি– ফ্রেমের কেন্দ্রে ফ্রিদার লাল-সবুজ জামা নীল দড়ি থেকে ঝুলছে।এই নীল ফিতে বা দড়ি দু’দিকের দু’টি পেডেস্টালে বাঁধা, একদিকে যার ওপর রয়েছে একটি টয়লেট (কমোড), ও অপরদিকে রয়েছে একটি ট্রফি। পেডেস্টালের একপাশে আগুন জ্বলছে, অন্যদিকে বিশাল আকারের ট্র্যাশ-ক্যান। ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখা যায় বিখ্যাত নিউ ইয়র্ক সিটি-স্কেপ, মিডগ্রাউন্ডে দেখা যায় সারি-সারি স্কাই-স্ক্র্যাপার, এবং ফোরগ্রাউন্ডে সারিবদ্ধ অসংখ্য শ্রমিক (এই অংশটি কোলাজ)। এইরকম আশ্চর্য ছবি সচরাচ দেখা যায় না। পুঁজিবাদ, মার্কিন গণতন্ত্রের ইমেজ ধূলিস্যাৎ করা ছাড়াও আর একটি কথা মনে হয়ে এই ছবির প্রসঙ্গে। দ্য ব্লু রিবন। দৈববসে কোনও দিন যদি আন্দ্রে ব্র্যতোঁ-র সঙ্গে দেখা হত, বলতাম: The art of Frida isn’t a ribbon around a bomb. Even if Frida means peace and beauty, she is the bomb. She exploded inside my head.