বিশ্ব দাবা সংস্থা রূপান্তরকামী-নারীদের ‘নারী বিভাগ’-এর যে কোনও প্রতিযোগিতা থেকেই পরবর্তী ঘোষণা পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছে। এর নেপথ্যে রয়েছে একটি অবৈজ্ঞানিক যুক্তি। রূপান্তরকামী-নারীদের শারীরিক-মানসিক বল ‘সাধারণ’ নারীদের থেকে নাকি বেশি এবং রূপান্তরকামী-নারীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা হলে ‘সাধারণ’ নারীরা একধাপ পিছিয়েই থাকবে।
বাংলাদেশের কিছু ছবি আর ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ সিনেমাতে (ঋতুপর্ণ যদিও অভিনয় করেছিলেন, পরিচালক ছিলেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়) ব্যবহৃত হওয়ার পর আধুনিক শ্রোতাদের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে একটি গান, ‘বনমালী তুমি পরজনমে হইও রাধা’। রাধারমণ দত্ত (কেউ কেউ বলেন দীন শরৎ) বিরচিত গানটির মূলভাব নিবিষ্ট সেই ধারণায় যে, শ্রীকৃষ্ণ যদি পরের জন্মে রাধারাণী হয়ে জন্মলাভ করেন, কেবল তবেই শ্রীরাধাঠাকুরানির ব্যথা, বেদনা, কষ্ট এবং সর্বোপরি ভালবাসা সঠিকরূপে তিনি উপলব্ধি করতে পারবেন। বিশ্বজুড়ে সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষদের প্রতি অকারণ হেনস্তা, হিংসা, বিদ্বেষের শিকার হতে দেখলে আজ ওই গানটার কথা মনে আসে। তথাকথিত বিসমকামী (হেটেরোসেক্সুয়াল) মানুষদের এই পৃথিবী বুঝি কোনও দিনই সমকামী-রূপান্তরকামী গোষ্ঠীর সংগ্রামের ইতিহাস টের পাবে না। তা যেমন চাপা দেওয়া ছিল তেমনই থাকবে।
সম্প্রতি বিশ্ব দাবা সংস্থা রূপান্তরকামী-নারীদের ‘নারী বিভাগ’-এর যে কোনও প্রতিযোগিতা থেকেই পরবর্তী ঘোষণা পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেছে। এমন ঘোষণা প্রথম বা নতুন কিছু নয়। বিশ্ব সাঁতারু সংস্থা, প্রতিযোগিতামূলক দৌড়ের বিশ্ব সংস্থা এবং সাইক্লিংও তাদের ‘নারী-বিভাগ’ থেকে রূপান্তরকামী-নারীদের অংশগ্রহণে বিরত রেখেছে। তাদের একটা অত্যন্ত অনৈতিক এবং অবৈজ্ঞানিক যুক্তি হল রূপান্তরকামী-নারীদের শারীরিক-মানসিক বল ‘সাধারণ’ নারীদের থেকে একটু হলেও বেশি এবং রূপান্তরকামী-নারীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা হলে ‘সাধারণ’ নারীরা একধাপ পিছিয়েই থাকবে। কারণ রূপান্তরকামী-নারীরা হয়তো বা ছদ্মবেশী পুরুষ! এই যুক্তির আড়ালে আসলে লুকিয়ে আছে একটি প্রবল নারীবিদ্বেষী ধারণা, যার মূল হল– যে কোনও নারীই পুরুষের থেকে অবশ্যই খাটো। নিচু। পিছিয়ে পড়া। পুরুষ এবং রূপান্তরকামী-নারী, কারও সঙ্গেই তথাকথিত ‘সাধারণ’ নারীর কোনও প্রতিযোগিতা অতএব চলেই না। এরা সেই ক্রোমোসোম আর হরমোনের খেলাকে বারবার এই যুক্তিতে স্থান দেন। ভাবটা এমন যেন তারা এসব কিছু বিজ্ঞান মেনেই করছে। কিন্তু আজ অবধি রূপান্তরকামী-নারী তথাকথিত ‘সাধারণ’ নারীর থেকে কোনও শারীরিক-মানসিক প্রেক্ষিতে এগিয়ে– এমন কোনও প্রামাণ্য গবেষণাই নেই। এই বিতর্কের আরেকটি দিক ফুটে ওঠে যে রূপান্তরকামী-নারীদের শেষাবধি ঠিক নারী হিসেবে মেনে না নেওয়ার জেদ। অর্থাৎ, খোদার ওপর যতই খোদকারি চালাও না কেন, জন্মের সময় তোমাকে যে লিঙ্গ-পরিচয়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে, চাইলেও তুমি সে বাঁধন ছিঁড়ে বেরতে পারবে না বা বেরতে দেওয়া হবে না। আমাদের শরীরটা প্রকৃতির দান এবং অমোঘ। তার ইচ্ছা-খুশি মতো নাম হতে পারে না আর ছুঁড়ি-কাচি চালিয়ে তার পরিবর্তনও করা যায় না! বলা বাহুল্য, এটি একটি মধ্যযুগীয় ধারণা। খোদার ওপর খোদকারি করার সাহস না দেখালে মানুষ শল্যচিকিৎসাই কোনও দিন শিখে উঠতে পারত না ঠিকঠাক। এমনকী, নদীতে বাঁধ দিতে পারত না, জঙ্গল কেটে শহর-বন্দরও তৈরি হত না কখনও।
