পথ চলা শুরু করার প্রায় এক দশক পরে, রবীন্দ্র তিরোধানের বছরে, ‘পরিচয়’-এর ১১শ বর্ষ, ১ম খণ্ড, ৫ম সংখ্যা ঘোষিত হল ‘রবীন্দ্রস্মৃতি সংখ্যা’ হিসেবে। প্রচ্ছদে রবীন্দ্রনাথের একটি ফোটোগ্রাফ, “শম্ভু সাহার সৌজন্যে প্রাপ্ত”। সম্পাদক হিসেবে রয়েছে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং হিরণকুমার সান্যালের নাম। সংখ্যাটিতে প্রবন্ধ ছিল সাতটি, কবিকে নিবেদিত কবিতার সংখ্যা তিনটি। এছাড়াও পুস্তক পরিচয় অংশে ছিল রবীন্দ্রনাথের লেখা বই আর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা বইয়ের আলোচনা।
‘কবিতা’ পত্রিকার পৌষ, ১৩৪৮ সংখ্যায় বুদ্ধদেব বসু একটি অদ্ভুত উক্তি করেছিলেন, ‘‘এটা লক্ষ করবার যে রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে ভালো প্রবন্ধ তাঁর জীবদ্দশায় যা লেখা হয়েছে তাঁর মৃত্যুর পরে তার চেয়ে অনেক বেশি লেখা হচ্ছে, ‘পরিচয়ে’র এই সংখ্যাটি তার সাক্ষ্য দেবে।” খুব প্রতিষ্ঠিত লেখক তাঁর সমসময়ের লেখকদের কাছে কতদূর লিখিত স্বীকৃতি পাবেন, বুদ্ধদেব বসু যেন চিরকালীন সেই রসায়নের দিকেই শ্লেষমেশা এই ইঙ্গিত করছেন। খুব স্থূলভাবে বিচার করলে, বুদ্ধদেবের কথার সূত্রে বলা যায়, তাঁর জীবদ্দশায় প্রধানত দু’টি ধারায় বয়ে গিয়েছে রবীন্দ্র সমালোচনার ধারা– হয় রবীন্দ্রবিদূষণ, নয় রবীন্দ্রস্তুতি। সেই বলয়কে ভেঙে, রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে নিন্দেমন্দ বা মুগ্ধতার অতিরেকের মাঝে যতদূর সম্ভব নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করেছিল ‘পরিচয়’, একেবারে পত্রিকার জন্মলগ্ন (১৯৩১) থেকেই। সেই সময় নতুন কোনও পত্রপত্রিকা বেরলেই রবীন্দ্রনাথের আশীর্বচন নিয়ে পত্রিকা সূচনা করার যে প্রচলিত রীতি ছিল, তার একেবারে বিপরীতে গিয়ে দেখা গেল, ‘পরিচয়’-এর প্রথম সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথের কোনও লেখা কোথাওই নেই! পত্রিকা অবশ্য একেবারে রবীন্দ্র-শূন্য ছিল না, পুস্তক পরিচয় বিভাগে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের আলোচনায় ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’। তবে প্রথম সংখ্যায় না থাকলেও দ্বিতীয় সংখ্যা থেকেই রয়েছে তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। রবীন্দ্রনাথের মোট ৩৮টি লেখা প্রকাশিত হয়েছে ‘পরিচয়’-এর পাতায়। জীবনের শেষ লেখা গদ্য ‘সৃষ্টির আত্মগ্লানি’ও দিয়েছিলেন সুধীন্দ্রনাথের হাতেই। ‘কবিতা’ পত্রিকার মতো, ‘পরিচয়’-এর নবীন চিন্তা আর নিজস্ব আধুনিকতা আগ্রহ জাগিয়েছিল রবীন্দ্রনাথের মনে, বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় সেকথা।
