আলজেরিয়ায় জেন্ডার রিএসাইনমেন্ট অস্ত্রপচার বেআইনি, সমপ্রেম অপরাধ। সেখানে জন্মানো মিস্ত্রির মেয়ে খেলিফ পুরুষ শরীরে জন্মে মেয়ে হয়ে ওঠেননি। ২০২০-র অলিম্পিকে তিনি হেরেওছেন প্রতিপক্ষের কাছে, বলাই বাহুল্য, প্রতিপক্ষও মেয়েই ছিলেন। এখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহিলা বক্সিং-এ মোট পাঁচবার হেরেছেন তিনি। তাঁর বর্তমান ‘পৌরুষ’ যদি বিতর্কের বিষয় হয়, তাহলে তাঁর বিজয়ী মহিলা প্রতিপক্ষদের পরিচয় নিয়েই বা আমাদের মত কি দাঁড়ায়? আনন্দের কথা যে, অলিম্পিক কমিটি খেলিফের পাশে দাঁড়িয়েছেন, ক্ষমা চেয়েছেন ‘পৌরুষ’-এর অভিযোগ তুলে রিং ছেড়ে চলে যাওয়া কারিনিও। কিন্তু খেলিফের বিরুদ্ধে উঠে আসা বিতর্ক নগ্ন করেছে ট্রান্স-মানুষদের বিরুদ্ধে সমাজের জঘন্য অসূয়াকে, যার মূলে রয়েছে বিশ্বজোড়া পুরুষ-কেন্দ্রিকতার আফিম।
ইমেন খেলিফ, আলজেরিয়ার মহিলা বক্সার শেষমেশ অলিম্পিকে সোনা আদায় করল। কী কাণ্ডটাই না হল খেলিফকে ঘিরে, আরেকটু হলেই বাদ পড়ে যাচ্ছিল অলিম্পিক থেকে। তবে তাঁকে থামায় কে? কোনও বিতর্কের কাছেই তিনি নতিস্বীকার করলেন না। সোনা আদায় করলেন, এবং একইসঙ্গে চুপ করিয়ে দিলেন এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের আক্রশকে। কী হয়েছিল ইমেন খেলিফকে নিয়ে?
খেলিফের সঙ্গে খেলায়, অলিম্পিকের প্রথম রাউন্ডে মাত্র ৪৬ সেকেন্ডের মাথায় প্রতিপক্ষ ইতালির এঞ্জেলা কারিনি নিজের প্রশিক্ষকের কাছে জানান তিনি আর খেলায় থাকতে চান না কারণ তাঁর পক্ষে এই প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে আর খেলা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। খেলিফ অবধারিতভাবেই জয়ী ঘোষিত হন এবং পরের রাউন্ডে চলে যান। এরপর নেট জগতে হইহই পড়ে যায় খেলিফের লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে। খেলিফ নাকি ট্রান্স-মহিলা, অর্থাৎ পুরুষ-দেহে জন্ম হয়েছে, তাই গায়ে তাঁর ‘পুরুষের শক্তি’। বেচারি ইতালির কারিনি, যতই হোক মেয়ে মানুষ! পুরুষের সঙ্গে লড়াইয়ে সে কি পারে? তাই সে খান্ত দিয়েছে।
এই প্রসঙ্গে উঠে আসে ২০২৩ সালের বক্সিং বিশ্ব চাম্পিয়নশিপের কথাও, যেখানে আন্তর্জাতিক বক্সিং সংস্থার (IBA) পরীক্ষিত জেন্ডার এলিজিবিলিটি টেস্টে পাস না করার জন্য দু’বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন তাইওয়ানের লিন ইউ টিং-এর সঙ্গে বাদ পড়েছিলেন খেলিফও। এখন, এই লিঙ্গ নির্ধারণ পরীক্ষাটি কী ও কেমন, তা নিয়ে যথেষ্ট তথ্য না পাওয়ায় কেউ বলেন শরীরে XY ক্রোমোজোমের