গোলাম মুরশিদ ইতিহাসের গভীর থেকে মণি-মুক্তো তুলে এনেছেন। প্রচল ধারার ইতিহাসের বিষয়-আশয়কে তিনি পুরোপুরি বদলে দিয়ে প্রকৃত ইতিহাস তুলে আনার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। ভীষণ দৃঢ়চেতা এই মানুষটির লেখায় প্রচলিত ধারার বিরোধিতা দেখতে পাই। তার অসামান্য রচনা মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনী ‘আশার ছলনে ভুলি’। এই বইটির প্রাথমিকভাবে যে বিশেষত্ব তা হল, প্রকৃত সত্যের অবতারণা।
জীবনের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়েও গোলাম মুরশিদ নিজের অন্বেষণ চালিয়ে গিয়েছিলেন। রচনা করে চলেছিলেন বিরল ও ঐশ্বর্যময় সব গ্রন্থাবলি। কর্মবিমুখ হননি। গবেষণাবিমুখ হননি। কালি-কলম-মন সজাগ ছিল শেষমেশ। ঋষিদের মতো তিনি ধ্যানমগ্ন অবস্থায় চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে। বহুমুখী প্রতিভাধর এই জ্ঞানতাপস তাঁর প্রতিটি কাজেই প্রাতিস্বিকতার স্বাক্ষর রেখেছেন। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় তিনি জ্ঞানসাধনায় ব্রতী। এমন মানুষের সংখ্যা কত? নগণ্য, অতি সামান্য বললেই চলে। তাঁর সম্পাদিত বিভিন্ন বিষয়ের বইগুলিতে একাগ্র গবেষকের স্বাক্ষর মেলে। তাঁর কাজ দেখলে শুধুই বিস্মিত হতেই হয়, এমন নয়। তাঁর কর্মপদ্ধতিটি যেন অনুসরণীয় হয়ে ওঠে আমাদের কাছে।
তাঁর চিন্তন ছিল বহুমুখী। তিনি যেমন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর একাধিক গ্রন্থ রয়েছে, তেমনই বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত এ যাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে বড় অভিধান– ‘বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’ তাঁর সম্পাদনায় রচিত হয়েছে। ভাষা-সাহিত্য এবং ইতিহাস তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র।
তিনি ইতিহাসের একটি বিশেষ জায়গা নিয়ে গবেষণা করেছেন, তা নারীর আধুনিকায়ন। বইটির নাম ‘Reluctant Debutante: Response of Bengali Women to Modernization, 1849–1905’, ‘Reluctant Debutante’ পরে ‘সংকোচের বিহ্বলতা’ নামে বের হয়। ‘Reluctant Debutante’-এর জন্য তিনি ১৯৮৩ সালে ‘বাংলা একাডেমি পুরস্কার’ লাভ করেন। নারীমুক্তির দীর্ঘ ধারাবাহিকতার ইতিহাস ধরে রেখেছে এই বই। নারীমুক্তির অন্তর্গত বিষয়গুলিও ধরা পড়েছে তাঁর লেখায়। গোলাম মুরশিদ সাধারণ সামাজিক ইতিহাসকে একটি বিশেষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখিয়েছেন। বর্ণনামূলক ইতিহাস নয়, তিনি লিখেছেন, কী করে তথ্যকে বিশ্লেষণ করে একটা ধারণাগত কাঠামোর মাধ্যমে পরিবেশন করা যায়। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, মদ্যপানবিরোধী আন্দোলনের বিবরণ না-লিখে লেখা যায় স্থিতিশীল সমাজ গঠনের প্রয়াস। স্ত্রীশিক্ষা, বিধবাবিবাহ আন্দোলন, বহুবিবাহ ও বাল্যবিবাহ নিবারণ, পর্দা প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন ইত্যাদির বিবরণ না-দিয়ে লেখা যায় স্ত্রীজাতির উন্নতির প্রতি সচেতনতার কথা।
……………………………………………………..
এখনও সাগরদাঁড়িতে গেলে মানুষের কাছে রাজনারায়ণ দত্তর যেসব ইতিহাস শোনা যায়, বা যেসব লেখক মাইকেল-জীবনী লিখেছেন, তাঁদের তথ্যের বিভ্রান্তি কাটাতে ‘আশার ছলনে ভুলি’ সবচেয়ে মার্জিত ও তথ্যবহুল গ্রন্থ। এখানে উল্লেখ রয়েছে, রাজনারায়ণ দত্তের তৎকালে সেরা উকিলদের তুলনায় অনেক সাধারণ আয় ছিল ও তাঁর ইংরেজি জানাটাও ছিল জনশ্রুতি। আসলে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও তাঁর বাবাকে নিয়ে যে কত ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে সেটা ‘আশার ছলনে ভুলি’ বইটিতে অনেকটাই স্পষ্ট।
……………………………………………………..
গোলাম মুরশিদের লেখায় সাবঅলটার্ন থিওরির প্রয়োগ স্বচ্ছ এবং স্পষ্ট। ‘সাবঅলটার্ন’, শব্দটির সঙ্গে আমরা কমবেশি প্রত্যেকে পরিচিত, যার অর্থ ‘নিম্নবর্গ শ্রেণি’, ইতালিয়ান হিস্ট্রি বইটিতে গ্রামসি সোভিয়েত ইউনিয়নের সেই শ্রমিক শ্রেণিকে বুঝিয়েছিলেন, যারা শাসক শ্রেণির অধিপত্যের অংশ। অর্থাৎ সাবঅল্টার্ন গোষ্ঠীগুলোর ইতিহাস বিভাজিত ও খণ্ডিত– কারণ তারা সর্বদাই শাসক গোষ্ঠীর কার্যকলাপের অধীনে থাকে। ফলে তাদের সংগ্রামের ইতিহাসেও শাসকের চরিত্রের চিত্রায়নের ছায়া থাকে। গোলাম মুরশিদের লেখালিখিতে এই ধারণাগুলি সুস্পষ্ট।
ইতিহাসের গভীর থেকে তুলে এনেছেন অজস্র মণি-মুক্তো। প্রচল ধারার ইতিহাসের বিষয়-আশয়কে তিনি পুরোপুরি বদলে দিয়ে প্রকৃত ইতিহাস তুলে আনার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। দৃঢ়চেতা এই মানুষটির লেখায় প্রচলিত ধারার বিরোধিতা দেখতে পাই। তাঁর অসামান্য রচনা মাইকেল মধুসূদন দত্তের জীবনী ‘আশার ছলনে ভুলি’। এই বইটির প্রাথমিকভাবে যে বিশেষত্ব তা হল, প্রকৃত সত্যের অবতারণা। বিভিন্ন সাহিত্যিকের লেখায় মধুসূদনের বাল্যজীবনের যে-কথা আমরা জানতে পারি, তাতে জানা যায়, মধুসূদন দত্তের বাবা রাজনারায়ণ দত্ত বিত্তশালী উকিল ছিলেন। পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যে তিনি নাকি সুপণ্ডিত ছিলেন ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এখনও সাগরদাঁড়িতে গেলে মানুষের কাছে রাজনারায়ণ দত্তর যেসব ইতিহাস শোনা যায়, বা যেসব লেখক মাইকেল-জীবনী লিখেছেন, তাঁদের তথ্যের বিভ্রান্তি কাটাতে ‘আশার ছলনে ভুলি’ সবচেয়ে মার্জিত ও তথ্যবহুল গ্রন্থ। এখানে উল্লেখ রয়েছে, রাজনারায়ণ দত্তের তৎকালে সেরা উকিলদের তুলনায় অনেক সাধারণ আয় ছিল ও তাঁর ইংরেজি জানাটাও ছিল জনশ্রুতি। আসলে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও তাঁর বাবাকে নিয়ে যে কত ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে সেটা ‘আশার ছলনে ভুলি’ বইটিতে অনেকটাই স্পষ্ট।
একইভাবে লেখকের নিজস্ব ঢঙে গবেষণার স্বতন্ত্র ধারাটিও এর মাধ্যমে সুবিন্যস্ত। গোলাম মুরশিদের প্রতিটি লেখার মূল বৈশিষ্ট হচ্ছে নিবিষ্টতা ও একাগ্রতা। শাসক শ্রেণির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক না রাখায় তাঁর গবেষণার প্রাতিস্বিকতার বিষয়টি উঠে এসেছে। কোনও তথ্য পরিবেশনে কেবল একটি উৎসের ওপর নির্ভর করেননি তিনি। নানা উৎস অনুসন্ধান করে তথ্যটিকে পাঠকের সামনে দাঁড় করিয়েছেন, মোহহীনভাবে। আমাদের ইতিহাস লেখার সার্বিক ধারাটিই গড়ে উঠেছে রাজন্যবর্গেও চেতনার ধারা থেকে। কিন্তু যে কারণে সাবঅলটার্ন ধারার কথাটি এখানে বলা হয়েছে, সেখানে গোলাম মুরশিদের আরেকটি বিষয় আলোচনায় আনা জরুরি। তাঁর আরও একটি গবেষণালব্ধ বই ‘ঔপনিবেশিক আমলের বাংলা গদ্য, উন্মেষ ও বিকাশের ইতিহাস’ পাঠ করলেও গোলাম মুরশিদের চিরাচরিত স্বভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।
