আজ সলিল চৌধুরী পা দিলেন জন্মশতবর্ষে। কবীর সুমনের দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের একটি অংশ, এতদিন অপ্রকাশিত ছিল, এই দিনটির জন্যই। রোববার.ইন-এর পাঠকের কাছে, হয়তো এ এক অপ্রত্যাশিত উপহার। এ লেখার শিরোনাম হতে পারত, সলীল চৌধুরী-কবীর সুমন সংলাপ। যে-সংলাপ বাংলা গানের ইতিহাসের অংশ।
প্রচ্ছদ দীপঙ্কর ভৌমিক
‘আধুনিক বাংলা গানে সমাজতত্ত্ব’ নামে একটা বই আমি লিখতে চেয়েছিলাম। আমি তখন সবে আমেরিকায় যাচ্ছি। তার আগে ‘ভয়েস অফ জার্মানি’র করেসপন্ডেন্ট হিসেবে কাজ করেছি। ভাবলাম, বইটার নাম এমনও হতে পারে– ‘সলিল চৌধুরী ও আধুনিক বাংলা গান’। সেখানে ‘সোশিওলজি অফ মিউজিক’টাও ধরা পড়বে। এটা আমার খুব প্রিয় বিষয়। এ নিয়ে লেখাপড়াও করেছি। তো আমি দেখা করলাম সলিলবাবুর সঙ্গে। উনি বললেন, ‘আমি নিশ্চয়ই তোমার কাছে যাব।’
ফাঁকা কথা নয় মোটেও। উনি সত্যিই এলেন। আমি পরপর সাক্ষাৎকার নিলাম ওঁর। আমার বাড়িতে থাকতেনও। অফিস থেকে ছুটি নিয়ে আমি একের পর এক সাক্ষাৎকার নিতাম। কিন্তু এতই অসংলগ্ন সেই কথাবার্তা, যে, আমি অনেক অংশই আর ব্যবহার করিনি। লোকে ভীষণ ভুল বুঝত। যেটুকু কাজ করেছিলাম, তার অনেকটা এখনও আন্তর্জালে আছে। বলা বাহুল্য, ওঁর গান, ওঁর সংগীত-ভাবনা আমাকে অসম্ভব অনুপ্রাণিত করেছে।
একদিন উনি বললেন, ‘‘সুমন, তুই বলছিস ‘গুরুচণ্ডালি’ হয়েছে, কোথায়?’’ আমার মাথায় এসে গিয়েছিল সুবীর সেনের একটা গান– ‘আর কিছু স্মরণে নেই, চলন তার ছন্দে বাঁকা/ দু’টি চোখে অপলকে, দিগন্তে চেয়ে থাকা/ যত দূর চাহি, আর কিছু নাহি’– ভাবুন তো, এই সুর সলিল ছাড়া আর কে করবেন! সলিলদাই সেই রেকর্ডটা শোনাচ্ছেন তখন। আমি বললাম, ‘গুরু, চাহি-র পর নাহি, আমরা বলি না।’ বললেন, ‘বললে দোষ আছে?’ বললাম, ‘যতদূর চাই আর কিছু নেই– কেন নয়?’ সলিল চৌধুরীর তখন মাথায় হাত! ‘ঠিকই তো ঠিকই তো! কেন করিনি এটা?’ ‘মানুষ তো অভ্যাসে বড় হয়েছে। আপনি রবীন্দ্রনাথ-নজরুল শুনতে শুনতে আসছেন। আপনার গানে আগাগোড়া গুরুচণ্ডালি ছিল।’ ‘কেউ বলেনি আমাকে, একজনও, তুই-ই প্রথম বললি!’
সলিল চৌধুরীর সঙ্গে আমার তক্কাতক্কি হয়েছে। এমনকী, বোতল ছোড়াছুড়িও। উনি বিয়ার খেতেন, আমি হুইস্কি– দু’জনে দুটো সুরার বোতল নিয়ে প্রথমে ‘আজকে মেরেই দেব’, তারপরই ‘‘যাগ্গে যাগ্গে কিছু মনে ক’রো না’’, আর ‘ও ঠিক আছে’ দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়ে যেত কথাবার্তা। সক্কালবেলা উঠে, বিয়ারের বোতল দিয়ে ময়দা-টয়দা মেখে, লুচি বানিয়ে আলু-পিঁয়াজের চচ্চড়ি বানিয়ে, ‘ওরে উঠে পড়, উঠে পড়, খেতে হবে’ বলতেন সলিল। অত্যন্ত ভদ্রলোক না হলে এমন কেউ করে?