উপস্থিতির কারণে জন্মগতভবে অতিরিক্ত এড্রিনালিন তৈরি হওয়ায় খেলিফের DSD অর্থাৎ ‘ডিসর্ডার অফ সেক্সুয়াল ডিফারেন্সিয়েশন’ রয়েছে; কেউ বলেন তিনি পুরুষ, তাই তাঁর অতিরিক্ত টেস্টোস্টেরনের সামনে টিকতে পারেননি কারিনি। বিশ্বখ্যাত লেখিকা থেকে খেলাধুলোর ধারেপাশে না থাকা নারীদরদী মানুষেরা সরব হন ‘শিশ্ন সম্বলিত মেয়েদের’ পৌরুষ থেকে ‘সত্যিকারের মেয়েদের’ বাঁচানোর দাবিতে। এই সব কিছুর মধ্যে আমি বারবার পৌঁছে যাচ্ছিলাম আমাদের ‘অথ হিড়িম্বা কথা’ নাটকটি লেখার শুরুর পর্যায়ে। এক রাজনৈতিক নেতার ‘মেয়েরা পুরুষের কাজ করলে রাক্ষসগুণ প্রাপ্ত হয়’– বক্তব্যটিতে। মাঝে মাঝে আনমনে দাঁড়িয়ে পড়ছিলাম যন্তর মন্তরের ধর্নায় বসে থাকা সাক্ষী মালিক আর বিনেশ ফোগতের সামনে, যাঁদের নিয়ে আলোচনা চলছিল, এত কুস্তি করে পেশি ফুলিয়েও পুরুষের অবাঞ্ছিত ছোঁয়া থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারেনি তাঁরা। নজর এড়ায়নি যে এসবের মধ্যেই ফিলিপিন্সের ট্রান্স ম্যাস্কুলিন বক্সার হারগি বাকিয়াদান লড়ে চলেছেন অলিম্পিকে।
সিমোন দ্য বভেয়া তাঁর ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ বইতে জন্মগত লিঙ্গ ও সমাজের গড়ে দেওয়া লিঙ্গ পরিচয় নিয়ে অনেক তর্ক রেখেছেন। যে শরীর নিয়ে আমরা জন্মাই, তার ভিত্তিতে জীবনের প্রথম শ্বাসটি থেকে আমাদের বেছে দেওয়া হয় দু’টির মধ্যে যে কোনও একটি পরিচয়– হয় ছেলে, নয় মেয়ে। ভোগান্তির সেই শুরু। ছেলে আর মেয়ে – কে কেমন হবে, কী খাবে, কী পরবে বা পড়বে, কী কাজ করবে সব ছক করে দেওয়া আছে। যাঁরা তার বাইরে পরিচয় বেছে নিতে চান, অর্থাৎ শিশ্ন নিয়ে জন্মে মেয়ে হয়ে উঠতে চান, বা শরীরে যোনি থাকা সত্ত্বেও নিজেকে পুরুষ বলে পরিচয় দেন– তাঁদের জীবন, অতএব, জটিল করে তোলা হয়। মারধোর, অপমান, কটুক্তি, ‘সংশোধন-মূলক’ বলাৎকার কিছুই বাদ যায় না। স্কুল, কলেজ থেকে কাজের পরিসর– সবই কমে আসতে থাকে। যৌনাঙ্গে জন্মগত দ্বিবৈশিষ্ট নিয়ে জন্মানো ইন্টারসেক্স মানুষদের ‘হিজড়ে’ পেশায় প্রান্তিক করে ফেলার প্রথা তো চলেই আসছে। ভাবতে অবাক লাগে– এমন একটি অঙ্গ, যা জন্ম ইস্তক কাপড়ে ঢাকা থাকাই দস্তুর, তার ভিত্তিতে বেঁচে থাকার অধিকার নির্ধারিত হয়ে যায়। যাঁরা এই দুই পরিচয়ের কোনওটাতেই ঢুকতে রাজি নন, তাঁদেরও জবাবদিহি করে যেতে হয় সারাজীবন। তা, তর্কের খাতিরে এই ‘ক্যুয়ার-যাপন’-কে না হয় নিপাতনে সিদ্ধ বলেই ধরে নিলাম। কিন্তু যাঁরা নিয়ম মানলেন, একটু ভুলচুক হলে, তাঁদেরও কি ছেড়ে কথা বলে এই ‘দুই-এর আইন’?
