এমন এক ভূখণ্ড যেখানে গত ৭৬ বছরে যুদ্ধবাজদের হাতে বলি লক্ষ লক্ষ মানুষ। একেই বলে ইতিহাসের পরিহাস, যে ইহুদিরা একসময় ভিলেন হিটলারের নিশানা হয়েছিলেন, প্যালেস্টাইনে তাঁরাই ভিলেন! মধ্যপ্রাচ্যের তেলবাণিজ্য, ইহুদি ভার্সেস ইসলাম, আমেরিকা-ইজরায়েল-ইরানের জটিল কূটনীতির চাল, শরণার্থী রাজনীতি, মাঝখানে ধরি মাছ না ছুঁই পানি টাইপ রাষ্ট্রসংঘের ভূমিকা। এসবের ঊর্ধ্বে রয়েছে আরেক আকাশ। মানবিকতার আকাশ। সেই উঁচুতে জন্ম ‘প্রতিরোধ সাহিত্য’-এর। ‘পোয়েট্রি অফ রেজিস্টেন্স ইন অক্যুপায়েড প্যালেস্টাইন’। তারই সাম্প্রতিক সংকলন ‘অলিভের রক্ত’।
সকাল। সূর্য। গাছ। শিশুরা। রোগা রোগা। প্যালেস্তাইনের রাফা উদ্বাস্তু শিবিরের মাঠে খেলছে। আচমকা সাদা আলোর ঝলকানি। বুম! ইজরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের সফল ‘পরীক্ষা’। এবং পোড়া সকাল। মরা গাছ। ছোট ছোট হাত, মুন্ডু, ধড় ছড়িয়ে…। তার মধ্যে এক বাবা। ঝলসে যাওয়া। তবু বেঁচে থাকা, ওই প্যালিস্তিনীয় যুবক বাবার হাতে শিশুকন্যার মুন্ডু। চোখগুলো গোল গোল। বিস্ফারিত। রক্তমাংসের পুতুল! তিনি মেয়ের হাত, পা, ধড় খুঁজছেন। পেলে তবে শেষকাজ। কবর দেবেন। তার আগে ‘ইহুদি’ রাগে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া গোটা মেয়েটাকে জড়িয়ে কাঁদবেন একবার। কিন্তু কবরস্থানে যে হামলা চালাবে না ওরা, তার নিশ্চয়তা কোথায়! বেঁচে থাকলে তবে না শোক। অতএব, মেয়ের মুন্ডু বুকে চেপে বুকফাটা আর্তনাদ করে কেঁদে উঠলেন বাবা। ঠিক যেন এডওয়ার্ড মুঙ্খের ক্যানভাস ‘দ্য স্ক্রিম’। দুঃস্বপ্নের এই ‘খাতায়’ একজন কবি কী লিখতে পারেন? ১৯৮৩ সালে গাজার আল বুরেজ শরণার্থী শিবিরে জন্ম কবির। তরুণ হিন্দ জুদাহ নিজেকেই প্রশ্ন ছোড়েন। তাঁর কবিতার শিরোনাম– ‘যুদ্ধের সময়ে কবি বলতে ঠিক কী বোঝায়?’
কবিকে চিরকাল নরম, অলস, প্রেমিক বলে দেগে দিয়েছে যে সমাজ, তাকে উত্তর দেন মৃত্যু উপত্যকার কবি। তিনি লেখেন, ‘যুদ্ধের সময়ে কবি বলতে ঠিক কী বোঝায়?/ বোঝায় যে তুমি ক্ষমাপ্রার্থী। তুমি পুড়ে যাওয়া গাছের/ জন্য আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাও, ক্ষমা চাও বাসা ভাঙা/ পাখিদের কাছে, থেঁতলে যাওয়া বাড়িগুলোর কাছে ক্ষমা/ চাও, চাও রাস্তার দীর্ঘ ফাটলগুলোর কাছে, সন্তান/ জন্ম দেওয়ার মাঝে মৃত্যুতে নিস্তেজ মা কিংবা তার আগেই,/ আর প্রতিটি শোকার্ত মুখ অথবা খুন হওয়া মায়ের কাছে।’ একটানা ক্ষমাপ্রার্থনার পর দম নেন কবি। সেই স্পেসের পর কেঁদে ওঠে অন্তিম পঙক্তি, ‘হা ঈশ্বর, আমি যুদ্ধের সময়ে এই কবি হতে চাই না!’ তথাপি কবির জন্ম যদি হয় ‘কুটিল, হিংস্র ও রক্তক্ষয়ী’ ইতিহাস পরগনায়, তবে কী করার!
