অধিবেশনে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছেন ইনার মণিপুর কেন্দ্রের কংগ্রেস সাংসদ এ বিমল আকোইজম। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে হারিয়ে তিনি লোকসভায় এসেছেন। প্রথম ভাষণেই শোরগোল ফেলে দিয়েছেন দেশে। রাষ্ট্রপতির ভাষণে যথারীতি উল্লেখ ছিল না গত এক বছর ধরে চলতে থাকা মণিপুরের জাতিদাঙ্গার কথা। আকোইজমকে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর বলতে দেওয়া হয়েছিল প্রায় মধ্যরাতে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে গণপরিষদে দেওয়া জওহরলাল নেহরুর ‘আ ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’ ভাষণ চিরকালীন ভাইরাল। এ বার সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হল লোকসভায় মধ্যরাতে দেওয়া জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের ভাষণ।
প্রচ্ছদ: অর্ঘ্য চৌধুরী
অষ্টাদশ লোকসভার প্রথম অধিবেশনই বুঝিয়ে দিল ভোটের ফলের তাৎপর্য। বিরোধীরা বলছেন, এবারের লোকসভা ভোট ছিল সংবিধান রক্ষা করার। শাসক দল বিজেপি যা মানতে নারাজ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলছেন, সংবিধান রক্ষার ভোট ছিল ১৯৭৭ সালে। বিজেপি সেই বার্তা দিতেই অষ্টাদশ লোকসভার সূচনায় রাষ্ট্রপতির ভাষণে জায়গা করে দিয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থাকে। ওম বিড়লা ফের স্পিকার নির্বাচিত হওয়ার পরে লোকসভায় দাঁড়িয়ে প্রথম বিবৃতিটিও দিলেন জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে। কিন্তু রাজনীতিতে অপটিক্স তৈরির খেলায় অর্থাৎ জনমানসে ধারণা নির্মাণের ক্ষেত্রে যে এবার বিরোধীরা একইঞ্চি জমি বিজেপিকে ছাড়বে না, তা সংক্ষিপ্ত অধিবেশনেই বেশ স্পষ্ট হল। জরুরি অবস্থার প্রসঙ্গ উত্থাপন বিরোধী ঐক্যে কোনও ফাটল ধরাতে পারল না। বরং ভোটের প্রচারে রাহুলকে সংবিধান হাতে ঘুরতে দেখে ইনডিয়া জোটের যেসব নেতারা আড়ালে মুখ টিপে হাসতেন তাঁরাও হাতে লাল মলাটের সংবিধান নিয়ে সংসদে হাজির।
ভোটের প্রচারে মোদি যখন বলেছেন ‘আব কি বার, চারশো পার’, তখন বিরোধীরা পাল্টা বলেছে ‘মোদি সংবিধান বদলাতে চান’। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ব্যাখ্যা, বিরোধীদের প্রচার সাধারণ ভারতবাসীর হৃদয় ছুঁয়েছে। সংবিধান সংশোধন হলে সংরক্ষণ উঠে যাবে বলে দলিতরা ভয় পেয়েছে। ভারত হিন্দুরাষ্ট্র হয়ে যাবে বলে সংখ্যালঘুরা আতঙ্কিত হয়েছে। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালুর আশঙ্কা করেছে আদিবাসীরা। এইসব ভয়, আতঙ্ক, আশংকা প্রতিফলিত হয়েছে ভোটের ফলে। বিজেপির পরাজয় ঘটেনি সেটা ঠিক। কিন্তু দেশের ভোটাররা যে ক্ষমতার একচেটিয়া কর্তৃত্বকে ভেঙে দিয়েছে, তাও সঠিক। অষ্টাদশ লোকসভার চেহারা, চরিত্র ও মেজাজ সূচনাতেই সেটা ইঙ্গিত করল। সংসদে বিরোধীদের এই দাপট সবসময়ই গণতন্ত্রের পক্ষে শুভ।
অধিবেশনে সবচেয়ে বেশি নজর কেড়েছেন ইনার মণিপুর কেন্দ্রের কংগ্রেস সাংসদ এ বিমল আকোইজম। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে হারিয়ে তিনি লোকসভায় এসেছেন। প্রথম ভাষণেই শোরগোল ফেলে দিয়েছেন দেশে। রাষ্ট্রপতির ভাষণে যথারীতি উল্লেখ ছিল না গত এক বছর ধরে চলতে থাকা মণিপুরের জাতিদাঙ্গার কথা। আকোইজমকে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর বলতে দেওয়া হয়েছিল প্রায় মধ্যরাতে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মধ্যরাতে গণপরিষদে দেওয়া জওহরলাল নেহরুর ‘আ ট্রিস্ট উইথ ডেস্টিনি’ ভাষণ চিরকালীন ভাইরাল। এ বার সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হল লোকসভায় মধ্যরাতে দেওয়া জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের ভাষণ। মধ্যরাতের ভাষণে এল জাতিদাঙ্গায় এক বছরের ওপর আশ্রয় শিবিরে থাকা ৬০ হাজার মণিপুরবাসীর যন্ত্রণা ও উপেক্ষার কথা। কোন জাতীয়তাবাদী চেতনায় মণিপুরের মতো একটি অঙ্গরাজ্যকে সম্পূর্ণ উপেক্ষার চোখে দেখতে পারে বিজেপি, সেই প্রশ্ন তুললেন আকোইজম। তিনি টেনে আনলেন মোদি সরকারের নয়া ফৌজদারি আইন চালু করার প্রসঙ্গ। বললেন, শুধু আইন বাতিল করে ঔপনিবেশিকতাকে মোছা যায় না। ঔপিনিবেশিকতা আসলে একটা মানসিক অবস্থা। যে মানসিক অবস্থা প্রতিভাত হচ্ছে মোদির মণিপুরের সমস্যাকে উপেক্ষা করার মধ্যে দিয়ে। ভাষণের ভিডিও সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর মোদি আর মণিপুর নিয়ে তাঁর মৌনতা রক্ষা করতে পারেননি। অষ্টাদশ লোকসভার প্রথম অধিবেশনেই মণিপুর সমস্যা যেভাবে জাতীয় রাজনীতির কেন্দ্রে চলে এসেছে এবং কেন্দ্রকে চাপে ফেলেছে, তা সংসদের ভিতরে বিরোধীদের রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধিকেই কিন্তু সূচিত করে।
লোকসভার এই অধিবেশনে নজর কেড়েছেন তৃণমূলের সাংসদ মহুয়া মৈত্রও। তাঁকে বহিষ্কারের মধ্যে দিয়ে গত লোকসভায় একটি নজির তৈরি হয়েছিল। রাজনৈতিক মহলের মতে শাসকদলের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ী আদানিকে আক্রমণ করার মূল্য চোকাতে হয়েছিল মহুয়াকে। মহুয়া এবার তাঁর ভাষণ বহিষ্কারের প্রসঙ্গ টেনেই শুরু করেছেন। একজনের কণ্ঠস্বরকে রোধ করতে গিয়ে বিজেপি যে তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে ফেলেছে, গণতন্ত্রের সেই শিক্ষার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন তিনি। অষ্টাদশ লোকসভার প্রথম অধিবেশন বস্তুত দেখল, মহুয়া আরও তীব্রভাবে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারকে আক্রমণ করছেন। মহুয়া যে এবারের লোকসভায় প্রতিমুহূর্তে শাসকদলকে কাঁটার মতো বিঁধবেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
মোদির জমানায় এই প্রথমবার বিরোধী দলনেতা পেয়েছে লোকসভা। বিরোধী দলনেতার চেয়ার বসেই রাহুল গান্ধী আগ্রাসী মনোভাবের পরিচয় দিয়ে দিলেন। শাসক দলের বিরুদ্ধে ঘৃণার রাজনীতির অভিযোগ তুলতে গিয়ে যে রাহুল সংসদের মধ্যে শিবের ছবি আমদানি করে ফেলবেন তা মোদি ব্রিগেডের কল্পনার অতীত ছিল। বিজেপি মহলে এতদিন চালু ধারণা ছিল, তাদের চরম হিন্দুত্বর কাছে রাহুলের নরম হিন্দুত্ব সবসময় পরাস্ত হবে। অযোধ্যার ফলের পর একথা আর জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। প্রথম অধিবেশনেই রাহুল এই সুযোগটির সদ্ব্যবহার করলেন। হিন্দুত্বের ঠিকাদারি যে দেশবাসী আর শুধু বিজেপিকে দিচ্ছে না, লোকসভায় দাঁড়িয়ে সেকথা ঘোষণা করলেন। বিরোধী দলনেতার ভাষণ যে সরকার পক্ষকে ধাক্কা দিয়েছে তা বোঝা গিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সওয়া দু’ঘণ্টার জবাবি ভাষণে। মোদি ‘বালকবুদ্ধি’ বলে কটাক্ষের বাণ ছুড়েছেন বিরোধী দলনেতার দিকে। কিন্তু বিরোধী দলনেতার আক্রমণের যুৎসই জবাব মিলল কি তাঁর ভাষণে? প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক মহলেই।
ভোট যদি হয়ে থাকে সংবিধান রক্ষাকে সামনে রেখে, তাহলে এবারের সংসদও কিন্তু ফিরেছে রাজনীতির গভীর ইস্যুতে। দেশের ভোটাররা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন হিন্দুত্বের ধারণাতেই মতাদর্শের পরিসমাপ্তি ঘটেনি। ভোটাররা বুঝিয়ে দিয়েছেন, মোদিও একটা অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা মাত্র। মানুষের এই রায়ের প্রকৃত প্রতিফলন যেন ঘটল লোকসভার প্রারম্ভিক অধিবেশনে। মণিপুর, কাশ্মীর থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন এলাকার জিতে আসা নানা মতাদর্শের মানুষের কণ্ঠস্বরে যেন ফের সজীব হল গণতন্ত্রের মন্দির।