বিশ্বায়ন ষড় করে আমাদের একইরকম দেখতে-শুনতে করে দিয়েছে কবেই। আমাদের কথা বলার ভঙ্গি, জামাকাপড়, গায়ের গন্ধ, ভালোবাসা কিংবা শত্রুতার সংলাপ– সবই বাঁধা গতে। এই বৃত্তের বাইরেও আসলে কিছু কিছু মানুষ থেকে যায়। যে এখনও তেমন ‘আপডেট’ করে নিতে পারল না নিজেকে। নিজেকে তেমন ‘আধুনিক’ করে তুলতে পারল না। তেমন কেউকেটা হতে পারল না বটে, কিন্তু তাতে চারপাশের প্রতি কোনও ক্ষোভ নেই। অসহিষ্ণুতা নেই। ঈর্ষা নেই। বরং সে এই পৃথিবীখানা আরও একটু নিচু হয়ে বুঝতে চাইছে। এই লিংক-ভরা পৃথিবীতে সে-ই আসলে মিসিং লিংক। সে, আমাদের মানিকবাবু।
কী নিয়ে ঘুমোতে যায় একলা মানুষ? তোশক, বালিশ-বিছানা, পাখার হাওয়া, সারাদিনের ক’টা খুচরো কথা, সারাজীবনের দু’-একটা ব্যক্তিগত আশ্চর্য আবিষ্কার, ঝাল-টক অপমান, চলে যাওয়া কিছু ঝাপসা মুখ, দেওয়াল-বন্ধুরা; টিকটিকি-মাকড়সা-মথ, মৃত ও দেবতার ছবিছাবা। আর যে-উপন্যাস সে বয়ে বেড়াচ্ছে নিজের শরীরে, সে বইয়ের পাতা উল্টে মাঝে মাঝে কয়েকটা অধ্যায় পড়ে নেয়। মিলিয়ে নেয়, সব মনে আছে তো? স্মৃতিই তো তার সবথেকে বন্ধু, সব চাইতে শত্রু। মাঝে মাঝে স্মৃতিকে দিয়ে নতুন করে লিখিয়ে নেয় নানা অধ্যায়। একেবারে ঘুমিয়ে পড়ার আগে এই এক মজার খেলা! হয়নি, কিন্তু হতে পারত যা। আবোল তাবোল চিন্তাই আসলে একলা মানুষের সবথেকে বড় বিছানা। সেখানেই সে হাত-পা-মন ছড়ায়। দূরদূরান্তে যায়। কোনও দূরপাল্লা লাগে না। আড়মোড়া ভাঙে আর স্বপ্ন গড়ে। এছাড়া কী-ই বা আছে এক্কেবারে একলা মানুষের, যদি খিদে-টিদের চিন্তা মোটামুটি মিটে গিয়ে থাকে?
আমি জানি না, মানিকবাবু এরকম কি না। কিন্তু মানিকবাবুকে যখন আমি ‘দ’ হয়ে ঘুমোতে দেখেছি, দেখেছি, তার বিছানায় পড়ে আছে সুকুমার রায়ের ‘আবোল তাবোল’। প্রচ্ছদ খানিক ছেঁড়া। বোঝা যায়, ব্যবহারে জীর্ণ। সেই ‘আবোল তাবোল’-এর সঙ্গে ঘুমনো হয়তো অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। এছাড়া কী আছে মানিকবাবুর বিছানায়? একটা টর্চ, চোখের ড্রপ, পুতুলের ছেঁড়া পা। যে পাশবালিশে পা তুলে ঘুমোচ্ছে সে, সেই অতিপুরাতন তুলোর গ্রন্থনা থেকেও কি একটু-আধটু করে বেরিয়ে আসেনি তুলো? কিংবা মেঘ? তুলোই কি শুধু শুশ্রূষাবান্ধব? মেঘ নয়?
