কোনও অনুমতি, কোনও কাগজ, কোনও সম্মতি, কোনও আলোচনা, কোনও সন্ত্রাসের প্রতিক্রিয়া ছাড়াই একেবারে বনদফতরের উপস্থিতিতে জ্বলন্ত লোহার শলা গেঁথে দেওয়া হল হাতির পিঠে। হত্যার পরিকল্পনা আগাম না থাকলে জ্বলন্ত লোহার শলাই বা ঘটনাস্থলে কেন নিয়ে যাওয়া হল, সে প্রশ্নের উত্তরও নেই কোথাও। একটু একটু করে পিছনের পা দুমড়ে-মুচড়ে যখন বসে পড়ছে হাতিটা, প্রাণান্তকর বৃংহনে ভরে যাচ্ছে মাটিপৃথিবীর দিকবিদিক, সঙ্গের ছোট্ট হস্তিশাবকটি ভয়ে, আতঙ্কে প্রাণপণ ছুটে বেরোনোর চেষ্টা করছে জল্লাদপুরীর বাইরে, সেই সময়ে একটা কচি গলা শুধু শোনা যাচ্ছিল পাশ থেকে– “বাবা, ওর কষ্ট হচ্ছে তো বাবা! ওকে ছেড়ে দাও, ও তো মরে যাবে, বাবা-আ-আ!”
মানুষ কতটুকু বাঁচবে আর কতটা বাঁচাবে, সেই হিসেবই চলে মাথার মধ্যে সারাক্ষণ। শুধু হিসেব চলে বললে ভুল হবে, আসলে সেই হিসেবটা বাইরে কতটা আড়াল করে রাখা যায়, জিন্দেগিভর সেই চেষ্টা। ট্র্যাফিক দুর্ঘটনা যেমন। অধিকাংশ দুর্ঘটনা নাকি ঘটে, মানুষের বাঁচাতে চাওয়ার রিফ্লেক্স থেকে। হ্যাঁ, শেষ মুহূর্তের আচমকা সিদ্ধান্ত, যার ওপরে সচেতন যুক্তিপ্রবাহের প্রায় কোনও প্রভাব নেই, মুহূর্তের দমক যা করিয়ে নেয় মানুষকে দিয়ে, ফ্রয়েডীয় স্লিপের মতো সেইসব হঠাৎ প্রবণতার মধ্যেও আসলে শেষ পর্যন্ত মানুষ নাকি খুন করতে চায় না। প্রজাতির জৈবিক নিয়ম তার জিনে যে পরিশীলন গেঁথে দিয়েছে, তা মানুষকে করে তুলেছে হত্যাবিরোধী, প্রাণের পক্ষে চিরকালীন সওয়ালদার।
যদি তাই হবে, তাহলে এত রক্ত কেন? এই যে ঝাড়গ্রামের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পড়া সন্তানসম্ভবা হাতিটির অ্যানাল গ্ল্যান্ডের মধ্যে দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হল জ্বলন্ত লোহার শিক, কেন? কোনও একজন খুনে হামলাদারের তত্ত্বও তো ধোপে টিকছে না! গোটা ঘটনাটা ঘটেছে প্রকাশ্য দিবালোকে, রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়ে, লোক জড়ো করে, সর্বোপরি বাঁকুড়া নর্থ ডিভিশনের ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার উমর ইমাম-এর নজরদারি ও তত্ত্বাবধানে! অর্থাৎ, মানুষের রক্তের অন্তর্গত প্রাথমিক প্রবৃত্তি যা-ই হোক না কেন, যুক্তি আর ভাবনাচিন্তার অবকাশ তাকে দিয়ে করাতে পারে না, এমন কিছুই নেই। হত্যাকে, খুনকে, অপরাধকে নীতিসম্মত করে তোলার জন্য, ন্যায়রাজি করে তোলার জন্য ব্যক্তিগত বিচার আর সমষ্টিগত সমর্থন দরকার পড়ে মানুষের। প্রতিটি অপরাধের নিজস্ব ব্যাখ্যা থাকে অপরাধীর তরফে, কখনও সে বয়ান প্রকাশের সাহস তার থাকে, কখনও থাকে না। কিন্তু সমষ্টির সম্মিলিত আয়োজনে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হল ঝাড়গ্রামে, তার বয়ানটি ঠিক কী?
ঝাড়গ্রামের লোকালয়ে হাতির ঢুকে পড়ার ঘটনা কোনও অচানক বে-আন্দাজি বজ্রপাত নয় কিন্তু! দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকায় এলিফ্যান্ট করিডোর-এর সীমানা লঙ্ঘন করে নগর তার থাবা ছড়িয়েছে, ‘ল্যান্ড এনক্রোচমেন্ট’-এর বাদীপক্ষদের যেহেতু চারটে পা আর লেজ আছে, তাই তাদের কাঠগড়ায় বিচার চাওয়ার আইনও নেই। খাবারের খোঁজ, ঘাসমাটির জঙ্গলে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বর্ষায় জলের তলায় চলে যাওয়া অঞ্চল, সর্বোপরি এক জঙ্গল থেকে আর-এক জঙ্গলে যাওয়ার পথে পড়ে-যাওয়া লোকালয়ে ঢুকে-পড়া– এসব চলতেই থাকে। স্থানীয় ‘হুলা পার্টি’-র স্থায়ী অস্তিত্বই প্রমাণ করে যে, হাতির হানা এখানে কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা নয়। শোনা যায়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মোটা পারিশ্রমিকের অবৈধ বিনিময়ে এদের নিয়োগ করা হয় কাজে। চিৎকার, আগুন জ্বালা, তাসা বাজানো, ভয় দেখানো এবং অবশ্যই সম্মিলিত তাড়া– এইসবের সমন্বয়ে একটা ভয়াবহ পরিবেশ তৈরি করে হাতি তাড়ানোই এদের কাজ। খেয়াল করে দেখুন, বিতাড়নজনিত এইসব উপকরণ বা পদ্ধতি আয়ত্ত করার জন্য সেই অর্থে কিন্তু কোনও প্রশিক্ষণের প্রয়োজনই নেই। শুধু দরকার একটা সম্মিলিত উৎসাহ, দলগত অংশগ্রহণ, জমকালো ঝঞ্ঝাট গড়ে তোলার মতো উত্তেজক পরিস্থিতি আর প্রাণ হারানোর মতো পরিস্থিতিরও মোকাবিলা করার উপযোগী সাহস।
……………………………………………………………………………………..
ঝাড়গ্রামের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে পড়া সন্তানসম্ভবা হাতিটির অ্যানাল গ্ল্যান্ডের মধ্যে দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হল জ্বলন্ত লোহার শিক, কেন? কোনও একজন খুনে হামলাদারের তত্ত্বও তো ধোপে টিকছে না! গোটা ঘটনাটা ঘটেছে প্রকাশ্য দিবালোকে, রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়ে, লোক জড়ো করে, সর্বোপরি বাঁকুড়া নর্থ ডিভিশনের ডিভিশনাল ফরেস্ট অফিসার উমর ইমাম-এর নজরদারি ও তত্ত্বাবধানে! অর্থাৎ, মানুষের রক্তের অন্তর্গত প্রাথমিক প্রবৃত্তি যা-ই হোক না কেন, যুক্তি আর ভাবনাচিন্তার অবকাশ তাকে দিয়ে করাতে পারে না, এমন কিছুই নেই।
……………………………………………………………………………………..
এই মূলধনগুলোর ওপরে নির্ভর করে এরা যখন হাতি তাড়ানোর মতো পূতপবিত্র মানবজাতির উন্নয়নকল্পে নির্ধারিত কর্মযজ্ঞে নামে, অবশ্যই এদের বীরত্ব আর সাফল্যের শামিয়ানার নীচে দর্শক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে প্রচুর, প্রচুর লোক। যারা এই বীরত্বের প্রদর্শনীতে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে পারার মতো ঝুঁকি নিতে পারে না, কিন্তু গ্যালারির সমর্থক হয়ে থাকতে থাকতে একসময় অজান্তেই ঢুকে পড়ে চিত্রনাট্যে। এরকম অলীক নাট্যাভিনয় ঝাড়গ্রামের পল্লিপৃথিবীতে ঘটে গেছে অনেকবার। দলগত উল্লাস, জিঘাংসু উচ্ছ্বাস, দু’-পেয়ের মাথার জোর আর কলাকৌশলের ওপরে ভিত্তি করে দশগুণ শক্তিশালী চারপেয়েদের পিছু হটাতে পারার সাফল্যের নির্যাস সবটুকু মিশে থাকে এইসব প্রদর্শনীতে। কিন্তু, বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, হ্যাঁ, এখনও বিশ্বাস করতে কষ্টই হয় যে, এই উল্লাসের মধ্যেই কোথাও সেদিনও মিশে ছিল একটা জলজ্যান্ত বিরাট প্রাণকে স্রেফ রক্তাক্ত করতে করতে মেরে ফেলার মতো নারকীয় ফন্দি।
