ঊষা উত্থুপ ‘উরি উরি বাবা’ গেয়ে ওঠায়, নাইট শো-এর মাঝেই বাম নেতারা একে একে দর্শকাসন ছাড়তে থাকলেন। আশ্চর্য, ‘হাওয়া হাওয়াই’ যে বিতর্ক তোলেনি, এই গান সেই ঝামেলা বাঁধাল। তৎকালীন পিডব্লিউডি মন্ত্রী, জ্যোতি বসুর পুত্রকে নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে যাঁকে মন্ত্রিত্ব খোয়াতে হয়েছিল আর বছর দুয়েকের মাথায়, সেই যতীন চক্রবর্তী সরাসরি একে ‘অপসংস্কৃতি’ বলে দেগে দিয়েছিলেন। বন্দুকের নলের সামনে সরাসরি পড়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন যুবকল্যাণ ও ক্রীড়া দপ্তরের মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী, বাম সাংস্কৃতিক পরিসর আদৌ ভালোভাবে নেয়নি সেই উদ্যোগ।
হু হু হাওয়ার মতোই ‘জাগো জাগো সর্বহারা’ আকাশ-বাতাসে মর্মরিত হচ্ছে, শহরের চূড়ায় চূড়ায় সদর্পে উড্ডীন হচ্ছে লাল পতাকা, রাইটার্সের অলিন্দে ধ্বনিত হচ্ছে এতদিনের রাস্তায় ও মঞ্চে দেখা নেতাদের দৃপ্ত পদচারণা– এমন বহু স্বপ্নই লালিত হতে হতে বিস্ফার ঘটেছিল, ১৯৭৭ সালে। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসা কেবলই রাজনৈতিক ঘটনা ছিল না, বঙ্গজনের সাংস্কৃতিক অভিমুখও কিছুটা সূচিত হয়েছিল এই ঐতিহাসিক বাঁকে এসে দাঁড়িয়ে। বর্গা আইন, ভূমিসংস্কার, মরিচঝাঁপি-বিজন সেতু বিতর্কের পাশাপাশি তাই ‘নন্দন’-এর গোড়াপত্তন, আরেকটু পরে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবের সূত্রপাত, বইমেলার বিকশিত হয়ে ওঠার মতো বড় বড় কিছু ঘটনার পাশাপাশি চলচ্চিত্র-নাটক-সংগীতের-সংগীতের রুচি সম্পর্কে এক নব্য সাংস্কৃতিক বোঝাপড়াও শুরু হচ্ছিল। আটের দশক সেদিক থেকে এক আশ্চর্য সন্ধিক্ষণ।
সদ্য-প্রকাশিত ‘রোববার’ পত্রিকায় (৪ আগস্ট, ২০২৪) অমিত রঞ্জন বিশ্বাস সংকলিত ‘চিত্তির মিত্তির’ কলামে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের দিনলিপি অংশটি থেকে একটি উদ্ধৃতি তুলে দেওয়া প্রাসঙ্গিক হবে, ‘‘এখুনি ‘অমর আকবর অ্যান্টনি’ দেখে এলাম। অনেক কাল হিন্দি ছবি দেখিনি। পুজোর ছুটি, ঘরবন্দি রয়েছি– সকলে মিলে যাওয়া গেল।… এই ছবিটা দেখে আপাতত একটু উপকার হল– হিন্দি ছবি সম্পর্কে আমার ঘৃণাটা পাতলা হওয়া দূরস্থান, আরও তীব্র হল।… কিন্তু ছবি দেখে বাড়ি এসে প্রথমটায় মনে হচ্ছিল, এর পর্বতপ্রমাণ অবাস্তবতা এবং হাস্যকরতা সম্পর্কে কিছু লিখে রাখি। ছবিগুলো যে কী ধুরন্ধর কায়দায় লোক ঠকাচ্ছে, লোক পচাচ্ছে, তার একটা হিসেব করার ইচ্ছে হচ্ছিল। কিন্তু এখন খাতা খুলে বসতে মনে হল, এসব জিনিস কি এতটা মনোযোগ পাওয়ার যোগ্য?’’ (২৫.১০.১৯৭৭) বঙ্গজ বৈদগ্ধ্যের অন্যতম প্রতিনিধি হিসেবে সৌমিত্র চাটুজ্জের কথাগুলোর মূল্য এখানেই, ‘গ্রুপ থিয়েটার আর অ্যাকাডেমি সমাচার’-এ মগ্ন বাঙালি মনন হিন্দি জনসংস্কৃতির এই আধিপত্যবাদকে তখন সমূলে প্রত্যাখ্যান করছে।