প্যারিস অলিম্পিকের জাঁকজমক ছেড়ে একটু নিজের অভিজ্ঞতায় ফিরে আসি। পিঠ সোজা করে চলার ‘অপরাধ’-এ একবার রাস্তায় বকা খেয়েছিলাম একজন ‘শুভানুধ্যায়ী’র কাছে। হাঁটাটি আমার নাকি ‘ব্যাটাছেলের মতো’ লাগছে। পরে বহু মেয়ে বন্ধুর কাছে এই একই অভিজ্ঞতা হওয়ার কথা জানতে পেরেছি। অভিনয়ের শরীরচর্চার ক্লাসে মেয়ে-শরীরের শিক্ষার্থীদের দেখেছি, সাধারণভাবে পায়ের বুড়ো আঙুলে দাঁড়ানোর সময় একটু ভিতরের দিকে ঘুরে থাকে। অ্যানাটমি সার্থক করে তাই তাদের পাগুলো কুঁচকি থেকেই ভিতর দিকে চাপা– যেন দু’পায়ের ফাঁকে কোনও গুপ্তধন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে!
এদিকে, পুরুষদের ডান পা ডান দিকে যায়, তো বাঁ-পা বাঁ-দিকে; যাঁরা শেয়ারের অটোতে যাতায়াত করেন তাঁরা সকলেই জানেন পুরুষ যাত্রীদের ছড়ানো পদযুগলকে জায়গা করে দিতে কীরকম সিঁটকে বসতে হয় সব সময়। আবার নিত্যযাত্রী মহিলাদের ব্যাগ বুকের ওপর তোলা কিংবা হাত দু’টি দিয়ে বুক আড়াল করা স্তনযুগলকে অবাঞ্ছিত স্পর্শ থেকে বাঁচাতে, কারণ ‘ভিড়ের মধ্যে ওরকম একটু হয়েই থাকে’। এইসব সামাজিক ব্যবহার বা বলা ভালো, সামাজিক পরিসরে এই সমস্ত শারীরিক ব্যবহার অনুমোদিত করা যায়। এর অন্যথা কিছু হলেই– মানে, মেয়েটির পা দু’টি একটু বেশি ফাঁক হলে, বা ছেলেটি একটু গুটিয়ে বসলেই, তাই আমাদের মগজ ধোলাই করা ‘দুই-এর নিয়ম’ (binary) ঝাঁপিয়ে পড়ে বলে– ‘যথেষ্ট ছেলে হয়ে উঠতে পারনি’, ‘যথেষ্ট মেয়ে নও, ছেলে ছেলে ভাব’, ‘যথেষ্ট নও’, ‘যথেষ্ট নয়’।
……………………………………………………………….
২০২৩-এর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের খেলায় লিন বা খেলিফের বাদ যাওয়া তাদের ‘হঠাৎ’ পুরুষ হয়ে ওঠার কারণে যে নয়, খেলার নিয়ম মেনে– নেটিজেন সেটুকু গ্রহণ করতে পারলেই এই লেখার আর প্রয়োজন হত না। যে সময়ে এই লেখা লিখছি, তখনই ১০০ গ্রাম ওজন বাড়ার কারণে পদক জেতার লড়াই থেকে বাদ পড়েছেন বিনেশ ফোগত। এ-কথা উল্লেখের কারণ– মাত্র ১০০ গ্রাম ওজন, যেটুকু প্রস্রাব করলে কমে যেতে পারে বলে তর্ক করা যায়– সেটুকুও যখন নিয়মে আটকায়, তখন কতটুকু বেশি টেস্টোস্টেরন লিন আর খেলিফকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে জেন্ডার কোয়ালিফাই করতে দেয়নি– তাই নিয়ে তর্ক যে ধোপে টেকে না, তা বলাই বাহুল্য।
………………………………………………………………..
