‘রন্ধনশালা’ প্রকাশের সময় থেকেই বাসুদেবের কাছে ক্ষুধা ছিল এক চর্চিত বিষয়। নামগল্পের নায়ক অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়েও ভেড়ার বাচ্চার রোস্ট স্পর্শ না করে সঞ্চিত রাখে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আর দুই বন্ধু মিলে গিলতে থাকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেওয়া ‘ভেড়ার শিং, মাথা, নাড়িভুড়ি, চামড়া এইসব’। ‘রতনপুর’ গল্পের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে বাসুদেবের কল্পবাস্তবতা, অসহায় আর্তনাদ। ‘বমন রহস্য’ পড়লে আজও দমবন্ধ হয়ে আসে। বিয়েবাড়ি থেকে বেশ্যাপাড়া কেবল মাংসের বাজার!
বেঁচে থাকলে বাসুদেব অশীতিপর হতেন। কিন্তু তাঁর গল্পগুলি? ক্রমশ তরুণ থেকে তরুণতর পাঠকের কাছে জরুরি পাঠ হয়ে উঠছে। এখনও পর্যন্ত বাসুদেব দাশগুপ্তের (১৯৩৮-২০০৫) মুদ্রিত গল্পের সংখ্যা ৩২। এর মধ্যে আবার ১৯৭৫ সাল অবধি তিনি লিখেছিলেন মাত্র ১৫টি গল্প। কিন্তু তাঁর লেখালেখি নিয়ে বঙ্গসাহিত্যের নানা মুনির আলোচনার সংখ্যা প্রায় তিন গুণ।
১৯৬৫ সালের মে মাসে প্রকাশিত হয়েছিল বাসুদেব দাশগুপ্তের কৃশকায় গল্পগ্রন্থ ‘রন্ধনশালা’। গল্পের সংখ্যা মাত্র চারটি। যথাক্রমে ‘রন্ধনশালা’, ‘রতনপুর’, ‘বমন রহস্য’ ও ‘বসন্ত উৎসব’। উৎপলকুমার বসু প্রকাশিত এই বই প্রকাশমাত্র হইচই শুরু হয়। অমিতাভ দাশগুপ্ত লেখেন, ‘খুবই অস্বস্তিকর ধরনের, আমার সংস্কারে নেই এমন লেখা। আর আমাদের বাপ পিতামহ থেকে পাওয়া সেই সাবেকি অভ্যেস, চট করে একটা লেখা পড়ে সেটাকে ক্যাটিগোরাইজ করে দেয়া– তা না পেরে রীতিমতো হতাশ হয়ে পড়ছিলাম আর কী।’
তখন বাসুদেব স্কটিশ চার্চ থেকে বাংলা অনার্স পাশ করে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের টিউটোরিয়ালে পড়ান আর খেলাৎবাবু লেনের বস্তিতে একটা ঘরভাড়া নিয়ে একা থাকেন। শক্তির সূত্রে হাংরিদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়। যদিও এর ছ’বছর আগে রবিবাসরীয় আনন্দবাজার পত্রিকায় তাঁর গল্প ‘চোরাবালি’ প্রকাশিত হয়েছে। এমনকী, ‘রতনপুর’ গল্পটিও ১৯৬৪ সালে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত। তখন একা ঘরে তিনি ভীষ্মদেব শোনেন, নেশা করেন, হোটেলে খান, কফি হাউসে আড্ডা মারেন, নিয়মিত হিন্দি সিনেমা দেখেন আর আত্মহত্যার চিন্তা করেন। পরবর্তীকালে এক সাক্ষাৎকারে বাসুদেব জানিয়েছেন যে, তাঁর ক্ষুধা ছিল মানুষের সার্বিক ক্ষুধা। হয়তো এই আকাঙ্ক্ষা থেকেই পরবতী সময়ে তিনি কয়াডাঙা সাংস্কৃতিক সংস্থায় গণসংগীত গাইতে শুরু করেছিলেন।
……………………………………………………………………..
‘এইখানে হৈমন্তীর মাংস পাওয়া যায়’– একটা দোকানে সাইনবোর্ড। আঁতকে তাকাই সেদিকে। চামড়া ছাড়ানো একটা নারীদেহ ঝুলছে। রক্ত চুইয়ে পড়ছে লাল দগদগে শরীর থেকে। লম্বা কালো চুল রক্তে ভিজে জট পাকিয়ে গেছে। নীল শিরাগুলি বুঝি শরীর ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়। আর্তনাদ করে বসে পড়ি আমি।… ঝুলতে থাকা ছাল ছাড়ানো মানুষগুলি এইবার আঙুল দিয়ে চোখের উপর থেকে জমাট বাঁধা রক্ত মুছে নেয়। জিভ বার করে নিজেদের শরীর থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত চেটে খায়। তারপর সকলে একযোগে আমার দিকে তাকিয়ে খলখল করে হেসে ওঠে।
…………………………………………………………………
‘রন্ধনশালা’ প্রকাশের সময় থেকেই বাসুদেবের কাছে ক্ষুধা ছিল এক চর্চিত বিষয়। নামগল্পের নায়ক অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়েও ভেড়ার বাচ্চার রোস্ট স্পর্শ না করে সঞ্চিত রাখে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আর দুই বন্ধু মিলে গিলতে থাকে আঁস্তাকুড়ে ফেলে দেওয়া ‘ভেড়ার শিং, মাথা, নাড়িভুড়ি, চামড়া এইসব’। ‘রতনপুর’ গল্পের পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে বাসুদেবের কল্পবাস্তবতা, অসহায় আর্তনাদ। ‘বমন রহস্য’ পড়লে আজও দমবন্ধ হয়ে আসে। বিয়েবাড়ি থেকে বেশ্যাপাড়া কেবল মাংসের বাজার!
