এই বঙ্গে বহু এমন ক্রিকেটার আছেন বা ছিলেন, শত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যাঁদের কখনও দেশের হয়ে খেলা হয়নি। কখনও তা আটকে দিয়েছে রাজনীতির জাঁতাকল। কখনও বা অনভিপ্রেত চোট-আঘাত। বাংলা ক্রিকেটের সেই হারানো সুরদের নিয়ে খেলাইডোস্কোপ-এ শুরু হয়েছে নতুন সিরিজ– উপেক্ষিত একাদশ। আজ তার চতুর্থ পর্ব। সে টিমের ‘অফ কাটার’ সমর চক্রবর্তীকে নিয়ে। আজ দ্বিতীয় কিস্তি।
২৯.
ব্যাপ্তিতে অন্তরীক্ষ, বিস্তারে আকাশগঙ্গা, প্রভাবে সূর্যরশ্মি হওয়া সত্ত্বেও প্রাপ্য মর্যাদা কাকে বলে, জীবনে জানতে পারেননি ‘জওয়ান’ চক্রবর্তী! ওরফে, সমর চক্রবর্তী। সেনাবাহিনীতে ছিলেন বলে যাঁর নাম ‘জওয়ান’ হয়ে গিয়েছিল। এরাপল্লি প্রসন্ন নিজের বইয়ে একবার লিখেছিলেন, ভারতের দুর্ভাগ্য যে ছয়ের দশকের শেষাশেষি অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড সফরে দলে ডাক পাননি সমর। পরবর্তীতে ক্রিকেট ঐতিহাসিক রাজু মুখোপাধ্যায়ও লেখেন, সমর চক্রবর্তীর সঠিক মূল্যায়ন দেশ যেমন করেনি, ময়দানও তেমন করেনি।
খাঁটি গাওয়া ঘি-র মতো যা নির্ভেজাল। করেনি। কখনও করেনি। করলে মৃত্যুর পর সমরকে আমন্ত্রণীপত্র কখনও পাঠাত না সিএবি! করলে, এত বৃহৎ ক্রিকেট সংস্থার কেউ না কেউ অন্তত সমরের প্রয়াণের সময় তাঁর বাড়ি যাওয়ার সময়টুকু পেতেন!
সমর কত বড় পেসার ছিলেন, কতটা ভয়াল তাঁর ‘কাটার’ ছিল, লিখেছি পূর্ববর্তী সংখ্যায়। ধারালো ‘কাটার’-এর জন্য যাঁর নামই হয়ে গিয়েছিল ‘চাকু’। পূর্ববর্তী সংখ্যায় এ-ও লিখেছি, কতটা সম্ভ্রমে সুনীল মনোহর গাভাসকর পর্যন্ত সমর-পুত্র শিবাজিকে বলেছিলেন, ‘তোমার বাবা আমার কেরিয়ারটাই শেষ করে দিচ্ছিল আর একটু হলে!’ ’৬৯-এ দক্ষিণাঞ্চল বনাম উত্তরাঞ্চল দলীপ ট্রফি ম্যাচের দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৪২ রানে ৬ উইকেট পেয়েছিলেন সমর! যা তাঁর কেরিয়ার সেরা। শোনা যায়, সেই সময় সমরের বোলিং তৎকালীন ব্যাটারদের এতটাই মান-সম্মান আদায় করে নিয়েছিল যে, তাঁদের ব্যক্তিগত মহড়ায় ডাক পড়ত ‘জওয়ান’-এর। যেমন এমএল জয়সীমা। হায়দরাবাদে নিজের বাড়িতে সমরকে ডেকে পাঠাতেন তিনি। বৈভব-প্রাচুর্য কম ছিল না জয়সীমার। বাড়িতেই পিচ তৈরি করে মহড়া সারতেন। কিন্তু একা-একা সে তো আর সম্ভব নয়। উল্টোদিকে তুখোড় বোলার লাগবে তো! অগত্যা, ডাকো ‘জওয়ান’কে, খেলো প্রকৃত পেস বোলিং!