টর্চ থাকতেই পারে বিছানায়। রাত্তিরবেলা আচমকা লোডশেডিং হলে কী হবে! আইড্রপ, তা-ও না হয় নিয়ম করে চোখে দিতে হয়। কিন্তু ‘আবোল তাবোল’ এবং পুতুলের ছেঁড়া পা? এ তো আর সুকুমার রায়ের আহ্লাদে আটখানার মতো একজনকে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়া কোনও অলংকরণ থেকে উঠে আসা নয়, তা নেহাতই পুতুল-শরীরের। যা সম্ভবত শৈশবস্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে। শৈশব– যে-সময় এই নীল রঙের গ্রহের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত বলে মনে হয়, প্রতিটা গলির বাঁকে বিস্ময়ের স্মারক– অচেনা বাড়ি, বারান্দা, গাছপালা, কুকুর-বিড়াল, মানুষজনের। বিস্ময়বোধ জাগে পাখির ডাকে, সাইকেলের ঘণ্টিতে, চেনা-অচেনা ডাকনামে– পুতুলের ওই ছেঁড়া পায়ে সেই শৈশবের একটুকরো মায়াপৃথিবীর ধুলো লেগে আছে। যে পা ধোয়নি। যে ধুলোবালি চলে গিয়েছে মেঘে। সেই পা এখনও হারায়নি। হারায়নি কারণ; ছোট জিনিসের প্রতি মায়া থেকে গিয়েছে। যা শেখানো হয়নি কোনও দিন, শেখাতে পারেনি কোনও পাঠ্যক্রম, প্রশ্নোত্তর, ব্যাকরণ-ট্যাকরণ।
আর ‘আবোল তাবোল’ কেন? প্রাইভেট ‘আবিত্তির স্যর’ মানিকবাবুও ‘মেঘ মুলুকে ঝাপসা রাতে…’ কবিতাটা আওড়েছে আবৃত্তির ক্লাসে। কিন্তু মেঘ কি এই টুকুতেই ছিল? যে মেঘের দেখা সে পেয়েছিল? যে মেঘ চলেছিল তারই সঙ্গে সঙ্গে? ‘আবোল তাবোল’ বইয়ের যে প্রচ্ছদ করে দিয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং সুকুমার রায়, সেখানে ‘আবোল তাবোল’ কথাটা লেখা ছিল কোথায়? মই নিয়ে উঠেছিল একটা লোক, রঙের বালতি বেঁধেছিল মইয়েরই গায়ে, আর রঙের ব্রাশ একহাতে। মইখানা কোনও কিছুরই ভরসায় ছিল না, অথচ পড়েও যায়নি দুম করে। ‘আবোল তাবোল’ লেখাটা সেই বইয়ের প্রচ্ছদে কোনও কাঠের ফ্রেম করা নামপাটায় ছিল না, ছিল মেঘের ওপর লেখা। মানিকবাবুর মেঘ কি এই মেঘের দূর সম্পর্কের আত্মীয় নয়?
পিঁপড়েকে খেতে দেওয়া, রাস্তায় পাতাহীন গাছের পায়ে জল দেওয়া– এরকম আরও কিছু অ-চলিত আজগুবি কাজ মানিকবাবু করে থাকে। তা কি এই রূঢ় বাস্তবের চোখে বড় অবিশ্বাস্য ঠেকে? কোনও বছর বারোর বালক যদি করত এমনটা, তখনও কি এতটাই গোলমেলে ঠেকত? বোধহয় তখন তা মেনে নেওয়া যেত সহজেই। কিন্তু পরিপার্শ্বের প্রতি যে মায়া, তার কি এক্সপায়ারি ডেট বড়জোর ওই বাল্যকাল পর্যন্ত? তা যদি কেউ বহন করে, সারা জীবন বহন করে, তাতে কি দ্রুত ক্ষয় হবে মানবসভ্যতা? তার নামে কি অভিযোগ করা চলে?
