নেলসন ম্যান্ডেলাকে নিয়ে পৃথিবী জুড়ে এত উন্মাদনা, এত সমর্থন, তাহলে সোয়েতো-র সেই বৃদ্ধের গলায় শেষমেশ এত হতাশার সুর লেগেছিল কেন? কেন ওঁর মনে হয়েছিল এখনকার ছেলেমেয়েরা বুঝে উঠতে পারছে না ম্যান্ডেলাকে? যতবারই ভেবেছি এই নিয়ে, মনে হয়েছে নিশ্চয়ই ওঁর ধারণায় কোনও ভুল ছিল। শেষমেশ চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জনের আশায় আমারই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করি। ওদের কাছে জানতে চাই ওদের ম্যান্ডেলার বিষয়ে মতামত। কতটা প্রাসঙ্গিক নেলসন এদের কাছে? যেসব উত্তর পেয়েছি ওদের থেকে, তা খুবই জোরালো এবং যুক্তিগ্রাহ্য।
সকালে ইউনিভার্সিটি আসার পথে আমার অফিশিয়াল মেল আইডিতে একটি মেল আসে। সাবজেক্টে লেখা আছে ‘Mandela Day- A Call to Action’. মেলের বিষয়বস্তু খানিকটা এরকম: “This year’s Nelson Mandela International Day will be celebrated under the theme: It’s still in our hands to combat poverty and inequity”. ‘Mandela Day’, অর্থাৎ নেলসন ম্যান্ডেলার জন্মদিন, ১৮ জুলাই, ১৯১৮। মন আটকে গেল ‘Still’ শব্দটায়। তাহলে কি সমস্যাগুলো ক্রমাগত হাতের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে?
গবেষণা সূত্রে সাউথ আফ্রিকা আসার সুযোগ যখন আসে, আমার এক বন্ধু বলেছিল, ‘নেলসন ম্যান্ডেলার দেশে যাচ্ছিস তাহলে এবার? শুনেছি ওঁর বাড়িটা নাকি এখন মিউজিয়াম করা হয়েছে। গান্ধীজিও নাকি থেকেছেন ওই বাড়িতে কয়েক দিন। যাস একবার ওঁর বাড়িটা দেখতে, ছবি পাঠাস প্লিজ।’ ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলাম। তারপর সাউথ আফ্রিকা পৌঁছে প্রথম কয়েক দিন কেটে যায় এখানকার অফিশিয়াল কাজকর্মে। নতুন শহর, নতুন বাসস্থান। গুছিয়ে উঠতে কয়েক দিন চলে গেল। ইতিমধ্যেই কর্মক্ষেত্রে সবাই সতর্ক করে দিলেন, রাস্তায় দুপুরের পর একা না হাঁটাই ভালো। প্রথমে খুব একটা আমল দিইনি। এর কয়েক দিনের মধ্যেই ইউনিভার্সিটির গেটের বাইরে খুন হলেন এক ট্যাক্সি ড্রাইভার। ঘটনাটি ঘটে দুপুর দুটো নাগাদ। ট্যাক্সি চালকদের নিজেদের নাকি গ্যাংওয়ার। সতর্ক হলাম খানিক। সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানলাম পেটের দাবিতেই স্থানীয় লোকেদের কিছু অংশ এই চুরি-ছিনতাই-খুনোখুনির পথ বেছে নিয়েছে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিহ্ন ছড়িয়ে রয়েছে গোটা শহরের আনাচেকানাচে।
এই ঘটনার দিনই ইউনিভার্সিটির এক ভারতীয় অধ্যাপকের সঙ্গে আলাপ হয়। বন্ধুত্বও হয়ে যায় তাড়াতাড়ি। পল্লবদা। বরানগরে বাড়ি। এখানে পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপক পদে কর্মরত। পল্লবদার উদ্যোগেই এক শনিবার আমরা বেরিয়ে পড়ি সোয়েতো-র উদ্দেশ্যে। ‘South Western Township’, সংক্ষেপে ‘Soweto’। এখানকার মূল আকর্ষণ নেলসন ম্যান্ডেলার বাড়ি। ম্যান্ডেলা তাঁর আত্মজীবনী ‘Long walk to Freedom’-এ লিখেছেন, ‘That night I returned with Winnie to No.8115 in Orlando West. It was only then that I knew in my world, the place marked with an X in my mental geography.’ সারা বছর ধরে এই বাড়ি দেখতে ভিড় করেন দেশবিদেশের পর্যটক। গাড়ি নিয়ে বাড়িটার কাছাকাছি পৌঁছতেই দেখলাম একদল যুবক গাড়ির সামনে এসে ভিড় করেছে তাঁদের হেফাজতে আমাদের গাড়ি পার্ক করার জন্য। এটাই তাঁদের রোজগারের মাধ্যম। সেসব পেরিয়ে আরেকটু এগোতেই চোখে পড়ল বেশ কিছু ছোটখাটো খাবারের দোকান, জামাকাপড়ের দোকান বসেছে এই বাড়ির চারপাশে। অজস্র পর্যটক টিকিট কেটে লাইন দিয়েছেন ভেতরে ঢোকার। সেই লাইন দেখে সে যাত্রায় আমাদের আর বাড়ির ভেতরে যাওয়া হয়নি। গাড়িতে করেই ঘুরে দেখছিলাম এই জনপদ। বুঝতে পারছিলাম নেলসন ম্যান্ডেলার এই বাড়িই বাঁচিয়ে রেখেছে এখানকার অনেক মানুষের জীবন। তাঁকে ঘিরে বিশ্বব্যাপী যে উন্মাদনা, সেই পুঁজিতে ভর করেই এখানকার বেশ কিছু মানুষ তাঁদের জীবনজীবিকা নির্বাহ করছেন। ফেরার পথে এক স্থানীয় বৃদ্ধ ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয়। তাঁর মতে, নেলসন ম্যান্ডেলাই প্রথম বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছিলেন বছরের পর বছর ধরে কৃষ্ণাঙ্গদের নিগৃহীত হওয়ার নৃশংস ইতিহাস। বৃদ্ধ আরও বলেন, ‘He spent 27 years in prison for leading the African National Congress, which opposed apartheid policies that kept us segregated often in inhuman conditions. He is our father figure (Utata uNelson Mandela)’. বলতে বলতে উচ্ছ্বাসে বুজে আসছে বৃদ্ধের গলা। সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে খানিক জিরিয়ে নিয়ে আবার শুরু করলেন। তবে এবারে যেন গলায় খানিক আক্ষেপের সুর। বললেন ওঁর বাড়ির বসার ঘরে তিনি রেখেছেন ম্যান্ডেলার একটি আবক্ষ ছবি। এখনকার ছেলেমেয়েরা নাকি ম্যান্ডেলার এই অবদান ঠিকমতো উপলব্ধিই করে উঠতে পারে না। ‘they sometime in their conversation call him just Nelson Mandela. No! That is disrespectful. He is Utata uNelson Mandela’.