পথ চলা শুরু করার প্রায় এক দশক পরে, রবীন্দ্র তিরোধানের বছরে, ‘পরিচয়’-এর ১১শ বর্ষ, ১ম খণ্ড, ৫ম সংখ্যা ঘোষিত হল ‘রবীন্দ্রস্মৃতি সংখ্যা’ হিসেবে। প্রচ্ছদে রবীন্দ্রনাথের একটি ফোটোগ্রাফ, “শম্ভু সাহার সৌজন্যে প্রাপ্ত”। সম্পাদক হিসেবে রয়েছে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং হিরণকুমার সান্যালের নাম। সংখ্যাটিতে প্রবন্ধ ছিল সাতটি, কবিকে নিবেদিত কবিতার সংখ্যা তিনটি। এছাড়াও পুস্তক পরিচয় অংশে ছিল রবীন্দ্রনাথের লেখা বই আর রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা বইয়ের আলোচনা। সংখ্যাটি সম্বন্ধে বুদ্ধদেব বসু লেখেন, “এর তিনটি প্রবন্ধ বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য: লীলাময় রায়ের ‘রবীন্দ্রনাথ: বিনুর সাক্ষ্য’, অমিত সেনের ‘রবীন্দ্রনাথ ও অগ্রগতি’ ও রাণী মহলানবিশের ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’।”
‘রবীন্দ্রনাথ: বিনুর সাক্ষ্য’ প্রবন্ধটি অন্নদাশংকর রায় লিখেছেন লীলাময় রায় ছদ্মনামে, বক্তা হিসেবে ‘বিনু’ পরিচয়ের আড়ালে। আসলে কিন্তু ব্যক্তি অন্নদাশংকরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আলাপ, দ্বন্দ্ব, গ্রহণবর্জনের পালাই এই লেখার মূল বিষয়। বিনুর বন্ধুমহলে ছিল ‘বঙ্কিম’, ‘গিরিশ’ আর ‘দ্বিজু’র জনপ্রিয়তা, তারা বলত, “রবিবাবু কবি বটে, কিন্তু দ্বিজু রায়ের সঙ্গে তুলনা চলে না। কোন এক সাহেব নাকি তাঁকে ইংরাজীতে লিখতে সাহায্য করেছেন, ধরতে গেলে সেই সাহেবেরই লেখা। তাতে নাকি বিদেশে তাঁর সুনাম হয়েছে, কিন্তু ওটা সেই সাহেবেরই পাওনা।” বিনুর মাস্টারমশাইদের মতে, রবীন্দ্রনাথ অসামান্য লেখক, কিন্তু তা শুধুই গদ্যে, পদ্যে বিদ্যাপতি চণ্ডীদাসের পাশে কিছু নয়। তাঁদের মোদ্দা কথা হল, ‘বৈষ্ণব কবিদের অনুকরণ করেই রবিবাবুর কবিযশ’। কিন্তু তারপর যখন রবীন্দ্রনাথ বিনু মনের আসনে এসে বসলেন তখন বন্ধুদের পরিহাস, মাস্টারমশাইদের উপহাস, আত্মীয়দের উপেক্ষা কিছুই তাকে বিচলিত করল না। সেই সময় অনেকের মতোই বিনুর মনের মধ্যেও বাসা বাঁধল অন্ধভক্তি, আবার বছর পঁচিশেক বাদে দেখা গেল অন্ধ ভক্তদের সঙ্গেও শত্রুতা তৈরি হয়ে গেছে তার। ইতিমধ্যে কবির সঙ্গে তার দেখা হয়েছে, নিজেও লিখছে সে আর রবীন্দ্রনাথও সে লেখা পড়েছেন। বিনু ধন্য হল বটে কিন্তু শুনতে হল, ‘রবীন্দ্রনাথের অনুসরণ করে যাঁরা সার্থক হয়েছেন আপনিই তাঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ’। এইখানেই সেই চিরন্তন সংকটের মধ্যে পড়ছে বিনু, রবিঠাকুরের প্রভাবেই কি কেটে যাবে