অন্যদিকে, আশি থেকে বাংলা ছবিতেও ধীরে ধীরে জনপ্রিয়-র সংজ্ঞা বদলাচ্ছে। দারোগা শুভঙ্কর সান্যালের বেশে রঞ্জিত মল্লিকের এন্ট্রি বাংলা ছবির এতদিনের আঞ্চলিক ভাষ্যে বড়সড় বিচ্যুতি। পরবর্তীতে বাংলা ছবিতে এই নামটা এমনই কাল্ট হয়ে উঠবে, যার দরুন, রঞ্জিত মল্লিক এই একই নামে আদর্শবাদী ডাক্তারও হয়ে উঠবেন (‘জীবন নিয়ে খেলা’)। কিন্তু অঞ্জন চৌধুরীর কপবিশ্ব বা দীর্ঘ বউ সিরিজ যাহবা বাঙালির কিছুটা নিজস্ব ছিল, পরবর্তীতে তা সম্পূর্ণ জবরদখল হবে ‘অ-বঙ্গীয়’ (মূলত মুম্বইকেন্দ্রিক) হঠাৎ আলোর সাংস্কৃতিক ঝলকানিতে। বৃদ্ধ কালী বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাহাকার হোক, মার খাওয়া নায়ক তাপস পাল হোক, হিপহপ-মার্কা ভিলেন সৌমিত্র বন্দ্যোপাধ্যায় হোক– এসবই বাঙালির অন্তরে কোথাও না কোথাও ছিল। হয়তো উচ্চমার্গীয় সাংস্কৃতিক উচ্চারণের সঙ্গে তার যোজন যোজন দূরত্ব ছিল, কিন্তু তার অস্তিত্ব ছিলই। এমনকী, বঙ্গীয় চলচ্চিত্র-মানসে যে ছবি রীতিমতো ‘কালচারাল শক’-এর কারণ হয়ে উঠল, সেই ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ (অন্তর্ঘাত শুরু হয়েছিল বানান থেকেই)– তাও কিন্তু দিনের শেষে বাংলাদেশের মাল। সন্ধ্যা রায়ের তুমুল মেলোড্রামায় ‘বাবা তারকনাথ’-এর অন্ত্যজ বয়ান তৈরি হয়েছে তারও একযুগ আগে, বাংলা ছবির স্বর্ণযুগ তখনও ফুরয়নি।পরবর্তীতে সেই বয়ানের সূত্র ধরেই তারকনাথ, মনসা, শেতলা-রা বাংলা ছবির ‘অবস্কিওর রিলিজিয়াস কাল্ট’ হয়ে উঠবে। উল্লেখ্য, এই আটের দশকেই সাবঅলটার্ন স্টাডিজের উত্থান ঘটেছে সারস্বত ভুবনে।
মোদ্দায়, এত অবধি বাংলা ছবির নিজস্ব রংবাজি ছিল। তারপর কী ঘটল, জানে শ্যামলাল! কিন্তু এই আটের দশকের আরও একটি বড় ঘটনা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল, যার নাম, ‘হোপ এইট্টি সিক্স’। সেই বিপুল সাংস্কৃতিক ঝিনচ্যাকে বলিউড তারকারা উজাড় হয়ে নামল কলকাতায়। সেসময় ‘ইন্ডিয়া টুডে’ পত্রিকায় সাংবাদিক ইন্দ্রনীল বন্দ্যোপাধ্যায় খানিকটা দুঃখ করেই লিখেছিলেন, ‘এই তো কয়েক দশক আগে অবধিও কে. এল. সায়গল ঘুরে বেড়াতেন ঢাকুরিয়া লেকের পাশে, পৃথ্বীরাজ কাপুর-সহ বলিউডের তাবড় বাঘরা চৌরঙ্গীতে চক্কর কাটতেন। এখন তো একজন তারকা এলেই তা খবর হয়ে যায়!’ এই প্রতিবেদনের সময় আদতে মিঠুন চক্রবর্তী, শত্রুঘ্ন সিনহা-রা আসছেন জ্যোতি বসুর কাছ থেকে বলিউডের কলাকুশলীদের সাহায্যার্থে একটি ফান্ড রেজিং অনুষ্ঠান, যার পোশাকি নামই হবে হোপ এইট্টি সিক্স। মধ্যস্থতায় ছিলেন সুভাষ চক্রবর্তী। প্রতিবেদন মোতাবেক, এই অনুমোদন নেওয়ার যাতায়াতেই শহরজুড়ে বিপুল যানজট সৃষ্টি হয়েছিল।
অবশেষে সল্টলেক স্টেডিয়ামে সেই ছিয়াশির আশালতা বিকশিত হল। লতা, কিশোর গাইলেন ‘গাতা রহে মেরা দিল’, কণ্ঠ মেলালেন আশা ভোঁসলে। রাজ কাপুর, দেব আনন্দ থেকে মিঠুন, অমিতাভ, বলিউডের কয়েক প্রজন্ম জড়ো হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে। তবে এই তামঝামেও নজর কেড়েছিল প্রধানত দু’টি অধ্যায়। এক নম্বর, এই অনুষ্ঠানেরও মাসকয়েক পর মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’-র প্রচার-কৌশল হিসেবে, ছবির আগেই, তাঁর গোটা চলচ্চিত্রজীবনের অভূতপূর্ব ও আইকনিক হিট নম্বর ‘হাওয়া হাওয়াইই’-এ নাচলেন এর ঠিক তিন বছর আগের ছবি ‘হিম্মতওয়ালা’-র সূত্রে বলিউডের নয়া হার্টথ্রব হয়ে ওঠা নায়িকা, শ্রীদেবী। এই ছবির নায়ক, এর ঠিক দু’-বছর আগেই মুক্তি পাওয়া ‘মশাল’ ছবির সূত্রে তারকা হয়ে ওঠা অনিল কাপুর। যদিও সেদিন স্টেজে শ্রীদেবীর সঙ্গে পা মিলিয়েছিলেন জিতেন্দ্র। ওই জনঢলে যারা এই হিট গান ও প্রায় কালজয়ী হয়ে ওঠা নাচের আগাম সাক্ষী ছিল, তারা পরবর্তীতে যথেষ্ট কলার তুলেছিল, যখন হলে ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’ দেখতে গিয়ে শ্রীদেবীর নাচে চোখ ধাঁধাচ্ছিল বাকিদের।
এর মধ্যে একটা ছোটখাটো কেলেঙ্কারি হল। যা পূর্বে উল্লিখিত দু’টি অধ্যায়ের দ্বিতীয় ঘটনা। ঊষা উত্থুপ ‘উরি উরি বাবা’ গেয়ে ওঠায়, নাইট শো-এর মাঝেই বাম নেতারা একে একে দর্শকাসন ছাড়তে থাকলেন। আশ্চর্য, ‘হাওয়া হাওয়াই’ যে বিতর্ক তোলেনি, এই গান সেই ঝামেলা বাঁধাল। তৎকালীন পিডব্লিউডি মন্ত্রী, জ্যোতি বসুর পুত্রকে নিয়ে বেফাঁস মন্তব্য করে যাঁকে মন্ত্রিত্ব খোয়াতে হয়েছিল আর বছর দুয়েকের মাথায়, সেই যতীন চক্রবর্তী সরাসরি একে ‘অপসংস্কৃতি’ বলে দেগে দিয়েছিলেন। বন্দুকের নলের সামনে সরাসরি পড়ে গিয়েছিলেন তৎকালীন যুবকল্যাণ ও ক্রীড়া দপ্তরের মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী, বাম সাংস্কৃতিক পরিসর আদৌ ভালোভাবে নেয়নি সেই উদ্যোগ। তাঁর মানসপুত্র মিঠুনের দরুনই সুভাষ চক্রবর্তী এই আয়োজন করেছিলেন তখন। যদিও নিজের মানসপুত্রর পাশে দাঁড়ান তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। তিনিও স্পষ্টাস্পষ্টি বলে দেন, এর মধ্যে তিনি অপসংস্কৃতির কিছুই দেখেননি।