বাংলার জলহাওয়ায় কিন্তু ‘পশু’ আর ‘পাশবিক’কে এক করে দেখার রীতি বেশ কম। মানুষ তার আদিম প্রবৃত্তিবশেই পশুপালক, শুধু খাদ্য আর আত্মরক্ষার প্রয়োজনে হন্তারক। শিকারসাহিত্যের এককালীন যথেষ্ট রমরমা সত্ত্বেও একথা বুঝতে খুব একটা অসুবিধা হয় না যে, প্রবল শক্তিধরকে হত্যা করে তার ছাড়ানো ছালচামড়ার কার্পেট পেতে রাখা, অথবা দেওয়ালে বাঁধাই পশুখুলির ছিন্ন প্রতিকৃতি বরাবরই প্রকৃতির সাজিয়ে রাখা আক্রমণের বিরুদ্ধে বিজয়ী মানুষের বীরত্বের স্মারক, সফল প্রতিরোধের অভিজ্ঞান। বিশেষ করে হাতির বুদ্ধিমত্তা, অবিশ্বাস্য স্মৃতিশক্তি সবই মানুষী বৈশিষ্ট্যের এত কাছাকাছি যে, বাংলার গল্পে সাহিত্যে সর্বত্র তার স্বীকৃতি ছড়িয়ে আছে ভরপুর। সবচেয়ে বড় কথা, হাতি মাংসাশী নয়, এবং বহু মাংসাশী প্রাণীর কাছে তার উপস্থিতি যথেষ্ট ভয়প্রদ। এই দাঁতনখ বের করা খাদক পশুকুলের বিপরীতে, সে যেন মানুষেরই তরফে, মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে থাকা মূর্তিমান হুমকির মতো শাসন করে এসেছে জঙ্গল। আজও, ফরেস্ট পেট্রলিং-এর কাজে ব্যবহার করা হয় প্রশিক্ষিত হাতিকেই।
তবু, একটা হিসেবও মেলেনি। প্রতি মরশুমে রেললাইনের ওপরে ছিন্নদেহ হাতি, বিস্ফোরক গিলিয়ে দেওয়ার পর পেটের মধ্যে ছেঁড়াখোঁড়া অন্ত্রনালী নিয়ে জলের ওপরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মূর্তিমান কালান্তের প্রহরগোনা হাতি, জমির বেড়ায় জড়ানো বৈদ্যুতিক তারের স্পর্শবজ্রে পুড়ে আংরা হয়ে যাওয়া হাতির ভিড়ে আরও একটা সংখ্যা বাড়ল শুধু। সেদিন যে হাতির দল ঢুকে পড়েছিল লোকালয়ে, তাদের বিরুদ্ধে নেই কোনও ফসল ধ্বংস, দোকানপাট বাড়িঘর ভাঙচুর, কিংবা নরহত্যার অভিযোগ। এমনকী, এই প্রত্যেকটি ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণের খতিয়ানও বিপুল হিসেবের অঙ্ক কষে দাখিল করা আছে সরকারি খাতায়। হাতিটি কোনওরকম উন্মাদনাও দেখায়নি সেদিন, যার প্রাথমিক পরিচর্যা হতে পারত ঘুমপাড়ানি গুলির সদ্ব্যবহার। যদিও, ট্র্যাংকুলাইজিং-এর জন্যও দরকার পড়ে বনদফতরের বিশেষ অনুমতি। অথচ, কোনও অনুমতি, কোনও কাগজ, কোনও সম্মতি, কোনও আলোচনা, কোনও সন্ত্রাসের প্রতিক্রিয়া ছাড়াই একেবারে বনদফতরের উপস্থিতিতে জ্বলন্ত লোহার শলা গেঁথে দেওয়া হল হাতির পিঠে। হত্যার পরিকল্পনা আগাম না থাকলে জ্বলন্ত লোহার শলাই বা ঘটনাস্থলে কেন নিয়ে যাওয়া হল, সে প্রশ্নের উত্তরও নেই কোথাও। একটু একটু করে পিছনের পা দুমড়ে-মুচড়ে যখন বসে পড়ছে হাতিটা, প্রাণান্তকর বৃংহনে ভরে যাচ্ছে মাটিপৃথিবীর দিকবিদিক, সঙ্গের ছোট্ট হস্তিশাবকটি ভয়ে, আতঙ্কে প্রাণপণ ছুটে বেরোনোর চেষ্টা করছে জল্লাদপুরীর বাইরে, সেই সময়ে একটা কচি গলা শুধু শোনা যাচ্ছিল পাশ থেকে– “বাবা, ওর কষ্ট হচ্ছে তো বাবা! ওকে ছেড়ে দাও, ও তো মরে যাবে, বাবা-আ-আ!”
আবারও বলছি, মানুষ স্বভাবত হত্যাবিরোধী। এই শৈশবের পোড়-না-খাওয়া তীব্র আকুতির মধ্যে সেই উচ্চারণটাই আমাদের বিবেকের চাবুক হয়ে ফিরুক বারবার। যে মিলিত হত্যার উল্লাস আমাদের ভুলিয়ে দিচ্ছে সেকথা, ভুলিয়ে দিচ্ছে সব খুনের রংই লাল, ভুলিয়ে দিচ্ছে দুঃস্বপ্নে ফিরে ফিরে আসা ওই চিৎকার, তার শেষ কোথায়? যে যৌথ নির্জ্ঞান আমাদের দাঁড়াতে শেখাত প্রাণের পক্ষে, কুৎসিত প্ররোচনায় ভরা জিঘাংসার প্রশিক্ষণ কি সেই শেষ বোধটুকুও কেড়ে নিয়েছে ইতিমধ্যেই? ফোনের ক্যামেরায় প্রতিটি হত্যামুহূর্ত বন্দি করতে মশগুল বাবার কান অবধি কোনও দিন কি পৌঁছোবে আত্মজর ওই তীব্র আর্তনাদ? ‘কষ্ট হচ্ছে বাবা, ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও?’