তার সারা জীবন! তারপর থেকেই বিনুর সাক্ষ্যের মধ্যে আসবে প্রভাবের সঙ্গে লড়াই, লড়াইয়ের নানা মাত্রা। শেষ পর্যন্ত বিনু মনে মনে শপথ নেবে, ‘…তাঁর প্রভাবের সামনে মস্তক নত করলেও আমরা চোখ কান খোলা রাখব। বিদ্রোহ করব না, সেটা মূঢ়তা। অনুসরণ করব না, সেটা ব্যর্থতা। পুত্র যখন বয়ঃপ্রাপ্ত তখন মিত্র হয়। আমরা তাই হব। এই হল বিনুর জবানবন্দি।’ বিনুর গোটা সাক্ষ্য আসলে সেই সময়ের লেখকদের দ্বন্দ্ব আর সেই দ্বন্দ্ব থেকে উত্তরণের চেষ্টা। এ এক যথাযথ রবীন্দ্র-স্মৃতিচারণা।
আর-একটি বিতর্কের কথা উসকে দিয়েছেন অমিত সেন, তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ ও অগ্রগতি’ প্রবন্ধে, ‘আজকের দিনে প্রগতির সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক কতখানি, সম্প্রতি অনেকের মনেই এ-প্রশ্ন উঠেছে।’ বিশেষত সেই সময়ে অগ্রগতির সমার্থক ছিল সাম্যবাদের প্রতি আকর্ষণ, শ্রেণিহীন নতুন সমাজ গঠন। জলহাওয়ায় ভেসে বেড়াত, ‘…একদিকে শুনি রবীন্দ্রনাথ বঞ্চিতের কবি ছিলেন, জনসাধারণ এমনকী, প্রলেটেরিয়াটের সঙ্গে তাঁর নিগূঢ় যোগ ছিল। অন্যদিকে একথাও শুনেছি যে রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়াধর্ম্মী আভিজাত্যের প্রতীক, এমনকি শেষ পর্যন্ত তাঁকে প্রতিক্রিয়াপন্থী বল্লেও বিশেষ অন্যায় হয় না।’ রবীন্দ্রনাথের নিজের মধ্যেও যে বিশ্বাস-অবিশ্বাস আর আদর্শের দোলাচল ছিল তার উল্লেখ করে এবং বিভিন্ন পক্ষের মত পর্যালোচনা করে অমিত সেনের মনে হয়েছিল, “নাৎসি-অভ্যুত্থানের পর রলাঁ যেমন লিখেছিলেন—‘Working men, here are our hands. We are yours. Humanity is in danger’— জানি না রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তেমন কোনও কথা বলা সম্ভব ছিল কিনা। কিন্তু অশেষ সংস্কারের বেড়াজালের মধ্যে থেকেও চিরজীবন যিনি নূতন নূতন পথে এগিয়ে চলবার তীব্র আকর্ষণ অনুভব করেছিলেন, মনে হয় তাঁকে রাষ্ট্রিক ও সামাজিক অগ্রগতির পথেও সহায়ক হিসাবে ভাববার যথেষ্ট হেতু আছে।” মৃত্যুর কয়েক মাসের মধ্যে দাঁড়িয়ে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এমন লেখার এলেম খুব বেশি দেখা যায় না।
রবীন্দ্রনাথের গানের তাল নিয়ে শান্তিদেব ঘোষের লেখা একটি প্রবন্ধ এই সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আজকের প্রসঙ্গ আলাদা, কিন্তু তখনও অবধি রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে যত আলোচনা হয়েছিল, তাঁর গানে তালের বিচিত্র ব্যবহার নিয়ে খুব বেশি লেখা হয়নি। সেই অভাব শান্তিদেব পূর্ণ করলেন তাঁর গুরুদেবকে স্মরণ করে। ক্ষেত্রমোহন পুরকায়স্থের