কিন্তু বেশিদিন সেনাবাহিনীর জীবন যাপন সম্ভব হয়নি সমরের। পরিবারের দায়-দায়িত্ব দ্রুতই তাঁকে জংলা পোশাকের পৃথিবী থেকে গার্হস্থ্য জীবনে ফিরিয়ে আনে। ততদিনে তাঁর পিতা প্রয়াত হয়েছেন। টেলিফোন ছিল না সে সময়। খারাপ-ভালো যে কোনও খবর কোনও এক অদৃশ্য ‘রানার’ বিদ্যুৎগতিতে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে পৌঁছে দিত না। সেনাবাহিনীর উচ্চপদাধিকারীরা ঠেলে-গুঁতিয়ে বাড়ি পাঠানোর সময়ও সমর বুঝতে পারেননি, তাঁর বাবা আর নেই। বোঝেন, গ্রামে ফিরে। দাওয়ায় মা’কে সাদা থানে দেখে। সত্তরের আশেপাশে তাই সেনাবাহিনীকে চিরকালের মতো ‘আলবিদা’ জানিয়ে সমরের ফিরে আসা। সংসারের জোয়াল পরিপূর্ণ ভাবে কাঁধে তুলে নেওয়া।
পরের ক’বছরে দুই প্রখ্যাত বাঙালির সাহচর্যে আসেন সমর। প্রথমজন, প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। দ্বিতীয় জন, চুনী গোস্বামী।
সেনাবাহিনী ছাড়ার পরপরই রেলে যোগ দেন বাঙালি পেসার। সেই সময় রেল আলো করেছিলেন প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। যাঁকে ভূ-ভারত পিকে বন্দ্যোপাধ্যায় নামে জানে-চেনে। শোনা যায়, সমরকে দেখে নাকি পিকে সহাস্যে বলেছিলেন, ‘আর যা-ই করো, প্র্যাকটিসে ফাঁকি দিও না আর্মি ম্যান! ঠিক করে ট্রেনিংটা করো।’ কিন্তু রেলের জীবনে মন বসেনি সমরের। কারণ, ততদিনে তাঁর জীবনে নতুন আলোকবর্তিকার আবির্ভাব ঘটে গিয়েছে।
চুনী গোস্বামী!
দেখতে গেলে, চুনীর টানেই ’৭২-এ ইস্টার্ন রেল ছেড়ে সমরের মোহনবাগানে আসা। আর ‘চাকু’-র মোহনবাগানে যোগদানের কাহিনিও বড় রোমাঞ্চকর। সমরকে মোহনবাগানে সই করাতে তাঁর গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলেন স্বয়ং চুনী! গাড়ি রাখতে হয়েছিল বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে। বাকিটা চুনীকে যেতে হয় কাঁচা রাস্তা দিয়ে, আল-পথ ধরে। শোনা যায়, বরেণ্য ক্রীড়াবিদকে বসতে দেওয়ার চেয়ার পর্যন্ত ছিল না সমরের বাড়িতে! পাশের বাড়ি থেকে জোগাড়যন্ত্র করে আনাতে হয়। কিন্তু সে দিন থেকে মোহনবাগানের সঙ্গে তাঁর বাংলা পর্বও শুরু হয়ে যায়।