…………………………………………
আরও পড়ুন: ‘ময়নাতদন্ত’ নিয়ে উদ্বেল কলকাতায় বিদায় নিলেন উৎপলেন্দু
…………………………………………
ইতিহাস চর্চায় তিনি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করেননি। নতুন ইতিহাস তুলে এনেছেন। প্রথম বাংলা বই ছাপার কথাটি আমাদের অধিকাংশ বই-তে লেখা আছে– ১৮০১ সালে শ্রীরামপুরের মিশন প্রেস থেকে। অন্যদিকে, বই ছাপানোর প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এ ইতিহাস হয়তো ইংরেজরা তাদের তাঁবেদার ঐতিহাসিকদের দিয়ে এভাবেই লিখিয়েছিলেন। কিন্তু গোলাম মুরশিদ এই ধারার বাইরে গিয়ে লিখেছেন, ‘১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হওয়ার ১৬ বছর আগে ১৭৮৪ সালে প্রথম বাংলা বই প্রকাশিত হয়।’ সেসময় ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদে ইংরেজ অনুবাদকদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের অধীনে কর্মরত মুনশিদের ভূমিকার ব্যাপারেও তিনি লিখেছেন। একইসঙ্গে লিখেছেন, বাংলা বই প্রকাশ ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের একক কৃতিত্ব নয়, বরং ইংরেজ অনুবাদক এবং তাঁদের মুনশিরা লিখিত বাংলাকে এগিয়ে নিয়েছিলেন।
গোলাম মুরশিদের লেখার প্রাণের ভিতরে গেলে যে বিষয়টি পুরোপুরিভাবে অনুভব করা যায় তা হল, সন-তারিখের ইতিহাস নয়, তিনি লিখেছেন, মননশীলতার ইতিহাস, সামাজিক ইতিহাস সর্বোপরি মানুষের সচেতনতার ইতিহাস। লিখেছিলেন সচেতনতার ইতিহাস। তার লেখা ‘আলোকিত মুখচ্ছবি’ বইটি গুণে মানে সেরা। এই বইটিতে নানা মনীষীর সঙ্গে গোলাম মুরশিদ নিজের বাবার কথাও লিখেছেন। তাঁর পিতামহ সন্তানকে লেখাপড়া না করিয়ে গৃহকর্মে, মূলত চাষাবাদে নিয়োজিত হওার নির্দেশের পর গোলাম মুরশিদের বাবা নিজের উদ্যোগে লেখাপড়া শেখেন, পরে তিনি গ্রামের সুবিধা-বঞ্চিতদের লেখাপড়া করতে সাহায্য করেছেন। তিনি বাবার আলোকিত দিকের যে প্রশংসা করেন, সেটি তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনা। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, গোলাম মুরশিদ তাঁর অসাম্প্রদায়িক চেতনার পাঠ পেয়েছিলেন বাবার কাছ থেকেই। কিন্তু তাঁর পরিবার অনেক স্বচ্ছল এবং সব ভাইবোনই উচ্চশিক্ষিত। তাঁর বাবাকে নিয়ে লেখাটিতে ভাই-বোনরা মনক্ষুণ্ণ হতে পারেন জেনেও তিনি তাঁর সত্যবদ্ধ উচ্চারণের ধারার সঙ্গে কখনও আপস করেননি। পিতার আদর্শ থেকে একটুও বিচ্যুত হননি। তাঁর লেখা ইতিহাসের ধারায় নতুন ইতিহাস তৈরি না করে প্রচল ধারা ভেঙে চলে গিয়েছে স্বকীয়তা নিয়ে নিজস্ব ধারায়। তিনি নেই একথাই সত্যি। কিন্তু মানুষ মরে গিয়েও বেঁচে থাকেন তাঁর কাজের মধ্যে। গোলাম মুরশিদ স্যর, আপনি আমাদের স্মৃতিতে অবিনশ্বর থাকবেন। আপনাকে প্রণাম।
…………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
……………………………………..