এরপর অনেকদিন দেখা নেই। আমার একটা অনুষ্ঠান তিনি পাইয়ে দিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানটা ছিল কসবায়। সলিল চৌধুরী, ওঁর স্ত্রী ও কন্যার একটা অনুষ্ঠান এবং আমার, পরপর। তখনও ‘তোমাকে চাই’ বেরয়নি, বা সদ্য বেরিয়েছে। আমি গান গাইছি, আর উনি উইংসের ধার থেকে ‘চালিয়ে যাও একদম ঠিক হচ্ছে’– এইরকম ইঙ্গিত করছেন। পরে, সম্ভবত দূরদর্শনেরই একটা সাক্ষাৎকারে সলিল বলেছিলেন, ‘সুমন কিন্তু দেখিয়ে দিয়েছে, যে কোনও বিষয়েই গান হতে পারে। এটা আমাদের গানের ইতিহাসে ছিল না।’
ওঁর সঙ্গে আমার যে দেওয়া-নেওয়া, তা সম্পূর্ণ সংগীত বিষয়ে, খানিকটা রাজনৈতিকও। বলতাম, ‘সলিলদা, রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে কী মনে হয়?’ বলতেন, ‘‘তোদের কাছে যা, আমার কাছে কিন্তু তা নয়। আমার পঙ্কজদার ‘কী পাইনি’– এই গানটা বড্ড ভালো লাগত।’’ বললাম, আর? বললেন, ‘আর তেমন শুনিনি বুঝলি? থাকতাম তো বাবার সঙ্গে, চা-বাগানে। এখানে চাংড়িপোতায় ব্যান্ড হত। খানিক পরে কমিউনিস্ট পার্টিতে ঢুকে গেলাম। দুর্ভিক্ষের ত্রাণ দিতে গিয়ে দেখলাম একটা এমন গ্রাম, যেখানে কুকুরও নেই রে, সবাই পালিয়ে গিয়েছে। দূরে দাহ করতে পারেনি, একটা কঙ্কাল, দাহ করতে পারেনি, ফসফরাস জ্বলে উঠছে। বুঝতে পারছিস? কোথায় রবীন্দ্রনাথ? সিপিআইয়ের হয়ে তখন কাজ করছি।’ ‘তারপর?’ ‘‘ওইখান থেকেই ‘প্রান্তরের গান আমার মেঠো সুরের গান…’’।
এই ছিল অসম্ভব সুন্দর, আমাদের দেওয়া-নেওয়া। আমাদের দুর্ধর্ষ বাঘ সলিল চৌধুরী। কথা বলতে বলতে কোথায় যেন চলে যান! একদিন বললেন, ‘পথ হারাব বলে এবার পথে নেমেছি’– এটা কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে লেখা। বললাম, ‘সে কী মশাই!’ বললেন, ‘কাউকে বলিনি, তোকে বলছি। গানটা গা।’ দু’জন মিলে গাইতে লাগলাম। বললেন, ‘‘বুঝতে পারছিস? সোজা পথের ধাঁধা? দাদারা কী বলত? ‘সিধে পথে থাকো কমরেড, সিধে পথে!’ মনে কর, ‘নিষেধের পাহারাতে ছিলেম রেখে-ঢেকে’। বারণ– এটা করবে না, ওটা করবে না, ওটা বুর্জোয়া। রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়া, নজরুল? বুর্জোয়া! একমাত্র উদার তোমরাই না কমরেড?’’
মনে আছে, সুধীন দাশগুপ্ত মারা গিয়েছেন। উনি আমেরিকায়। আমি খবরটা ফোনে দিলাম। ভয়েস অফ আমেরিকায় চাকরি করতাম, বললাম, ‘সলিলদা তৈরি হন। একটা খারাপ খবর আছে।’ সলিলদা বললেন, ‘কী? কী খবর?’ অল্পক্ষণ চুপ, তারপর ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললেন! সামলে নিয়ে বললেন, ‘বুঝলি, আমি ছাড়া ওই আরেকজন কর্ড প্রোগ্রেশনটা বুঝত।’ ভাবুন– এটাই সলিল চৌধুরী! উনি সবসময় আছেন, উনি ছাড়া আরেকজন ছিলেন, এখন নেই! বেশ করেছেন বলেছিলেন। উনিই তো বলবেন। এমনটা আর কে বলবেন!
………………………………………..
একদিন বললেন, ‘পথ হারাব বলে এবার পথে নেমেছি’– এটা কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে লেখা। বললাম, ‘সে কী মশাই!’ বললেন, ‘কাউকে বলিনি, তোকে বলছি। গানটা গা।’ দু’জন মিলে গাইতে লাগলাম। বললেন, ‘‘বুঝতে পারছিস? সোজা পথের ধাঁধা? দাদারা কী বলত? ‘সিধে পথে থাকো কমরেড, সিধে পথে!’ মনে কর, ‘নিষেধের পাহারাতে ছিলেম রেখে-ঢেকে’। বারণ– এটা করবে না, ওটা করবে না, ওটা বুর্জোয়া। রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়া, নজরুল? বুর্জোয়া! একমাত্র উদার তোমরাই না কমরেড?’’
………………………………………..
প্রথম যেদিন এসেছেন, সেদিন বৃষ্টি পড়ছে বেশ। বললেন, ‘বাজার করতে হবে রে!’ দু’জনে বেরিয়ে পড়লাম। একটু বেরিয়েই ‘ঝিরঝিরঝির ঝিরঝিরি বরষা’ গাইছি, সলিল ‘এলো রে ঝড় এলো এলো’ গাইতে আরম্ভ করে দিলেন। হাতটাত ছড়িয়ে একেবারে। আমি বললাম, ‘গুরু, ধনঞ্জয়বাবুকে দিয়ে কেন গাওয়ান?’ সিগারেট ধরিয়ে মেজাজে হাঁটছিলেন। প্রশ্ন শুনে দাঁড়িয়ে পড়েছেন, ‘অ্যাই শোন, সলিল চৌধুরী কে? তুই না আমি? কী জানিস রে তুই?’ আমি চুপ করে রইলাম। বললেন, ‘তুই কি হেমন্তর কথা ভাবছিস?’ বললাম, ‘হ্যাঁ।’ বললেন, ‘পারত না।’ ‘অন্য কেউ?’ ‘‘পারত না! ওই ওজন আর কারও ছিল না। উচ্চারণে একটু দোষ কিন্তু কেউ পারবে এভাবে গানটা গাইতে! উনি যেভাবে গেয়েছেন, ওইভাবে কেউ পারত না। যে কারণে অন্তবিহীন ওই অন্ধকারের শেষটাও ওঁকে দিয়েই গাইয়েছি। কারও বাবা পারবে না রে! তুই নাম দে তা’লে, আমি লিখে নিই!’’ যাঁকে সম্মান জানানোর তাঁকে কিন্তু সম্মান জানাচ্ছেন ঠিক।
রেকর্ডিং সেট হয়ে যাওয়ার পর, মাঝে মাঝে আমেরিকায় ওঁর ছেলের কাছে যেতেন। ছেলের কাছে ৭ দিন। আমার কাছে ১৫ দিন। কারণ প্রচুর মদ্যপানের সুযোগ ছিল আমার কাছে। ছেলে সেসবে আপত্তি করত। যত রাজ্যের সব গল্প! সব মিলিয়ে একটা পাগলাটে লোক, একটা বেহিসেবি লোক। একদিন হঠাৎই বললেন, শোন সুমন, তোর সঙ্গে আমার যোগাযোগ বেশিদিন থাকবে না। বললাম, ‘কেন?’ ‘তুই দেখতে পাবি। শোন, তুই কলকাতায় ফিরিস না।’ ‘কেন? কী হল?’ বললেন, ‘তুই হিট হবি না, তুই সম্মান পাবি। বেঙ্গল তোকে নিতে পারবে না। আমাকেও নিতে পারেনি। ভাব, যদি বোম্বেতে না যেতাম, কী হত?’
ছোটবেলায় বাবা মারা গিয়েছিলেন সলিল চৌধুরীর। ঘাটখরচটুকুও নেই। ভাইরা সকলেই ছোট। বিমল রায়কে যে করে হোক, হাতে-পায়ে ধরে, ‘দো বিঘা জমিন’-এর উৎস-গল্পটা– ‘রিকশাওয়ালা’ শোনালেন। বিমল রায় রাজি হলেন। বলেছিলেন, ‘চমৎকার! চলে এসো।’ সলিল বলেছিলেন, ‘আমি ওখানে গিয়ে একে-তাকে ধরে মিউজিক শুরু করলাম।’ বলেছিলাম, ‘আপনি মিউজিক শিখেছেন?’ বললেন, ‘না, মিউজিক আমায় শিখেছে।’ এই যে কথাটা, এটা একটা ‘মেটাফর’ হিসেবে দেখা যেতে পারে।
শেষদিকে, একদিন বললেন, ‘যে-গান খালি গলায় গাওয়া যায় না, তা গান নয়।’ বললাম, ‘তাহলে আপনার যে-সমস্ত গান গাওয়া যায় না খালি গলায়, সেগুলো কী?’
‘গান নয়, ছ্যাবলামি! মনে রাখিস, খালি গলায় গাইতে হবে।’
সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত
প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশের সময় সম্পাদকের বক্তব্য ছিল কিঞ্চিৎ দ্বিধাজড়িত। একটি পৃথক গ্রন্থ হিসাবেই সংখ্যাটিকে ভাবছিলেন তাঁরা। সম্পাদকের নিবেদনে সেই সংশয় স্পষ্ট– ‘আগামীবারে এই বই আরও বিরাট আকারে বাহির করিবার ইচ্ছা রহিল।... তবে এর সাফল্যের সবটাই নির্ভর করিতেছে চিত্র-প্রিয়দের সহানুভূতির উপর।...’