তবে বলিউডের সঙ্গে কলকাতার বোঝাপড়া যে অনেকটা খুল্লমখুল্লা হয়ে পড়েছে, তা প্রতীয়মান হতে শুরু করেছিল, এই সংস্কৃতি বনাম অপসংস্কৃতির বিতর্কসূত্র থেকেই। এর চার বছর পর ‘অগ্নিপথ’-এর চ্যারিটি প্রিমিয়ার আয়োজিত হয় নন্দন-এ। সেসময়ের কলকাতাতেও ঢল নামে বিগ বি, জয়া বচ্চন ও মিঠুন চক্রবর্তীকে দেখার জন্য, কার্যত অচল হয়ে যায় রাস্তা। পুলিশকে এন্তার লাঠি চালাতে হয়। প্রসঙ্গত, সেসময় পশ্চিমবঙ্গের তথ্য সংস্কৃতি মন্ত্রীর নাম বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, অন্য সংস্কৃতির ধারার প্রতিনিধি হয়ে যিনি থেকে যাবেন, তাঁর রাজনৈতিক জনপ্রিয়তার সমান্তরালেই।
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২৫। চুল কাটলেই মাথার পিছনে জ্যোতির মতো বাজবে ‘শান’-এর গান!
পর্ব ২৪। মরণোত্তর উত্তমকুমার হয়ে উঠলেন সিরিয়াল কিলার
পর্ব ২৩। স্কুল পালানো ছেলেটা শহিদ হলে টিকিট কাউন্টার, ব্ল্যাকাররা তা টের পেত
পর্ব ২২। ক্যাবলা অমল পালেকরের চোস্ত প্রেমিক হয়ে ওঠাও দর্শকেরই জয়
পর্ব ২১। বন্দুকধারী জিনাতকে ছাপিয়ে প্রতিরোধের মুখ হয়ে উঠলেন স্মিতা পাতিল
পর্ব ২০। হকার, হোটেল, হল! যে কলকাতার মন ছিল অনেকটা বড়
পর্ব ১৯। দেওয়ালে সাঁটা পোস্টারে আঁকা মধুবালাকে দেখে মুগ্ধ হত স্কুলপড়ুয়া মেয়েরাও
পর্ব ১৮। পানশালায় তখন ‘কহি দূর যব’ বেজে উঠলে কান্নায় ভেঙে পড়ত পেঁচো মাতাল
পর্ব ১৭। গানই ভেঙেছিল দেশজোড়া সিনেমাহলের সীমান্ত
পর্ব ১৬। পুলিশের কাছেও ‘আইকনিক’ ছিল গব্বরের ডায়লগ
পর্ব ১৫। ‘শোলে’-র চোরডাকাতরা এল কোথা থেকে?
পর্ব ১৪। ‘শোলে’-তে কি ভারত আরও আদিম হয়ে উঠল না?
পর্ব ১৩। ‘জঞ্জির’ দেখে ছেলেটা ঠিক করেছিল, প্রতিশোধ নেবে
পর্ব ১২। ‘মেরে পাস মা হ্যায়?’-এর রহস্যটা কী?
পর্ব ১১। ইন্দ্রজাল কমিকস-এর গ্রামীণ নায়ক বাহাদুর পাল্পে এসে রংচঙে হল
পর্ব ১০। দু’টাকা পঁচিশের টিকিটে জমে হিরোইনের অজানা ফ্যানের স্মৃতি
পর্ব ৯। খান্না সিনেমায় নাকি পৌরাণিক সিনেমা চলছে
পর্ব ৮। পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে মিলে গেলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না
পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা
পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল