বোদলেয়ার পাপের বোঁটায় ফুল ফোটাতে চেয়েছেন । মাতাল ভিক্ষুক বারবণিতা দারিদ্রের নোংরামির মধ্যে সুন্দরের সন্ধান করেছেন।তার আগে এই সন্ধানের এমন সুন্দর প্রকাশ কেউ করতে পারেনি। মধুসূদনের আগেও কেউ ভাবতেই পারেনি যে রাম দেবতা নন, আগ্রাসনকারী এক ব্যক্তি মাত্র। তিনি কখনও নায়ক হতে পারেন না। নায়ক হবেন দেশপ্রেমিক মেঘনাদ বা বীর্যবান রাবণ। এই ভাবনার মুকুলগুলোই তো এখন ১৫০ বছর পরে ফুলে ফলে পরিণত হয়ে কবিদের ভাবনার স্তরকে উন্নীত করেছে। বিনির্মাণে এগিয়ে দিয়েছে। সময়ের থেকে এগিয়ে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে চলেন এঁরা। ভাবনায় বিপ্লব আনেন। কিন্তু হায়! সমকাল তাঁদের চিনতে পারে না! দুজনের ভাগ্যাকাশেই ধূসর ফ্যাকাসে মলিন আলো।
দুই দেশের দুই কবি। দুই সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল, সামাজিক আবহাওয়া, রাজনৈতিক জলবায়ু, প্রাকৃতিক বৈচিত্র। একজনের দেশে নবজাগরণের সলতে পাকানোর কাজ চলছে। অন্যজনের দেশ নবজাগরণের প্রজ্জ্বলিত শিখার উত্তুঙ্গ আলোয় আলোকিত। এক জনের জন্মভূমি সজল-সঘন তরুলতাময় বাংলাদেশ, অন্যজনের মাতৃভূমি সুগন্ধি নীল আকাশের প্যারিস। প্যারিসের কবির জন্মসাল ১৮২১, বাংলাদেশের কবির জন্মসাল ১৮২৪। একজনের জন্মের দ্বিশতবর্ষ চলছে। অন্যজনের সেটা অতিক্রান্ত। আগামী ৩১ আগস্ট তাঁর প্রয়াণ দিবস। একজন মহাকবি, অন্যজন প্রথম দ্রষ্টা, কবিদের রাজা, সত্য দেবতা। একজন মুক্তি দিলেন ছন্দকে– অমিত্রাক্ষরে। অন্যজন মুক্তি দিলেন যা কিছু কবিতা নয় তার থেকে কবিতাকে। দু’জনেই স্বভাবনার ঐশ্বর্যে ভাঙলেন প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে। ফ্রান্সের কবি শার্ল বোদলেয়ার অসুন্দরের মধ্যে সৌন্দর্য ফুটিয়ে তুললেন প্রতিটি কবিতায়। কলকাতার কবি অসুর বা রাক্ষসের অর্থাৎ অসুন্দর বা অসংস্কৃতের বর্ণনায় সৌন্দর্য ঢেলে দিলেন কাব্যগাথায়। মধুসূদন লিখলেন মেঘনাদবধ কাব্য। প্রচলিত ধারণা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে ভাবনার ওলটপালট করে দিলেন। ফ্রান্সের কবি শার্ল বোদলেয়ার একই ভাবে চিন্তার জগতে তোলপাড় ফেলে লিখলেন ‘লে ফ্ল্যর দ্যু মাল’– ‘ফ্লাওয়ার অফ ইভিল’– পাপের ফুল। বুদ্ধদেব বসু অনুবাদ করেছেন ‘ক্লেদজ কুসুম’। দু’জনেই অ-শিবে সৌন্দর্য খুঁজেছেন।
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তর জন্মের দ্বিশতবর্ষে আর একই সময়ের কবি শার্ল বোদলেয়ারের ২০৩তম জন্মবার্ষিকীতে দু’জনের কাব্যে-কবিতায়, মননে-গঠনে, ভাবে-বোধে চিন্তন প্রক্রিয়ায় এবং যাপন প্রণালীর সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা এই একুশ শতকে। দুই কবির কাব্যভাবনার কাছে ঋণী কবিতাজগৎ। বিনির্মাণের পথে এগোয় নতুন প্রজন্ম পুরাতনকে সামনে রেখে।