বাংলা জার্সিতে সুব্রত গুহ-র সঙ্গে সমরের পেস-জুটি সেই সময় ত্রাস সৃষ্টি করে দিয়েছিল দেশের বাদবাকি টিমে। চুনীর নেতৃত্বে রনজি ট্রফি ফাইনালও খেলে ফেলেন। বঙ্গ ক্রিকেটের প্রাজ্ঞদের মুখে শোনা, সাতের দশকে একবার এক বাংলা বনাম মহারাষ্ট্র ম্যাচ ঘিরে নাকি তীব্র আগ্রহের সঞ্চার হয়েছিল। মহারাষ্ট্রে তখন খেলছেন পাণ্ডুরাং সালগাঁওকর। তিনি সেই সময় দেশের এক নম্বর ফাস্ট বোলার। যাঁকে বল হাতে ছুটে আসতে দেখলে (নাকি তেড়ে বলা উচিত) নাকি ব্যাটাররা ভিরমি খেতেন! তা, বাংলা বনাম মহারাষ্ট্র বাদ দিয়ে খেলাটা পুরোটাই হয়ে দাঁড়ায়–পাণ্ডুরাং বনাম সমর! খেলাখানা হয়েওছিল মোক্ষম।
প্রথম ইনিংসে সমর পাঁচ উইকেট নেন মাত্র ৪৪ রানে। পরে ব্যাট করতে নেমে ঘোর বিপাকে পড়ে বাংলাও। প্রথম ইনিংসে ১৪৩ রানে অলআউট হয়ে যায়। কিন্তু সেটা পরের কথা। আসল কাহিনি হল, ১০০ রানে ন’উইকেট চলে গিয়েছিল বাংলার। শেষ উইকেটে তেতাল্লিশ রান যোগ করেন রাজু মুখোপাধ্যায় আর সমর মিলে। রাজুর লেখাতেই পাওয়া যায়, পাণ্ডুরাং-বাহিনী লাল বলের চাকা-চাকা দাগ করে দিয়েছিল সমরের গায়ে-মাথায়।
রাজু বুঝেছিলেন যে, তাঁর সতীর্থকে যেনতেন প্রকারেণ আউট করার প্রাণান্ত চেষ্টা চালাচ্ছে মহারাষ্ট্র। যা তিনি সতীর্থকে বলতেও যান। কিন্তু বলতে গিয়ে, মোক্ষম ধাক্কা খান। সমর তাঁকে সোজা বলেন, ‘রাজু, তুই নিজের ব্যাটিং নিয়ে ভাব। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আমি আমারটা বুঝে নেব। নির্বাচকরা আমায় শেষ করতে পারেনি, পাণ্ডুরাং সেখানে কী করবে!’
লড়ার যে জ্বলন্ত বাসনা, যুদ্ধের যে জিঘাংসা আর বাংলা ক্রিকেটারদের মধ্যে আজকাল দেখা যায় না। আর সেই যুগন্ধর ক্রিকেটারের কপালেই কি না এতটা অশ্রদ্ধা-উপেক্ষা অপেক্ষা করে ছিল! ভারতের ক্ষেত্রে না হয় একজন কুখ্যাত বেচু দত্ত রায় ছিলেন। স্পোর্টিং ইউনিয়ন না খেললে যিনি বাঙালি ক্রিকেটারদের নির্দ্বিধায় ‘বলি’ দিতেন। যাঁর ইচ্ছেয় ‘গর্দান’ গিয়েছে দুর্গাশঙ্কর থেকে সমরের। কিন্তু বাংলা? বাংলার ক্রিকেট সংস্থা? এটা ঘটনা যে, সমরকে আজীবনের সম্মানে ভূষিত করেছে সিএবি।
কিন্তু সমান্তরালভাবে এটাও সত্যি যে, ভূষিত করে ভুলে গিয়েছে। না হলে সমরের মৃত্যুর দিন সিএবি কর্তাদের ‘পদধূলি’ পড়ত নিশ্চিত। একটা স্মৃতিসভার আয়োজন হত। পিবি দত্ত-র স্মৃতিসভায় প্রয়াত সমরের কাছে ‘আপনি আসিলে বাধিত হইব’ মার্কা পত্রখানিও যেত না! বঙ্গ ক্রিকেট সংস্থার কর্তাকুল লেখা পড়লে রুষ্ট হলে না হয় সমর-পুত্র শিবাজি চক্রবর্তীর সঙ্গে কষ্ট করে যোগাযোগ করে নেবেন! যদ্দুর জানি, চিঠিখানি তাঁর কাছে আজও সযত্নে রাখা আছে!
