বর্তমান শাসকের ভিতর যেভাবে থেকে যায় অতীত শাসকের ছায়া। বিরোধীর মধ্যে যেমন থাকে আগের বিরোধী। গণতন্ত্রের ভিতর যেমন রাজতন্ত্র আর সিঙাড়ার ভিতর আলুর পুর। তাহলে, টোকা আর দূরে রইল কোথায়? এই যে ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে, তাতে কি খানিক টোকার ছায়াপাত থাকে না! হতে পারে তা পরে প্রহসন হয়ে যায়, কিংবা বিপর্যয়! কিন্তু অতীত থেকে খাবলা দিয়ে খানিকটা টুকলি তো সময়ই করে।
প্রচ্ছদ শিল্পী: অর্ঘ্য চৌধুরী
২.
নেভিল কার্ডাস স্কোরবোর্ডকে গাধা বলেছিলেন। যথার্থ। মার্কশিটের জন্যও ওই একই বিশেষণ প্রযোজ্য। তা শুধু ঠিক-ভুলের হিসেব রাখে। কতটুকু মৌলিক, আর কতটুকু টৌকলিক, বোঝা তার কম্ম নয়। যেমন ব্যালটবক্স জানে বিপুল জয় আর জমানত জব্দ। গণতন্ত্র রক্ষা পেল কি-না, বোকা বাক্স তা জানবেই বা কী করে!
অতএব মার্কশিটের ভিতর এক-আকাশ শূন্যতা। শূন্যের ভিতর ঢেউ। ঢেউয়ে যে টোকা বা টুকলি থেকেই যায়, অস্বীকার করে না কেউ কেউ। তবে ওই, কিছু কিছু কথা বুঝে নিতে হয়। সত্যি বলতে, টোকাটুকি হল ধরি মাছ না ছুঁই পানি। আধুনিকা শর্মিলা ঠাকুর যতই অপছন্দ করুন না কেন, বাঙালির নায়ককে সর্বগুণসম্পন্ন হতেই হবে। তিনিই পরীক্ষায় প্রথম হবেন। ফলে, তাঁর টোকার দরকার নেই। তবে সখ্যধর্মে তো আর অবহেলা করতে পারেন না। অতএব টোকে নায়কের বন্ধু। বন্ধু প্রশ্ন করলে নায়ক মাথা ঘোরাতে না ঘোরাতেই ইনভিজিলেটর দেন ধমক। টোকার কলুষ আর তাঁর গায়ে লাগে না। এ যেন বাম হাতে দেওয়া পুজো। তবু পুজো তো! মাথা তো অন্তত ঘুরিয়েছিলেন! এখন, বাঙালির কীর্তিমান নায়কের সঙ্গে পরোক্ষে জুড়ে থেকেও টোকা খানিক কুলীন হওয়ার দাবি তুলতে পারে। টোকা যে ঠিক নয়, এ তো সর্বজনবিদিত। কিন্তু টোকা যে হয়, তাও সুবিদিত। উত্তরাবলির মজাদার সংলাপ তাই এককালে বিখ্যাতই ছিল।
এক কালে, তা নিয়ে খুব বেশি ছুৎমার্গ ছিলও না। না না, টোকার সাফাই গাইছি না। বলছি, টোকা নিয়ে বাঙালির তেমন রাখঢাক ছিল না। মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতার নামাবলি গায়ে চাপানোই ছিল। তবে এই তথাকথিত পলিটিক্যাল কারেক্টনেস এমন ব্লকবাস্টার ছিল না। ফলে, বাঙালির মহানায়কের সিনেমায় খুচরো টোকার প্রসঙ্গ এসেছিল। নায়ককে নায়কোচিত করতেই। অর্থাৎ না-টোকা মহান, তবে কে আর অমন মহান হতে পারে! টোকা তাই পাবলিকের, যে পাবলিক নায়ক বানায়। টোকা কি তবে সাবল্টার্ন! গ্রামশি মাফ করবেন, কিন্তু এলিট গন্ধ মুছে ফেলে তা যেভাবে সার্বজনীন, তাতে আর কী-বা বলা যায়। তবে টোকার গোত্রবিচার তাত্ত্বিকরাই করুন, আমরা বরং আমাদের জীবনে উঁকি দিই।
কথা হল, টোকার কিস্সা যে আড়ালে চলে গেল, তার নেপথ্যে বদলে যাওয়া বাঙালির মন-মেজাজ। আগে যা হত, আজও তা হবে, তার তো কোনও মানে নেই। অতএব টোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন আর হল না। তবে সে থেকেই গেল। বর্তমান শাসকের ভিতর যেভাবে থেকে যায় অতীত শাসকের ছায়া। বিরোধীর মধ্যে যেমন থাকে আগের বিরোধী। গণতন্ত্রের ভিতর যেমন রাজতন্ত্র আর সিঙাড়ার ভিতর আলুর পুর। তাহলে, টোকা আর দূরে রইল কোথায়? এই যে ইতিহাস নিজেকে পুনরাবৃত্তি করে, তাতে কি খানিক টোকার ছায়াপাত থাকে না! হতে পারে তা পরে প্রহসন হয়ে যায়, কিংবা বিপর্যয়! কিন্তু অতীত থেকে খাবলা দিয়ে খানিকটা টুকলি তো সময়ই করে।
……………………………………………………..