দুই কবির যাপনকাল সময়ের নিরিখে খুব কাছাকাছি। যাপনচিত্রেও ব্যবহারিক মিল আশ্চর্য করে। ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এর কবির শৈশব কৈশোর এবং যৌবনের লক্ষ্য যেমন ছিল সাহিত্যচর্চা, বোদলেয়ারেরও তাই। দু’জনেই কোনও এক সময় পিতার সম্পত্তিতে অধিকার পাননি, আবার দু’জনেই কোনও এক সময়ে প্রভূত সম্পত্তির অধিকারী হয়েছেন। আবার দু’জনেই অমিতব্যয়িতা আর বিলাসিতায় কপর্দকশূন্য হয়েছেন। হয়েছেন ঋণজর্জর। পাওনাদারের তাগাদায় দু’জনেরই সৃষ্টির মনন হোঁচট খেয়েছে, বিষণ্ণ হয়েছে। বিষাদ এসেছে তাঁদের সৃষ্টির পরতে।
তবে দু’জনেরই বিলাসিতাকে কেবল স্থূল বিচার করলে চলবে না, আসলে দু’জনেরই রুচির সূচক এতটাই উত্তুঙ্গ যে, সাধারণের বিচারে সেটা বিলাসিতা মনে হলেও আসলে তাঁদের পরিশীলিত রুচির পরিচয় ফুটে ওঠে তাদের অন্দরসজ্জায়, গৃহসজ্জায়, পোশাকে প্রভৃতি ক্ষেত্রে। দৈনন্দিনতাকে নান্দনিকতায় উত্তীর্ণ করা একটা শিল্পকলা আর এতে দু’জনেই সিদ্ধকাম। অবশ্যম্ভাবী পরিণাম দারিদ্র। আর কী আশ্চর্য দারিদ্রকে আলিঙ্গন করেই সৃষ্টির সাগরে ডুব দিয়েছেন দু’জনেই। আসলে দু’জনেই শ্রেষ্ঠত্বের পূজারী। সে কাব্যচর্চায় হোক বা জীবনচর্যায়। আপসবিহীন সে সাধনা। দুঃখের সাধনায় জয়ী হওয়াও ছিল দু’জনেরই ভবিতব্য।
মধুসূদন প্রচলিত ধারণায় পুরুষোত্তম সুদর্শন আর্যপুত্র রামকে নায়ক করলেন না তাঁর কাব্যে। বীভৎস দর্শন রাক্ষসরাজ রাবণ, মেঘনাদ তাঁর নায়ক-সহ নায়ক হলেন। বাল্মিকী যে রাবণদের জন্য কেবল বীভৎস রস বরাদ্দ করেছিলেন, মধুসূদন তাঁদেরই জন্য উপুড় করে দিলেন বীররসের কলস। করুণ রসে সিক্ত করলেন বীরবাহু-মেঘনাদ-রাবণের দেশের জন্য আত্মত্যাগের মহত্ব। তাঁদের নায়কোচিত সৌন্দর্য সুষমায় মণ্ডিত করলেন। যেন মনে হল, বাংলা সাহিত্যের কাব্যমণ্ডলে তীব্র শীতে দখিনা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। আর ওদিকে, বোদলেয়ার বললেন কোনও কোনও কবি বহুকাল ধরে কাব্যজগতের পুষ্পল প্রদেশগুলোকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। আমি কিন্তু পাপ থেকেই নিংড়ে বের করেছি সৌন্দর্য। তাই তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম হয় পাপের ফুল। আর মধুসূদনের মহাকাব্যের নাম হয় মেঘনাদবধ কাব্য। চিন্তন মননের এই মিল পাই দুই দেশের দুই কবির মধ্যে। সময়টা একই উনিশ শতকের মধ্যভাগ। কী আশ্চর্যজনক এই সমাপতন। একজন প্যারিসের। একজন কলকাতার।
……………………………………………………………………………………………..
দু’জনেরই বিলাসিতাকে কেবল স্থূল বিচার করলে চলবে না, আসলে দু’জনেরই রুচির সূচক এতটাই উত্তুঙ্গ যে, সাধারণের বিচারে সেটা বিলাসিতা মনে হলেও আসলে তাঁদের পরিশীলিত রুচির পরিচয় ফুটে ওঠে তাদের অন্দরসজ্জায়, গৃহসজ্জায়, পোশাকে প্রভৃতি ক্ষেত্রে। দৈনন্দিনতাকে নান্দনিকতায় উত্তীর্ণ করা একটা শিল্পকলা আর এতে দু’জনেই সিদ্ধকাম। অবশ্যম্ভাবী পরিণাম দারিদ্র। আর কী আশ্চর্য দারিদ্রকে আলিঙ্গন করেই সৃষ্টির সাগরে ডুব দিয়েছেন দু’জনেই। আসলে দু’জনেই শ্রেষ্ঠত্বের পূজারী। সে কাব্যচর্চায় হোক বা জীবনচর্যায়। আপসবিহীন সে সাধনা। দুঃখের সাধনায় জয়ী হওয়াও ছিল দু’জনেরই ভবিতব্য।
……………………………………………………………………………………………..