টেস্টোস্টেরন হরমোন যেহেতু পেশিগঠনে বিশেষ ভূমিকা নেয়, এবং ছেলেদের দাড়ি-গোঁফ গজাতে তা সাহায্য করে– তাই আমরা সামাজিকভাবে মেনে নিয়েছি ছেলেদের পেশিশক্তি মেয়েদের থেকে বেশি। তাই পেশি গজানো মেয়ে সাক্ষী বা বিনেশের যৌন হেনস্থা প্রসঙ্গে আমাদের বিস্ময়ের সীমা ছিল না। পেশি যখন আছে, তখন তো ছেলেই বলা চলে, তাই দু’ঘা দিল না কেন? এত ‘ছেলে ছেলে মেয়েদেরও’ যৌন হেনস্থা হয়? ব্যাটাছেলের মতো পেশি গজিয়ে লাভ কি হল, গায়েই যদি হাত পড়ল– কত বিতর্ক আমাদের। ভুলে গেলাম, ওই পেশি অলিম্পিকে পদক জেতার জন্য তৈরি করেছিলেন ক্রীড়াবিদরা– পদক এনেওছিলেন তাঁরা। শেষ অবধি থাকার মধ্যে দুই পায়ের ফাঁকে রয়ে গেল সেই যোনি– যার উপস্থিতি পেশাদার সাফল্য অতিক্রম করে সামাজিক অধিকার নির্ধারণ করে দেয়। খালি পেটে ইঁটের বোঝা বওয়া মহিলা শ্রমিক থেকে, রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ করা মেয়েরা, পাতা-কুড়ুনি মেয়েরা, চার মাইল দূর থেকে কলসি-কলসি জল বয়ে আনা মেয়েরা, ছাত পেটাতে পেটাতে বাচ্চার জন্ম দিয়ে আবার কাজ করতে আসা মেয়েরা– সব্বাই বিশ্বাস করে যে তাদের পেশিশক্তি পুরুষদের থেকে কম।
বাণী কে বড়ুয়ার গবেষণায় ১ থেকে ২ বছরের শিশুদের মধ্যেই লিঙ্গের ভিত্তিতে টীকাকরণ ও পুষ্টিগত প্রভেদ ধরা পড়েছে, ছেলেরা পুষ্টিকর খাদ্য পায়, মেয়েরা জন্ম থেকেই পায় না, কারণ তাদের পেশির প্রয়োজন নেই। ২০২৩-এর সরকারী এমপ্লয়মেন্ট স্ট্যাটিস্টিক্স এর বিবৃতি অনুযায়ী, একই পরিমাণ কায়িক শ্রম করে ভারতের দিনমজুর মেয়েরা রোজগার করেন পুরুষদের প্রায় অর্ধেক, কারণ– ধরে নেওয়া হয় পুরুষরা তাঁদের পেশিশক্তিতে বেশি কাজ করবেন আর মেয়েরা কম। টেস্টোস্টেরনের কি মহিমা!
অতএব, কতটা টেস্টস্টেরন থাকলে একটি মেয়ে বক্সিংয়ের মতো শারীরিক নৈকট্যের খেলায় ‘মেয়ে’ হিসেবে যোগ দিতে পারবেন, তাও নির্ধারিত। সমস্যা হল, শরীর আর তার শারীরবৃত্তীয় নিয়মকানুন সমাজ মেনে চলে না। তাই পেশির চর্চা হলে পেশি বাড়ানোর হরমোন নিজে নিজেই শরীরে উৎপাদিত হয়। তাই ২০২৩-এর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের খেলায় লিন বা খেলিফের বাদ যাওয়া তাদের ‘হঠাৎ’ পুরুষ হয়ে ওঠার কারণে যে নয়, খেলার নিয়ম মেনে– নেটিজেন সেটুকু গ্রহণ করতে পারলেই এই লেখার আর প্রয়োজন হত না। যে সময়ে এই লেখা লিখছি, তখনই ১০০ গ্রাম ওজন বাড়ার কারণে পদক জেতার লড়াই থেকে বাদ পড়েছেন বিনেশ ফোগত। এ-কথা উল্লেখের কারণ– মাত্র ১০০ গ্রাম ওজন, যেটুকু প্রস্রাব করলে কমে যেতে পারে বলে তর্ক করা যায়– সেটুকুও যখন নিয়মে আটকায়, তখন কতটুকু বেশি টেস্টোস্টেরন লিন আর খেলিফকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে জেন্ডার কোয়ালিফাই করতে দেয়নি– তাই নিয়ে তর্ক যে ধোপে টেকে না, তা বলাই বাহুল্য। এবং তা নিঃসন্দেহেই লিন বা খেলিফের মেয়ে পরিচয়ের পরিপন্থী নয় কোনওভাবেই। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার যে, ২০১৯ সাল থেকে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি IBA-কে দুর্নীতির অভিযোগে অপেশাদার বক্সিং-এর সর্বোচ্চ সংস্থার মান্যতা থেকে বিতাড়িত করেছে। তাই তাদের ২০২৩-এর বিবৃতি কতখানি গ্রহণযোগ্য, তা পাঠকই বিচার করুন।
………………………………………………………..