মানিকবাবুর মা কীভাবে মারা গিয়েছে, জানি না। তার দেওয়াল-ছবি দেখেছি। বাবাও বার্ধক্যজনিত কারণে, মারা যায়। তবু কেন মনে হয়, ঠিক বার্ধক্য নয়। গান থেমে গিয়েছে, তাই বেঁচে থাকার কোনও কারণ ছিল না আর। জীবন, ছোট গানের ক্যাসেটের মতোই, একদিন ফুরিয়ে যাবেই। কিন্তু মৃত্যুর আগে, জীবনে জড়িয়ে যেতে হবে যে কোনওভাবে। যেভাবে জড়িয়ে যায় ক্যাসেটের রিল, থেমে যায় গান, মারা যায় মানিকবাবুর বাবা– মনে পড়তে পারে সেই আবোল তাবোলের শেষ পঙ্ক্তিও: ‘ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর/গানের পালা সাঙ্গ মোর।’
এই মানিকবাবু আর কোনও কাজে কি তেমন পারদর্শী? সন্দেহ হয়। অফিসে কাজের ফাইল জমছে। কখনও ফাইল আছে, পেপারওয়েট আছে, মানিকবাবু নেই। তার মনকে পাথর চাপা দিয়ে রাখতে পারে, এমন কাজ নেই কোনও। জাগতিক ঐক্যের বোধ আমাদের গতানুগতিক কাজের থেকে মনকে বারবার সরিয়ে নেয়। যদিও গতানুগতিকতায় ফিরে আসতে হয় বেঁচে থাকার স্বার্থেই। মানিকবাবু কি ঘন ঘন সেই জাগতিক ঐক্য টের পায়? হয়তো পায়। নইলে একটা মেঘের টুকরো তাকে ছুটিয়ে বেড়াত না। তার থেকেও বড় কথা, একটা মেঘও পিছু করত না তাকে।
বিশ্বায়ন ষড় করে আমাদের একইরকম দেখতে-শুনতে করে দিয়েছে কবেই। আমাদের কথা বলার ভঙ্গি, জামাকাপড়, গায়ের গন্ধ, ভালোবাসা কিংবা হিংসার সংলাপ– সবই বাঁধা গতে। এই বৃত্তের বাইরেও কিছু কিছু মানুষ থেকে যায়। যে এখনও তেমন ‘আপডেট’ করে নিতে পারল না নিজেকে। নিজেকে তেমন ‘আধুনিক’ করে তুলতে পারল না। তেমন কেউকেটা হতে পারল না বটে, কিন্তু তাতে চারপাশের প্রতি কোনও ক্ষোভ নেই। অসহিষ্ণুতা নেই। ঈর্ষা নেই। বরং সে এই পৃথিবীখানা আরও একটু নিচু হয়ে বুঝতে চাইছে। এই লিংক-ভরা পৃথিবীতে সে-ই আসলে মিসিং লিংক। হাওয়া গায়ে লাগলে আনন্দ পাচ্ছে। গাছে ফুল ফুটলে আনন্দ পাচ্ছে। একটা মেঘ দেখলে আনন্দ পাচ্ছে। বাবা-মা কেউ নেই, তিনকূল ফাঁকা চরাচর। কিন্তু সে বুঝেছে, যার কেউ নেই, তার মেঘ আছে। ছাদ সেই মৌলিক স্থান, যেখানে দেখা হতে পারে দু’জনের। ছাদ, যা বাড়ির না আকাশের অংশ– এই তর্ক মানুষের পৃথিবীতে কোনও দিন মিটবে না। তবু, মানিকবাবুর এই শহরের বুকে একটা ছাদ চাই-ই চাই। মেঘকে সে ছুঁতে চায়, তবে ৬৫ তলার কোনও হাইরাইজের মাথায় উঠে নয়। সে ছুঁতে চায় ঘুড়ি দিয়ে। এই-ই তার কথোপকথন। সে তখন শুভঙ্কর, মেঘ-ই নন্দিনী। একটা ঘুড়ি-সুতো তার হাতেরই এক্সটেনশন।
কী হল মানিকবাবুর, এই ‘মানিকবাবুর মেঘ’ সিনেমায়, তা আপনারা দেখতেই পাবেন, যদি ছবিখানা দেখেন। কিন্তু কী হল সেই মানিকবাবুর, যে মানিকবাবু আপনার মধ্যে ছিল? তাকে অনেক দিন ‘আবোল তাবোল’ পড়াননি, ‘আবোল তাবোল’ ভাবাননি, অনেক দিন ওঠাননি ছাদে। যান, মেঘ দেখুন। ক্লাউড স্টোরেজ কিংবা সাউন্ড ক্লাউড না– আপনার কিংবা মানিকবাবুর মেঘ।