ফ্রান্সে বোদলেয়ার ঈশ্বরের প্রতি বীতরাগ। কাঠগড়ায় দাঁড় করান তিনি ঈশ্বরকে। প্রশ্ন করেন। সেজন্য তাঁর ছ’টি কবিতা দণ্ডিত হয়। আর কলকাতায় মধুসূদন বলছেন, ‘I despise Ram and his rabble but the idea of Ravan kindles my imagination, he is a grand fellow.’ মধুসূদনও সাগ্রহে গৃহীত হননি তখন। যথেষ্টই নিন্দিত হয়েছিলেন। বোদলেয়ার পাপের বোঁটায় ফুল ফোটাতে চেয়েছেন। মাতাল ভিক্ষুক বারবণিতা দারিদ্রের নোংরামির মধ্যে সুন্দরের সন্ধান করেছেন। তাঁর আগে এই সন্ধানের এমন সুন্দর প্রকাশ কেউ করতে পারেননি। মধুসূদনের আগেও কেউ ভাবতেই পারেনি যে রাম দেবতা নন, আগ্রাসনকারী এক ব্যক্তি মাত্র। তিনি কখনও নায়ক হতে পারেন না। নায়ক হবেন দেশপ্রেমিক মেঘনাদ বা বীর্যবান রাবণ। এই ভাবনার মুকুলগুলোই তো এখন ১৫০ বছর পরে ফুলে ফলে পরিণত হয়ে কবিদের ভাবনার স্তরকে উন্নীত করেছে। বিনির্মাণে এগিয়ে দিয়েছে। সময়ের থেকে এগিয়ে সমাজকে এগিয়ে নিয়ে চলেন এঁরা। ভাবনায় বিপ্লব আনেন। কিন্তু হায়! সমকাল তাঁদের চিনতে পারে না! দু’জনের ভাগ্যাকাশেই ধূসর ফ্যাকাসে মলিন আলো।
একজন ফ্রান্সে বসে যেমন ভাবছেন লিখছেন, অন্যজন কলকাতায় বসে তেমন ভাবনার স্রোতেই খেয়াতরী ভাসাচ্ছেন। এছাড়াও দুই কবির মনের ঐশ্বর্য বেশি তাই দ্বন্দ্বও বেশি। দু’জনেরই ছিল তীব্র আত্মবিশ্বাস। ভাবীকাল যে তাঁদের মনে রাখবেই– এ দৃঢ় বিশ্বাস দু’জনেরই ছিল। আর বিশ্বাসে যে কোনও ভুল ছিল না এখন তাদের জন্মের দ্বিশতবর্ষ পার করেও তাঁদের স্মরণ সেই প্রমাণ। মধুসূদন বন্ধু গৌরদাস বসাককে অনুরোধ করছেন আমি বিখ্যাত হলে আমার জীবনী লিখবে। অমিত্রাক্ষর ছন্দ একদিন সব কবি আয়ত্ত্ব করতে চাইবে। পড়ো পড়ো বেশি করে পড়ো । বুঝবে কী ঐশ্বর্য এতে লুকিয়ে আছে। গ্রানাইট পাথরের মতো শক্তপোক্ত জোর নিজের প্রতিভার ওপর! বোদলেয়ার তাঁর মা-কে চিঠিতে লিখছেন, আমার মনের গতি জনপ্রিয়তায় নয়, তাই অর্থোপার্জন অল্পই হবে। কিন্তু বিরাট খ্যাতি রেখে যাব সন্দেহ নেই, যদি শুধু বেঁচে থাকার মতো সাহস জোটে। দুই কবির মনের গহীনে একই ফল্গুধারা।
বোদলেয়ার সেই কবি যাঁর হাত ধরে আধুনিক কবিতা পেয়েছে প্রাসাদ। তিনি অবশ্য শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন সস্তার এক নার্সিং হোমে। তাঁর শেষযাত্রায় পঞ্চাশজন মানুষও আসেননি। এমনকী, যাঁকে ফ্লাওয়ার অফ ইভিল উৎসর্গ করেছিলেন সেই স্যাৎ ব্যাভোঁ-ও নয়। আর কলকাতায় মধুসূদনের শেষশয্যার নিদারুণ অবস্থা– কপর্দকহীন স্বজনহীন। কবরের স্থান পেতেও বেগ পেতে হয়েছিল। বোদলেয়ার চলে যান ১৮৬৭-তে ৪৬ বছর বয়সে আর মহাকবির মহাপ্রয়াণ ১৮৭৩-এ । ৪৯ বছর বয়সে। মধুসূদন বোদলেয়ারের থেকে তিন বছরের ছোটো ছিলেন।