“চোখ বন্ধ করতে চাই। চোখ বন্ধ হয় না পায়ের নিচে রক্তে ভেজা পথ পিছল হয়ে ওঠে। পা পিছলে যায় বারবার। ‘এইখানে হৈমন্তীর মাংস পাওয়া যায়’– একটা দোকানে সাইনবোর্ড। আঁতকে তাকাই সেদিকে। চামড়া ছাড়ানো একটা নারীদেহ ঝুলছে। রক্ত চুইয়ে পড়ছে লাল দগদগে শরীর থেকে। লম্বা কালো চুল রক্তে ভিজে জট পাকিয়ে গেছে। নীল শিরাগুলি বুঝি শরীর ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়। আর্তনাদ করে বসে পড়ি আমি।… ঝুলতে থাকা ছাল ছাড়ানো মানুষগুলি এইবার আঙুল দিয়ে চোখের উপর থেকে জমাট বাঁধা রক্ত মুছে নেয়। জিভ বার করে নিজেদের শরীর থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত চেটে খায়। তারপর সকলে একযোগে আমার দিকে তাকিয়ে খলখল করে হেসে ওঠে।… সব আলো অন্ধকার হয়ে নেমে আসে চকিতে। শেষবারের মতো সামলাবার চেষ্টা করি নিজেকে। কিন্তু পারি না। বিয়ে বাড়িতে যা খেয়েছিলাম সব গলগল করে বেরিয়ে আসতে থাকে। ওয়াক ওয়াক শব্দ করে আমি বমি করে যাই। বমি করে যাই রক্তাক্ত পথের উপরে। সমস্ত চর্বিত মাংসের টুকরো সমস্ত জীবনভর ধরে খেয়ে যাওয়া যাবতীয় মাংসের টুকরো আমি বমি করে উগরে বার করতে থাকি। বমি তোড়ে আমার নিঃশ্বাস যেন আটকে আসে। আমি বমি করি।’’
সাজানো-গোছানো মেকি নাগরিক মৌতাতের আড়ালে দগদগে ক্ষত দেখতে পান বাসুদেব। যে যৌন বিপন্নতা ভিন্ন আঙ্গিকে দেখা দিয়েছে তাঁর ‘বসন্ত উৎসব’ গল্পেও। ‘একালের গদ্যপদ্য আন্দোলনের দলিল’ গ্রন্থের লেখক সত্য গুহ বাসুদেবের এই গল্পের অনুকরণে সমরেশ বসুর ‘বিবর’ উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল বলে ১৯৭০ সালে অভিযোগের বোমা ফাটিয়েছিলেন। দু’টি লেখা থেকে রীতিমতো উদ্ধৃতি তুলে তিনি যুক্তি সাজিয়েছিলেন। বাসুদেবের নায়ক মণিকাকে ভালোবাসতে বাসতে, আদর করতে করতে তাকে খুন করে। ১৯৬৫ সালের মে মাসে ‘রন্ধনশালা’র প্রথম সংস্করণে এই গল্পটি প্রকাশিত। একই বছরের পুজোসংখ্যা দেশ পত্রিকায় সমরেশ বসু ‘বিবর’ উপন্যাস লিখেছিলেন। যদিও বাসুদেব ও সমরেশের দুই নায়কের পরিণতি ভিন্ন– তবু এই সমালোচনা অগ্রাহ্য করার নয়।
পরবর্তীকালে বাসুদেব দাশগুপ্ত ‘দেবতাদের কয়েক মিনিট’ (১৯৬৮), ‘লেনি ব্রুস ও গোপাল ভাড়কে’ (১৯৬৮), ‘আনন্দবাজার গোয়েন্দা আর্তনাদ রিপ রিপ’ (১৯৭১), ‘ডক্টর ওয়াং-এর গোপন সংকেত’ ((১৯৭২-৭৩), ‘বাবা’ (১৯৭৫), ‘শেষপ্রহরের অভিযান’ (১৯৮৭) ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ গল্প লিখেছেন। দেশ-কাল-সমাজ ব্যক্তি ক্ষুধা বিপন্নতা বুঝে নিতে বাসুদেবের এইসব গল্পপাঠ এখনও প্রাসঙ্গিক।
বাসুদেব দাশগুপ্ত মানেই শুধুমাত্র রন্ধনশালার গদ্যকার নন। উল্লিখিত গল্পগুলি কিংবা তাঁর একমাত্র উপন্যাস ‘খেলাধুলা’ পাঠে সেই ধারণার বদল ঘটবে।