বাঙালির মহানায়কের সিনেমায় খুচরো টোকার প্রসঙ্গ এসেছিল। নায়ককে নায়কোচিত করতেই। অর্থাৎ না-টোকা মহান, তবে কে আর অমন মহান হতে পারে! টোকা তাই পাবলিকের, যে পাবলিক নায়ক বানায়। টোকা কি তবে সাবল্টার্ন! গ্রামশি মাফ করবেন, কিন্তু এলিট গন্ধ মুছে ফেলে তা যেভাবে সার্বজনীন, তাতে আর কী-বা বলা যায়। তবে টোকার গোত্রবিচার তাত্ত্বিকরাই করুন, আমরা বরং আমাদের জীবনে উঁকি দিই।
……………………………………………………..
এমনকী জীবনও! তাও কি একেবারে মৌলিক নাকি! শম্পালিদি আর অমিতদা দাবি করতে পারেন, তাঁরা একান্তই মৌলিক। কিন্তু বাকিরা? আমাদের জীবনের টুকিটাকির ভিতরও থাকে টোকা। বাবা, মা, শিক্ষক কিংবা পছন্দের মানুষের মাইক্রোজেরক্স আমাদের ভিতর ঢুকে পড়ে। আমরা টেরও পাই না। কিংবা সচেতন সেই টোকা। যাঁকে আদর্শ জ্ঞান করি, তাঁকে খানিক টুকেই ফেলি আমরা! চালচলন থেকে রাজনীতি এমনকী চিন্তাভাবনাও! এই যেমন ধরুন, প্রেম। তার কপিরাইট তো সেই বৃন্দাবনের। এখন পদাবলি সরিয়ে রেখে তাঁরা যদি প্রশ্ন করেন, আধুনিক কুঞ্জবন কি আমাদের টুকেই সাজিয়েছ হে! তাহলে। কী-ই বা বলার আছে! কিংবা ধরুন, শিল্প। সেও তো প্রকৃতিকে টোকে। লতার চলন কি টোকেনি আলপনা? সুর কিংবা রাগ-রাগিণী কি টোকেনি নদীর গান! পরীক্ষায় টোকা আর এই টোকা অবশ্যই এক নয়। তবে যদি একটু খেয়াল করে দেখি, দেখব, নিয়ত আমরা টুকছি। অন্যকে। অন্য কিছুকে। কোনটা মৌলিক, আর কোনটি সংশ্লেষে নতুন, তা যেন আর আলাদা করা যায় না। একটু আগে যে, দুই সহকর্মীর নাম করেছিলাম, কারণ তাঁদের পদবি মৌলিক। এই যে পদবি, তাও তো টোকার ভূতের মতোই ঘাড়ে চেপে বসে। আজীবন তার আধিপত্যের ব্যাগেজ বইতে পারা সহজ নয়। তাহলে জীবন আর টোকা নয়-ই বা কেন!
আসলে টোকা সেই ওপেন সিক্রেট, যা আমরা স্বীকার করতে লজ্জা পাই। আসলে অস্বীকার করি নিজেকে। অথবা নিজেরই বানানো ইমেজের কাছে বন্দি হই। অথচ, এ আমির উন্মোচন তো আমাদের কাম্য ছিল!
………………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
………………………………………………….
টোকা কখনও আত্মপক্ষ সমর্থন করে না। আমিও টোকা সমর্থন করছি না। শুধু বলছি, টোকার ছায়াপাত আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ঘোরে। স্বীকার করি বা না-ই করি! তবে, জীবন টুকে যে জীবন, তাও তো নতুন-ই। সেটাই রক্ষে! পূর্ণচ্ছেদের নাম আসলে মৃত্যু। টোকা ফুরোলে সে-ই এসে টোকা দেয় জীবনে।
অতএব এই মহাবিশ্বে, মহাকাল মাঝে, যে টোকে না, সে বোধহয় টেকেও না!
……… ওপেন সিক্রেট-এর অন্যান্য পর্ব ………
পর্ব ১: অফিসে দৈবের বশে প্রেমতারা যদি খসে