মধুসূদনের বাবা চেয়েছিলেন ছেলে ইংরেজি শিখলে তাঁর নিজের ওকালতি ব্যবসায় উন্নতি হবে আর সমাজে প্রতিপত্তিও হবে। তাই ছেলেকে হিন্দু কলেজে পাঠান। কিন্তু তিনি যে মধুসূদন! কেজো ইংরেজি শিখে ক্ষান্ত হওয়ার পাত্র তিনি নন। তিনি ইংরেজি সাহিত্যে ডুব দিলেন। আর সাঁতরে ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার মতো ইউরোপীয় সাহিত্যকে আত্মস্থ করে তা দিয়েই বাংলা ভাষা সাহিত্যকে একটা মর্যাদায় পৌঁছে দিলেন।
………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়-এর লেখা: এপ্রিলের বর্ণনায় রবীন্দ্রনাথ রোমান্টিক, এলিয়ট নিষ্ঠুরতম
………………………………………………………………………………….
ওদিকে কী আশ্চর্য! কিশোর বোদলেয়ারের যখন কিছুতেই কোনও কিছুতে মন বসছে না তখন তাঁর সৎপিতা তাঁকে কলকাতাগামী একটি জাহাজে তুলে দেন।কলকাতায় এসে যা হোক কিছু করে নিজের পেট চালাতে পারবে এই আশায়। কিন্তু তিনি বোদলেয়ার! আধুনিক কবিতার নির্মাণকর্তা। মরিশাসে পৌঁছে জাহাজ ভেঙে যায়। মেরামতির জন্য কিছু সময় লাগল। তিনি গোঁ ধরলেন। কলকাতা যাবেন না। জাহাজ থেকে নেমে রয়ে গেলেন ওই দ্বীপে। কিছুদিন পরে প্যারিস ফিরে যান। এলে হয়তো কলকাতার বুকে দুই সাইক্লোনের দেখা হত। তাঁর নাকি ইচ্ছা ছিল প্রাচ্য ভারতবর্ষকে নিয়ে কবিতা লিখবেন। আর আমাদের কবি চেয়েছিলেন পাশ্চাত্যের কবিদের মতো কবি হবেন। ভাবনার কী মিল ও পরিহাস! আবার আমাদের মধুসূদন যখন ভার্সাই নগরীতে দীনহীন দিনগুলি কাটাচ্ছেন আর সনেট রচনায় শান দিচ্ছেন তখন অনতিদূরের নগরী প্যারিসে বোদলেয়ার একের পর এক চিত্রকলার সমালোচনার প্রবন্ধ লিখছেন, বিতৃষ্ণা ও আদর্শ, প্যারিস চিত্র, মদ, মৃত্যু, প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ লিখে যাচ্ছেন।
ফ্রান্সের আকাশে দুই কবির কাব্যভাবনা ডানা মেলেছে কিন্তু দুই পাখি কখনও মুখোমুখি হয়নি। আজ আমরা দু’জনের মুখোমুখি। পৃথিবীর দুই প্রান্ত এসে মিলেছে তাঁদের সৃষ্ট শব্দে ছন্দে বোধে রসে সুষমায় ঐশ্বর্যে এবং অবশ্যই কাব্য আর জীবনবোধের মৌলিক দর্শনে। গ্রেট মেন থিংক অ্যালাইক– প্রবাদটি প্রয়োগ করা যায় এক্ষেত্রে।
…………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………….
মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত আর শার্ল বোদলেয়ার– দুই দেশের দুই কবি– ভাবের ঘরে পড়শি। ২০০ বছর একটা সংখ্যা মাত্র। আসলে তাঁদের এই সাযুজ্যে আমরা বিহ্বল হয়ে পড়ি। তাঁদের অন্তর্লীন জীবন ও কাব্য দর্শনের কাছে নতজানু হই। নতুন হওয়ার চেষ্টা করি।