আরও পড়ুন অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: রক্তদানেও ‘আমরা-ওরা’ মানসিকতা অসহিষ্ণুতার বার্তা বয়ে আনছে
………………………………………………………..
আলজেরিয়ায় জেন্ডার রিএসাইনমেন্ট অস্ত্রপচার বেআইনি, সমপ্রেম অপরাধ। সেখানে জন্মানো মিস্ত্রির মেয়ে খেলিফ পুরুষ শরীরে জন্মে মেয়ে হয়ে ওঠেননি। ২০২০-র অলিম্পিকে তিনি হেরেওছেন প্রতিপক্ষের কাছে, বলাই বাহুল্য, প্রতিপক্ষও মেয়েই ছিলেন। এখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মহিলা বক্সিং-এ মোট পাঁচবার হেরেছেন তিনি। তাঁর বর্তমান ‘পৌরুষ’ যদি বিতর্কের বিষয় হয়, তাহলে তাঁর বিজয়ী মহিলা প্রতিপক্ষদের পরিচয় নিয়েই বা আমাদের মত কি দাঁড়ায়? আনন্দের কথা যে, অলিম্পিক কমিটি খেলিফের পাশে দাঁড়িয়েছেন, ক্ষমা চেয়েছেন ‘পৌরুষ’-এর অভিযোগ তুলে রিং ছেড়ে চলে যাওয়া কারিনিও। কিন্তু খেলিফের বিরুদ্ধে উঠে আসা বিতর্ক নগ্ন করেছে ট্রান্স-মানুষদের বিরুদ্ধে সমাজের জঘন্য অসূয়াকে, যার মূলে রয়েছে বিশ্বজোড়া পুরুষ-কেন্দ্রিকতার আফিম।
পুরুষ-কেন্দ্রিকতা দাবি করে পুরুষ শ্রেষ্ঠ লিঙ্গ, শুধু পেশিশক্তিতে নয়, বিদ্যায়, বুদ্ধিতে– সব ক্ষেত্রে। তাই মেরি কুরির প্রথম গবেষণা নোবেল কমিটি অবধি পৌঁছতে পিয়ের কুরির নাম জুড়তে হয়, মাধ্যমিকের ফল বেরলে খবরের কাগজের ফুটনোটে লেখা হয় ‘মেয়েদের মধ্যে প্রথম’ ছাত্রীর নাম। তাই সিনেমার নায়ক থেকে পাড়ার বালক বন্ধু ‘মেয়েদের গায়ে হাত তোলেন না’; আর তাই-ই খেলিফের মত লিঙ্গপরিচয় নিয়ে প্রশ্নবোধক সংস্থার প্রশ্নবোধক পরীক্ষার বিতর্কে জড়িয়ে পড়া বক্সারকে– ‘ও ছেলে, তাই আমি ওর সঙ্গে খেলতে পারব না’ বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়। আহা, যেন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে শিখণ্ডীর সামনে পড়ে যাওয়া শূরবীর ভীষ্ম! তাই যদি গ্রহণযোগ্য হয়, তাহলে ভিন্ন যৌন পরিচয়ে জন্মানো পুরুষ বক্সার হারগি-কে নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয় না কেন? তিনিও মেয়ে শরীরে জন্মেছিলেন, এখন জন্মগতভাবে পুরুষ বক্সারদের সঙ্গেই লড়ছেন অলিম্পিকে! নাকি সেখানে পুরুষদের সঙ্গে খেলায় পরাস্ত হলে তাঁকে বুঝিয়ে দেওয়া যাবে, ‘প্রকৃত পুরুষ’ কাকে বলে! তাই নেটিজেনের ভাষায়, ‘পুরুষোচিত’ খেলিফের ওপরেই ঝাল মেটাচ্ছি আমরা!
