বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটার পরিমাণ ৫৬ শতাংশ, এর ৩০ ভাগই মুক্তিযোদ্ধা কোটা। বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধাই এখন বেঁচে নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছর পরেও পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি। রাজনৈতিক পরিচয়ে মুক্তিযোদ্ধার সনদ বিক্রি হয়েছে, তালিকায় থাকা অন্তত সাড়ে ৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্ম ১৯৭১ সালের পরে! এমন অসম্ভবকেও সম্ভব করা হয়েছে। আবার অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নামই ওঠাননি। কোটায় মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা এতদিন চাকরি পেয়েছেন, এখন বংশানুক্রমে নাতি-নাতনিদেরও সেই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য কোটাতেও দুর্নীতির শেষ নেই। মূলত সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের ছেলে-মেয়েদের প্রশাসনে ঢোকানোর জন্যই এই ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
স্বাধীন বাংলাদেশের বয়স প্রায় ৫৪ বছর, অথচ শোষণ-বঞ্চনা থেকে এ দেশের মানুষ মুক্তি পায়নি এখনও। সঙ্গে রয়েছে দুর্নীতির মহোৎসব। যে যায় লঙ্কায় সে-ই যেন রাবণ হয়, প্রজাতন্ত্রের মালিক বনে যায়, রাক্ষসের রূপ ধারণ করে। ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে কুৎসিত রাজনীতির খেলা খেলে।
বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সবচেয়ে গৌরবময় ইতিহাস ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিপক্ষে মুক্তির সে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামি লিগ ‘মুক্তিযুদ্ধ’-কে রাজনীতির মাঠে এতই অপব্যবহার করেছে যে, গৌরবের মুক্তিযুদ্ধ এখন তরুণ প্রজন্মের কাছে নিষ্পেষণের নাম হয়ে গিয়েছে। সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থায় মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করা হয় খুবই অন্যায্যভাবে।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটার পরিমাণ ৫৬ শতাংশ, এর ৩০ ভাগই মুক্তিযোদ্ধা কোটা। বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধাই এখন বেঁচে নেই। দেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছর পরেও পূর্ণাঙ্গ তালিকা হয়নি। রাজনৈতিক পরিচয়ে মুক্তিযোদ্ধার সনদ বিক্রি হয়েছে, তালিকায় থাকা অন্তত সাড়ে ৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধার জন্ম ১৯৭১ সালের পরে! এমন অসম্ভবকেও সম্ভব করা হয়েছে। আবার অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নামই ওঠাননি। কোটায় মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরা এতদিন চাকরি পেয়েছেন, এখন বংশানুক্রমে নাতি-নাতনিদেরও সেই সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য কোটাতেও দুর্নীতির শেষ নেই। মূলত সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের ছেলে-মেয়েদের প্রশাসনে ঢোকানোর জন্যই এই ৫৬ শতাংশ কোটা ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
প্রতি বছর অন্তত ৪ লাখ যুবা গ্র্যাজুয়েট হয়, বিপরীতে সরকারি চাকরির পোস্ট থাকে মাত্র হাজার তিনেক। এই তিন হাজার পদের মধ্যে মাত্র ৪৪ শতাংশ সাধারণ ছাত্রদের জন্য। এই বৈষম্যের জন্য দীর্ঘদিন যাবৎ ছাত্রদের ভিতরে অসন্তোষ ছিল। তবে তারা কখনও কোটা বাতিল চায়নি, যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছে। ২০১৮ সালে প্রথম কোটা সংস্কারের জন্য বড় আন্দোলন হয়। পুলিশ আর ছাত্রলিগ দিয়ে সেই আন্দোলন দমাতে না পেরে সংসদে চাকরিতে কোটার বিলুপ্তি ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পরে প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়। এর বিরুদ্ধে সরকারের মদতপুষ্ট ৩০% মুক্তিযোদ্ধা কোটার পক্ষে থাকা একটি সংগঠন আদালতে যায়। সর্বোচ্চ আদালত এ বছর জুলাইয়ের শুরুতে ৫৬% কোটা পুনর্বহাল করে রায় দেয়। ছাত্ররা আবার কোটা সংস্কার চেয়ে আন্দোলনে নামে।