হাওয়াযান প্রকাশনার ‘অলিভের রক্ত’ সেই রক্তের নদী, মাংসপিণ্ডের পাহাড়ের দেশ প্যালেস্তাইনের আজকের কবিদের কবিতা সংকলন। গ্রন্থের সম্পূর্ণ শিরোনাম ‘অলিভের রক্ত, আক্রান্ত ফিলাস্তিন: আজকের কবিতা’। যেমন ধরুন, বিশ্বশান্তির দূত যিশুর স্মৃতিধন্য জেরুজালেমে জন্ম নাজওয়ান দারবিশের। আরবি ভাষার অগ্রগণ্য এই কবির স্বগতোক্তি, ‘আমি দেশ লিখতে চাই,/ আমি এমন শব্দ চাই/ যা নিজেই দেশ হয়ে উঠতে পারে।’ (আমি লিখি দেশ)
………………………………………………………………………
‘অলিভের রক্ত’ স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়েছে কনিষ্ক ভট্টাচার্যর গভীর অনুবাদ, জরুরি ভূমিকা এবং প্য়ালিস্তিনীয় কবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিতে। কনিষ্ককে ধন্যবাদ জানাই ‘ফিলাস্তিনে’ কবিতাটিকে দিয়ে এই কাব্য সংকলন শুরু করায়, যে কবিতার স্রষ্টার নাম হারিয়ে গিয়েছে। গাজায় ইজরায়েলি বিমানহানার সময়ে গত নভেম্বরে সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় কবিতাটি। ‘বন্ধুদের’ নিয়ে লেখা এই কবিতা বুকে শিশুকন্যার মুন্ডু চেপে ধরে রাফা শরণার্থী অসহায় পিতারও। এই কবিতা কি আমাদেরই এক সহনাগরিকের বুকফাটা আর্তনাদের অনুবাদ?
………………………………………………………………………
যদিও সেই দেশের বদলে স্বভূমিতে উদ্বাস্তু হওয়ার, সম্পত্তি লুণ্ঠিত হওয়ার, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার, কারাবাসের, রিফিউজি ক্যাম্পের, অত্যাধুনিক রাইফেলের সামনে নিজের পরিচয়পত্র দেখাতে বাধ্য হয়ে, কেবল সংখ্যা হিসেবে বেঁচে থাকাই নিয়তি। ‘বেঁচে থাকাই’ বা বলা কীভাবে! যেখানে রাষ্ট্রসংঘ তথা আন্তর্জাতিক নিষেধকে অমান্য করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয় শরণার্থী শিবিরে, ছোটদের স্কুলে, এমনকী হাসপাতালে! সোজা কথায়, হামাসের মতো ইজরায়েল বিরোধীদের নিকেশের অছিলায় নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। বাদ পড়ছে না নিষ্পাপ শিশুরাও। শুধু গত ছয় মাসে ইজরায়েলি হানায় মৃত্যু হয়েছে ২৬ হাজার শিশুর। মোট মৃতের সংখ্যা লক্ষাধিক। এই গণহত্যার মধ্যে যদি প্যালেস্তাইনের জাতীয় কবি মাহমুদ দারভিশের মন্ত্র– ‘অধিকৃতের কাছে একমাত্র সত্য হল আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ’ সাধারণ প্যালিস্তিনীয়র মুখে মুখে ফেরে, তবে কী খুব অন্যায় হবে?
এমন এক ভূখণ্ড যেখানে গত ৭৬ বছরে যুদ্ধবাজদের হাতে বলি লক্ষ লক্ষ মানুষ। একেই বলে ইতিহাসের পরিহাস, যে ইহুদিরা একসময় ভিলেন হিটলারের নিশানা হয়েছিলেন, প্যালেস্টাইনে তাঁরাই ভিলেন! মধ্যপ্রাচ্যের তেলবাণিজ্য, ইহুদি ভার্সেস ইসলাম, আমেরিকা-ইজরায়েল-ইরানের জটিল কূটনীতির চাল, শরণার্থী রাজনীতি, মাঝখানে ধরি মাছ না ছুঁই পানি টাইপ রাষ্ট্রসংঘের ভূমিকা। এসবের ঊর্ধ্বে রয়েছে আরেক আকাশ। মানবিকতার আকাশ। সেই উঁচুতে জন্ম ‘প্রতিরোধ সাহিত্য’-এর। ‘পোয়েট্রি অফ রেজিস্টেন্স ইন অক্যুপায়েড প্যালেস্টাইন’। তারই সাম্প্রতিক সংকলন ‘অলিভের রক্ত’। শিল্পের সামাজিক ভূমিকার চাঁছাছোলা পাঠ। যেমন রিফাত আল আরির কবিতা ‘আপনিই আমি’। কবি ‘হত্যাকারী’কে বলেন, ‘আমিই আপনার অতীত/ আর আমাকে মেরে/ আপনি নিজেকেই হত্যা করছেন।’ সাম্প্রতিক আরবি ভাষায় সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিমান কবি যাঁকে মনে করা হচ্ছে, সেই মহম্মদ মৌসার ‘নগ্ন কবিতা’ শুরু হয়, ‘খেয়ে ফেলুন/ কাছের পাখিগুলোর/ ভুক্তাবশেষ,/ অপরিচিত লোকেরা/ রক্ত পান করুন…।’