যৌনপরিচয় যাই হোক, দুইয়ের নিয়ম যাঁরা সচেতনভাবে উল্টে দেন, যাঁরা সে-নিয়মে ঢুকতে চান না বা যাঁরা সেই নিয়মের হিসেব মতো ‘লাগেন না’ তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয় সমাজের কোণের দিকে। পরম ‘শিশ্নের বরদান’ নিয়ে যাঁরা জন্মেছেন, তাঁদের কেউ যদি শিশ্নহীন শরীরের সামাজিক ব্যবহার ও লিঙ্গ পরিচয় গ্রহণ করেন, তাঁদের ওপর অশ্রদ্ধার ভাব বেড়ে ওঠে। এমন সুবিধা ও প্রাধান্য পায়ে ঠেলে তাঁরা কি না মেয়েমানুষ হয়ে উঠতে চাইছে? ট্রান্স-মহিলাদের প্রতি প্রকাশিত অশ্রদ্ধা, যা এই বিতর্কে অপাবৃত হল, তার এক উৎস এই প্রজন্ম-লালিত নারীবিদ্বেষও। খেলিফের প্রতি নেটিজেনের বিরুদ্ধতার কারণ তাই, আর যাই হোক, তা ‘মেয়েদের সমানাধিকারের’ দাবিতে নয়। আর অন্য সমস্যা অবশ্যই খেলিফের লম্বা, পেটানো পেশিবহুল চেহারা– যা বহু মানুষের মতে ‘নারীসুলভ’ নয়। অর্থাৎ, অলিম্পিক খেলার যোগ্যতা অর্জন করা ক্রীড়াবিদ পাশ করতে পারেননি আমাদের বিউটি প্যাজেন্টে। দুইক্ষেত্রেই লজ্জা আমাদের।
………………………………………………………..
আরও পড়ুন অরিঞ্জয় বোস-এর লেখা: নিয়তির ওজন ১০০ গ্রাম, পদকহীন বিনেশ তবু জিতলেন অসংখ্য হৃদয়
………………………………………………………..
রূপান্তরিত ও রূপান্তরকামী লিঙ্গ পরিচয়ের মানুষরা তাঁদের স্বীকৃতির লড়াই জারি রেখেছেন বিশ্বব্যাপী, তাঁদের হয়ে কথা বলার এক্তিয়ার বা দাবি আমার নেই। তাঁদের এই লড়াই মূলগতভাবে জন্মগত শরীরের যৌন পরিচয়ের নিরিখে সামাজিক অধিকার বেঁধে দেওয়ার পিতৃতান্ত্রিক ও পুরুষকেন্দ্রিক ব্যবস্থাকে ঝটকা দিচ্ছে। দুইয়ের নিয়মে শোষিত এবং নিয়মের বাইরে থাকা বহু মানুষকে সুযোগ করে দিচ্ছে আত্মপরিচয়ে মাথা তুলে দাঁড়ানোর। কিন্তু দুইয়ের নিয়ম ও ট্রান্সফোবিয়া যে কী ভয়ঙ্করভাবে আমাদের মজ্জাগত, খেলিফের বিরুদ্ধে উঠে আসা আন্তর্জাতিক বিতর্কের বহরেই তার আঁচ পাওয়া যায়। আশা করব, খেলিফের পদকজয় সেই ভয়ঙ্কর বৈষম্যের বিরুদ্ধে ট্রান্স, ক্যুয়ার ও মেয়েদের লড়াইকে আরও অনুপ্রেরণা দেবে।
………………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
………………………………………………