১৪ জুলাই এক সাংবাদিক সম্মেলনে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ বলে গালি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।। ‘রাজাকার’ বাংলাদেশে অত্যন্ত ঘৃণ্য একটি গালি। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে এদেশের যারা সহায়তা করেছিল, তাদেরকেই ‘রাজাকার’ বলা হয়।
অন্তত ৯৯ শতাংশ ছাত্র চাকরিতে বিদ্যমান কোটাব্যবস্থার সংস্কার চায়। প্রধানমন্ত্রী ৯৯ শতাংশকেই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বানিয়ে দেন। ফলে ছাত্ররা ফুঁসে ওঠে আর সেই রাতেই হল থেকে বেরিয়ে ‘আমি কে তুমি কে রাজাকার রাজাকার/ কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’; ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকে। রাতেই প্রতিটি ক্যাম্পাসে দাবানলের মতো ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ১৫ জুলাই সকাল থেকে পুলিশ আর হেলমেট পরে অস্ত্রধারী ছাত্রলিগ নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবু সাইদ-সহ সারাদেশে ৭ ছাত্র নিহত হন। আহতদের ওপর হাসপাতালে গিয়েও হামলা করার ঘটনা ঘটেছে। ওইদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সাজোঁয়া যান-সহ পুলিশ আর বহিরাগত সন্ত্রাসীরা ঢুকে ছাত্রদের ওপর হামলা করে, যেন ছাত্রাবাস খালি হয়ে যায়। এতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদেরকে সহায়তা করে। কিন্তু ছাত্ররা সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-সহ স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও আন্দোলনে যোগ দেয়। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি খালি করতে না পেরে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ছাত্ররা এ সিদ্ধান্ত মানেনি। ফলে পুলিশের সঙ্গে এবার বিজিবি নামানো হয়, ঢাকা, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাতের অন্ধকারে হাজার হাজার রাউন্ড গুলি ছুড়েও ছাত্রাবাস খালি করা যায়নি। ছাত্ররা উল্টো হলে হলে ছাত্রলিগ নেতাদের কক্ষ গুঁড়িয়ে দেয়। মৃত্যুভয়কে জয় করে ১৮ তারিখ ব্যাপক ছাত্র অভ্যুত্থান হয়। এদিন নির্বিচারে গুলি চালানো হয়, ছাত্ররাও প্রতিরোধ শুরু করে, সারাদেশে ৩২ জন প্রাণ হারান।
এদিন সন্ধ্যা থেকে বাংলাদেশকে সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয় সরকার। সকল প্রকার ইন্টারনেট সার্ভিস বন্ধ করে দেওয়া হয়, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাও সীমিত। এই লেখা যখন লিখছি, ৭০ ঘণ্টা পরেও সেই ব্ল্যাকআউট চলছে। আমরা, যে সকল বাংলাদেশি, বিদেশে থাকি, গভীর উদ্বেগে দিন পার করছি, কারণ স্বজনের খোঁজ-খবর নিতে পারছি না ঠিকমতো। এর আগে কখনওই এত অসহায় বোধ করিনি। দেশকে সারা দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে ১৯ জুলাই নারকীয় তাণ্ডব চালানো হয়েছে। ছাত্রদের সঙ্গে সাধারণ জনতা, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের কর্মীও রাস্তায় নেমেছে। যার কারণে সরকারি অনেক ভবনে, থানায় আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। ১৮ তারিখ প্রাণ গেছে ৩২ জনের, পরদিন নিহতের সংখ্যা তিন অঙ্ক ছাড়িয়েছে। এরপর কারফিউ জারি করে সেনাবাহিনী নামিয়ে শনিবারেও সংঘর্ষ থামানো যায়নি। একের পর এক মৃত্যুর খবর পাচ্ছি। কোটা সংস্কার আন্দোলন এখন হাসিনা সরকারের পতন আন্দোলনে রূপ নিয়েছে।
শেখ হাসিনা এবং তার সরকারের প্রতি জনসাধারণের কেন এত ক্ষোভ, এই প্রশ্ন এসেই যায়। ২০০৮-এর ডিসেম্বরে নির্বাচনে তরুণ প্রজন্ম নতুন এক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে আওয়ামি লিগকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছিল। মানুষ চেয়েছিল বিএনপি-জামাতের ধর্মঘেঁষা রাজনীতি থেকে বাংলাদেশ মুক্তি পাবে। হয়েছে তার উল্টোটাই। হাসিনার সরকার ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করেছে সবচেয়ে বেশি। সকল সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়ে এক ব্যক্তির সিদ্ধান্তে দেশ চলছে। অর্থনীতির অবস্থা বড় নাজুক। দ্রব্যমূল্যের দাম আকাশচুম্বী। সাধারণ মানুষ কোনওরকমে খেয়ে-না-খেয়ে বেঁচে আছে। সঙ্গে সীমাহীন দুর্নীতি, বিদেশে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার; মেগা প্রজেক্টের নামে বেশুমার লুটপাট। ছাত্রলিগের একজন জেলা পর্যায়ের নেতাও হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গিয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। গত ১৫ বছরে তিনটি নির্বাচনের নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। আর এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে বা মুখ খুললেই ‘রাজাকার’ না-হয় ‘জামাত-শিবির’ ট্যাগ দেওয়া হয়েছে। বারবার পুলিশ আর হেলমেট পরা সশস্ত্র ছাত্রলিগকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। এবার তো ক্লাস নাইনের ছাত্রের বুকও গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছে। জনসাধারণের আত্মসম্মানে আঘাত জমতে জমতে আজকের এই ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছে। মৃত্যুভয় ছাপিয়ে মানুষ এখন প্রাণের বিনিময়ে হলেও মুক্তি চাইছে।
……………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন সুমন মজুমদার-এর লেখা: রক্তক্ষয় করতে বাঙালি ছাত্রছাত্রীরা কোনওকালেই কোনও কার্পণ্য করেনি
……………………………………………………………………………..
এই আন্দোলন এখন জনযুদ্ধ, আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ বটে। এত এত তাজা প্রাণ হারানোর পরে দেশকে রক্তপিপাসু স্বৈরাচারমুক্ত না করে ঘরে ফেরার উপায় নেই। ছাত্র-জনতা এই পণ করেই কারফিউ না মেনে রাস্তায় রয়েছে।
এই লেখাটি লেখার পর বাংলাদেশ রায় ঘোষণা করেছে। কোটা সংস্কারকে এক অংশে সংস্কার করেছে। কিন্তু এই সংস্কার কি সকল প্রকার মানুষের প্রতি সুবিচার করা হল? তা নিয়ে বিস্তারিত নিশ্চয়ই লেখালেখি হবে। তবে, একটা কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই, কোটা সংস্কারেই এই আন্দোলন থেমে থাকেনি। ছাত্রছাত্রী হত্যা, ছাত্রছাত্রী নিধনের উত্তর দিতে হবে এই সরকারকে। উত্তর দিতে হবে চাকরির দাবি করা ছাত্রছাত্রীদের ওপর লাঠিচার্জ, গুলি চালানো রাষ্ট্রনীতিতে পরিণত হল কীভাবে? এই প্রতিটি নিহত ছাত্রের বিচার চাই আমরা। বিচার চাই হত্যালীলার।
……………………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………………………
কাগজ বেরনোর পর দেখা গেল উপন্যাসের নাম হয়ে গেছে ‘শালিকার ঠোঁট’! পূর্ণেন্দুদা রেগে আগুন। পিঠে হাত দিয়ে সন্দীপন তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, ‘কী করবে ভাই বল! ছাপাখানার ভূত কাউকেই রেহাই দেয় না রে।’ পরে জানা গিয়েছিল এটা সন্দীপনদারই সূক্ষ্ম হাতের কাজ।