সত্যিই তো, ‘দেশপ্রেমের দিনমজুর’ যে ইজরায়েলি সেনার হাতে খুন হচ্ছেন একজন সাধারণ প্যালেস্তিনীয়, বন্ধুত্ব হোক বা শত্রুতা, সব দিক থেকেই তো তাঁরা অপরিচত। তবু রক্তের হোলি অব্যাহত। যদিও ‘বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে’। এই আবহে মোসাব আবু তোহা তাঁর কবিতা ‘গাজা নোটবুক’-এ লেখেন, ‘বোমা যখন বিস্ফারিত হয়/ গভীরে এক আক্ষিকোটর গড়ে।/ মাছ ভাবে সমুদ্র/ চিরকাল কাঁদছে।’ মহিখাতের মতো গভীর এই উচ্চারণের পড়ে চোখ পড়ে মোসাবেরই ‘ঘর কাকে বলে?’ কবিতাটিতে। যেখানে কবি নিজেই উত্তর দেন, ‘সে ছিল আমার ইস্কুলে যাওয়ার পথের ঘনবৃক্ষছায়া/ ওরা তাকে ছিন্নমূল করবার আগে।’
……………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন কিশোর ঘোষ-এর লেখা: যে সিনেমা দেখে মানুষ খুনের উল্লাস হয় না, সেই সিনেমাই প্রতিরোধের সিনেমা
……………………………………………………………………………….
‘প্রতিরোধ কবিতা’র সংকলন ‘অলিভের রক্ত’ যতটা ইতিহাসের দলিল, ততটাই শিল্পেও দায়বদ্ধ। বাজারি কবির অর্ডারি কবিতা নয় বলেই হয়তো। রক্ত দিয়ে লেখায় ভণ্ডামি সম্ভব না। সবচেয়ে বড় কথা, এখানে কবিতাই বড়, কবি অহেতুক। ‘অলিভের রক্ত’ স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়েছে কনিষ্ক ভট্টাচার্যর গভীর অনুবাদ, জরুরি ভূমিকা এবং প্য়ালিস্তিনীয় কবিদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিতে। কনিষ্ককে ধন্যবাদ জানাই ‘ফিলাস্তিনে’ কবিতাটিকে দিয়ে এই কাব্য সংকলন শুরু করায়, যে কবিতার স্রষ্টার নাম হারিয়ে গিয়েছে। গাজায় ইজরায়েলি বিমানহানার সময়ে গত নভেম্বরে সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় কবিতাটি। ‘বন্ধুদের’ নিয়ে লেখা এই কবিতা বুকে শিশুকন্যার মুন্ডু চেপে ধরে রাফা শরণার্থী অসহায় পিতারও। এই কবিতা কি আমাদেরই এক সহনাগরিকের বুকফাটা আর্তনাদের অনুবাদ?
‘ফিলাস্তানে,
আমাদের বন্ধুদের গায়ে
বন্ধুদের গন্ধ মেলে না
হাসপাতলের গন্ধ পাওয়া যায়।
আমাদের হাসপাতলে
হাসপাতালের গন্ধ মেলে না
মেলে কবরের গন্ধ।
আমাদের কবরখানায়
কবরখানার গন্ধ পাওয়া যায় না
পাই আমাদের বন্ধুদের গন্ধ।
ফিলাস্তিনে।’
অলিভের রক্ত, আক্রান্ত ফিলান্তিন: আজকের কবিতা
ভূমিকা ও তরজমা: কণিষ্ক ভট্টাচার্য
হাওয়াযান পাবলিশার্স
২০০টাকা
…………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………………..
খেলিফের প্রতি নেটিজেনের বিরুদ্ধতার কারণ তাই, আর যাই হোক, তা ‘মেয়েদের সমানাধিকারের’ দাবিতে নয়। সমস্যা অবশ্যই খেলিফের লম্বা, পেটানো পেশিবহুল চেহারা– যা বহু মানুষের মতে ‘নারীসুলভ’ নয়। অর্থাৎ, অলিম্পিক খেলার যোগ্যতা অর্জন করা ক্রীড়াবিদ পাশ করতে পারেননি আমাদের বিউটি প্যাজেন্টে। দুইক্ষেত্রেই লজ্জা আমাদের। তবুও খেলিফ জিতলেন, সোনা ছাড়া আর কীই বা পেতে পারতেন তিনি?