তাহলে আমাদের মনে এসব বিদ্বেষপূর্ণ ধারণাগুলি জন্ম নেয় কীভাবে? আসলে আমাদের তথাকথিত রাষ্ট্র ও সমাজের অবচেতনে আদিকাল থেকেই পুরুষ এবং নারীর মধ্যেকার যে সামান্য শারীরবৃত্তীয় ব্যবধান, তাকে আমরা বহু যোজন দূরত্বে পরিণত করেছি। চুলের ছাঁট থেকে পোশাক, চাকরি থেকে অর্থনৈতিক সুযোগ– সবেতে প্রথম থেকেই বিরাট পার্থক্য তৈরি করে ফেলেছি। পোশাক-পরিচ্ছদের পাশাপাশি লেডিস-জুতো, লেডিস-ছাতা, লেডিস-পারফিউম প্রভৃতি বাক্যবন্ধ তো তৈরি করেইছি, সঙ্গে বিশ্বব্যাপী পুরুষ যেখানে ৭২ শতাংশ কাজের সুযোগ পাচ্ছে, নারী পাচ্ছে শতাংশের হিসেবে মাত্র ৪৭। এই পার্থক্যের মূলে আছে সবদিক থেকে পুরুষই নারীর তুলনায় শ্রেষ্ঠতর– এমন একটি ভ্রান্ত ধারণা। এই ধারণাই নারীবিদ্বেষ প্রসব করে। আর নারীবিদ্বেষ-ভরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর সঙ্গে জড়িত যে কোনও জিনিসই অতএব ঘৃণ্য। ‘নারীসুলভ’ পুরুষও একইরকম বমনউদ্রেককারী। সমকামী-রূপান্তরকামী মানুষ সে কারণেই হেনস্তা, হিংসার শিকার।
এদিকে ক্রীড়াজগতে শুরু থেকেই নানা ধরনের বৈষম্য ছিল। যে ধারণার বশবর্তী হয়ে পুরুষকে নারীর তুলনায় শারীরিক-মানসিক বলে বেশি শক্তিশালী হিসেবে ধরা হয়, সেভাবেই আজও বড় বড় খেলাগুলোয় নারী আর পুরুষের পুরস্কার-মূল্য সমান হল না। সমান হল না বলতে পুরুষের আর্থিকমূল্য নারীর তুলনায় অনেকটা বেশিই রয়ে গেল। ফুটবলে তো আপাতত পরিবর্তনের কোনও প্রশ্নই নেই, তাও টেনিস বিশ্ব সংস্থা (ডাব্লুটিএ-এটিপি) একরকম কথা দিয়েছে যে, ২০২৭ কিংবা ’৩০ নাগাদ টেনিস খেলায় নারী-পুরুষের পুরস্কার-মূল্য সমান করে দেওয়ার ভাবনাচিন্তা শুরু করবে। ক্রিকেটের ক্ষেত্রে অবশ্য আইসিসি সম্প্রতি সমান পুরস্কার-মূল্যের কথা ঘোষণা করেছে, কিন্তু তাও এই ২০২৩ সালে আসার পর! যে ক্রীড়াজগতে ‘জন্মেনির্ধারিত’ (সেক্স অ্যাসাইন্ড অ্যাট বার্থ) নারীদেরই এত বৈষম্যের মুখোমুখি হতে হয়, সেখানে রূপান্তরকামী-নারীদের যে আরও হেনস্তার মোকাবিলা করতে হবে, তা সহজেই অনুমেয়। বিশ্ব দাবা সংস্থা ‘রূপান্তরকামী-নারী’ প্রতিযোগীদের ‘নারী-বিভাগ’-এর প্রতিযোগিতাগুলোতে অংশগ্রহণ করা থেকে যে নিষিদ্ধ ঘোষণা করল, তা সেই পুরনো বৈষম্যেরই প্রতিচ্ছবি। তারা রূপান্তরকামী-নারী প্রতিযোগীদের ওপর একটি অনৈতিক নিষেধাজ্ঞা শুধু জারিই করল না, তথাকথিত নারী প্রতিযোগীদের ক্ষমতার প্রতি একটি মারাত্মক অপমানজনক সন্দেহ পোষণ করল। প্রতিভা বা পরিশ্রম নয়– লিঙ্গই তবে হয়ে রইল মানুষের প্রাথমিক পরিচয়!
সন্দীপদা জিজ্ঞেস করলেন, ‘How was the experience?’ পরিষ্কার উত্তর দিলেন, ‘I loved the chaos of the city.’ আসলেই ক্যাওসের মধ্য থেকেই তো বিভিন্ন দৃশ্যের জন্ম, মৃত্যু ও পুনর্নবীকরণ ঘটে– আমরা হয়তো বা অনেক সময় তা দেখেও দেখি না। সেখানেই তো সত্যজিৎ বা উইমের মতো দৃশ্যনির্মাণকারীর দক্ষতা, অনন্যতা ও বিভিন্নতা। তাঁদের চোখ খুঁজে পায় এমন জিনিস যা আমাদের নতুন দৃশ্য ও দৃশ্যমানতা সম্বন্ধে ভাবায়।