…পড়ুন খেলাইডোস্কোপ-এর অন্যান্য পর্ব…
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২৮: বাউন্সারে উপড়ে ফেলা দাঁত ব্যাটারকে দিয়ে বলেছিলেন পরে লাগিয়ে নিতে
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২৭: তিনি না থাকলে ভারতীয় ক্রিকেটে ‘অপ্রকাশিত’ থাকত ধোনি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২৬: যে আক্ষেপ বয়ে বেড়ালেন বাংলা ক্রিকেটের ‘পরশুরাম’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২৫: শিরদাঁড়াটা বিক্রি নেই যাঁদের, তাঁদের দেশ মনে রাখে চিরকাল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২৪: আম্পায়ার সেই নিঃস্ব প্রজাতি যারা ক্রিকেটকে শুধু দিল, পেল না কিছুই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২৩: বিশ্বাসে মিলায় ক্রিকেট, ‘কু’সংস্কারে বহুদূর!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২২: ‘ফিক্সার’-রা ছিল, আছে, থাকবে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের আরশোলা-র মতো
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২১: বল পিছু স্কোরবোর্ডে যারা সংখ্যা বদলায়, কিন্তু তাদের জীবন বদলায় না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২০: প্রতি গুরু-পূর্ণিমায় প্রথম ফুল দেব সব্যসাচী সরকারকেই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৯: ময়দানের ছবিওয়ালাদের কেউ মনে রাখেনি, রাখে না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৮: যারা আমার মাঠের পরিবার
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৭: অহং-কে আমল না দেওয়া এক ‘গোল’ন্দাজ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৬: যে দ্রোণাচার্যকে একলব্য আঙুল উপহার দেয়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৫: সাধারণের সরণিতে না হাঁটলে অসাধারণ হতে পারতেন না উৎপল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৪: মনোজ তিওয়ারি চিরকালের ‘রংবাজ’, জার্সির হাতা তুলে ঔদ্ধত্যের দাদাগিরিতে বিশ্বাসী
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৩: অনুষ্টুপ ছন্দ বুঝতে আমাদের বড় বেশি সময় লেগে গেল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১২: একটা লোক কেমন অনন্ত বিশ্বাস আর ভালোবাসায় পরিচর্যা করে চলেছেন বঙ্গ ক্রিকেটের
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১১: সম্বরণই বঙ্গ ক্রিকেটের বার্নার্ড শ, সম্বরণই ‘পরশুরাম’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১০: যাঁরা তৈরি করেন মাঠ, মাঠে খেলা হয় যাঁদের জন্য
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৯: খণ্ড-অখণ্ড ভারতবর্ষ মিলিয়েও ক্রিকেটকে সম্মান জানাতে ইডেনতুল্য কোনও গ্যালারি নেই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৮: ২০২৩-এর আগে আর কোনও ক্রিকেট বিশ্বকাপ এমন ‘রাজনৈতিক’ ছিল না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৭: রোহিত শর্মার শৈশবের বাস্তুভিটে এখনও স্বপ্ন দেখা কমায়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৬: বাংলা অভিধানে ‘আবেগ’ শব্দটাকে বদলে স্বচ্ছন্দে ‘বাংলাদেশ’ করে দেওয়া যায়!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৫: ওভালের লাঞ্চরুমে জামাইআদর না থাকলে এদেশে এত অতিথি সৎকার কীসের!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৪: ইডেনের কাছে প্লেয়ার সত্য, ক্রিকেট সত্য, জগৎ মিথ্যা!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৩: এ বাংলায় ডার্বিই পলাশির মাঠ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২: গ্যালারিতে কাঁটাতার নেই, আছে বন্ধনের ‘হাতকড়া’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১: চাকরি নেই, রোনাল্ডো আছে