কিন্তু এই যে এত উদযাপন, পৃথিবী জুড়ে এত উন্মাদনা, এত সমর্থন, তাহলে সোয়েতোর সেই বৃদ্ধের গলায় শেষমেশ এত হতাশার সুর লেগেছিল কেন? কেন ওঁর মনে হয়েছিল এখনকার ছেলেমেয়েরা বুঝে উঠতে পারছে না ম্যান্ডেলাকে? যতবারই ভেবেছি এই নিয়ে, মনে হয়েছে নিশ্চয়ই ওঁর ধারণায় কোনও ভুল ছিল। শেষমেশ চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জনের আশায় আমারই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলা শুরু করি। জানতে চাই ওদের ম্যান্ডেলার বিষয়ে মতামত। কতটা প্রাসঙ্গিক নেলসন এদের কাছে? যেসব উত্তর পেয়েছি ওদের থেকে, তা খুবই জোরালো এবং যুক্তিগ্রাহ্য। সাইকোলজি বিভাগের এক ছাত্রী জানায়, ছোট থেকে বাবা-মায়ের কাছে ম্যান্ডেলার গল্প শুনে বড় হয়েছে সে। খানিকটা সেই সুবাদেই সে ম্যান্ডেলাকে সম্মান করে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার বন্ধুটির মতামত– ম্যান্ডেলা সাউথ আফ্রিকার মানুষকে রাজনৈতিক স্বাধীনতা হয়তো দিতে পেরেছিলেন, কিন্তু অর্থনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্নে সেভাবে সাফল্য লাভ করেননি। এখনও এদেশের অধিকাংশ জমিজমা শ্বেতাঙ্গদের দখলে। খানিক অভিযোগের সুরেই ছেলেটি জানায়, ম্যান্ডেলা হয়তো আরও একটু বেশি জোর দিতে পারতেন জমিজমা ও টাকা-পয়সার সমবণ্টনের দিকে। তার মতে, প্রাথমিকভাবে যে তৎপরতা ও উদ্যোগ ছিল নেলসনের কর্মকাণ্ডে, তা হয়তো খানিক ভাটা পড়েছিল আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে। অথচ বিজ্ঞান বিভাগের এক ছাত্রের কাছে পেলাম কিছুটা অন্যরকম মতামত। সে বলছে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এপার্থেইডকে নিঃশেষ করার জন্য যতটা ম্যান্ডেলার পক্ষে সম্ভব ছিল, তিনি করেছেন। কৃষ্ণাঙ্গ শিশুদের ‘বেসিক এড্যুকেশন পলিসি’তে উন্নতি সাধন, অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া পরিবারের জন্য সোশ্যাল গ্রান্টের ব্যবস্থা– এ সবকিছু প্রাথমিকভাবে সম্ভব হয়েছিল ম্যান্ডেলার জন্যই। পরবর্তীতে হয়তো এগুলো জারি রাখা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের ২০২২ সালের রিপোর্ট বলছে, সাউথ আফ্রিকার মোট সম্পত্তির প্রায় ৮০% কুক্ষিগত রয়েছে মোট জনসংখ্যার মাত্র ১০%-এর হাতে। এই সংখ্যালঘুদের অধিকাংশই নাকি শ্বেতাঙ্গ। তাহলে কি চোরাস্রোতের মতো এখনও রয়ে গেছে বর্ণবৈষম্যের কঠিন ব্যামো? ২০২৪-এ দাঁড়িয়ে কতটা সার্থক ম্যান্ডেলার দীর্ঘ লড়াই? আগামী প্রজন্ম কি সত্যিই মনে রাখবে এই ‘ম্যান্ডেলা ম্যাজিক’? কী বলে সম্বোধন করবে তাঁরা? শুধুই Nelason Mandela? না কি Utata uNelson Mandel?