লেখা ‘বাঙ্গালার সংস্কৃতি-ধারায় রবীন্দ্রনাথ’ এই সংখ্যার ক্ষেত্রে উপযুক্ত হলেও আজ আর তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। বুদ্ধদেব বসুও তাঁর আলোচনায় দেখছি নীরবেই এড়িয়ে গিয়েছেন এই লেখাটির প্রসঙ্গ। রাণী মহলানবিশের ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’, নির্ম্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘অশীতি বর্ষের রবীন্দ্রনাথ’ এবং শ্যামলকৃষ্ণ ঘোষের ‘শান্তিনিকেতনের স্মৃতি’— তিনটিই মূলত স্মৃতিকথা। রবীন্দ্রস্মৃতি সংখ্যার পুস্তক-পরিচয় বিভাগে হিরণকুমার সান্যাল সমালোচনা করেছিলেন নীহাররঞ্জন রায়ের ‘রবীন্দ্রসাহিত্যের ভূমিকা’, বুদ্ধদেব বসুর ‘সব-পেয়েছির দেশে’ আর ধীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় আলোচনা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছড়া’ আর ‘শেষ লেখা’ নিয়ে।
এই সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথকে নিবেদিত যে তিনটি কবিতা আছে তার মধ্যে বিমলচন্দ্র ঘোষ (রবি-সূক্ত) আর সুধীরকুমার চৌধুরীর (কবির মৃত্যু) গতানুগতিক কবিতা দু’টিকে ছেড়ে নজর চলে যাবেই জীবনানন্দ দাশের ‘রবীন্দ্রনাথ’ কবিতাটির দিকে। অবশ্য কোনওদিন কোনও কাব্যগ্রন্থেই কবি জায়গা দেননি কবিতাটিকে, রয়ে গিয়েছে নিতান্তই অগ্রন্থিত। তবু কয়েকটি পঙ্ক্তি রেখে যাই আজ ব্যক্তিগত বাইশে শ্রাবণের স্মরণে, সেই প্রথম বর্ষের শোক আর শূন্যতা বছরে বছরে যেন জানান দিয়ে যায় এভাবেই:
যখন সে অফুরন্ত রৌদ্রের অনন্ত তিমিরে
উদয় ও অস্তকে এক করে দিতে ভালোবাসে;
শাদা রাজবিহঙ্গের প্রতিভায় বৈকুণ্ঠের দিকে উড়ে যায়,
হয়তো বা আমাদের মর্তপৃথিবীতে ফিরে আসে।
তাকাতে-তাকাতে সেই প্রাসাদের মেধাবী দেয়ালে
আমাদের ইহলোক বলে মনে হয়— তবু সৃষ্টির অনন্ত পরকাল।
খেলিফের প্রতি নেটিজেনের বিরুদ্ধতার কারণ তাই, আর যাই হোক, তা ‘মেয়েদের সমানাধিকারের’ দাবিতে নয়। সমস্যা অবশ্যই খেলিফের লম্বা, পেটানো পেশিবহুল চেহারা– যা বহু মানুষের মতে ‘নারীসুলভ’ নয়। অর্থাৎ, অলিম্পিক খেলার যোগ্যতা অর্জন করা ক্রীড়াবিদ পাশ করতে পারেননি আমাদের বিউটি প্যাজেন্টে। দুইক্ষেত্রেই লজ্জা আমাদের। তবুও খেলিফ জিতলেন, সোনা ছাড়া আর কীই বা পেতে পারতেন তিনি?
আমবাগানে গজল-সম্রাজ্ঞীকে গোর দেওয়া হয়ে যাওয়ার পর, রাত জেগে শাহিদ লেখেন ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে একটি কবিতা, যে কবিতাটা পরে উৎসর্গ করেছিলেন সেলিমকে। এর বেশ কয়েক বছর পর শাহিদের একটা কবিতার বই বের হয় ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে।