‘আমার শহর’-এর শুটিংয়ের ফাঁকে জয়দেবকে বললাম, অ্যালবাম রিলিজের কথা। জয়দেব বলল, তোদের লিরিক এত স্পেশাল, ‘তোরা কোনও কবিকে বলবি না? সে কী রে?’ আমি মুখ ব্যাজার করে বললাম, চিনি না তো কাউকে। ‘স্যরকে বলে দিচ্ছি আমি, স্যর উদ্বোধন করবেন।’ কিন্তু … সব কিন্তুকে সিগারেটের টুকরোর মতো পায়ের তলায় পিষে জয়দেব ঘোষণা করল, চন্দ্রবিন্দুর ‘চ’ উদ্বোধন করবেন শঙ্খ ঘোষ। এই জোর একমাত্র জয়দেবেরই ছিল। এমন পাগলামো ওকেই মানাত।
৩২.
আকাশে বারুদের গন্ধ, কিছু একটা তোলপাড় ঘটছে কোথাও। সব অনিশ্চয়তার ঢেউ ঠেলে চন্দ্রবিন্দুর নৌকো তখন স্থির, পাল তুলতে শুরু করেছে জীবন। এক-একটা সময় আসে, যখন জীবনে মনে হয় বড় কিছু একটা ঘটবে, তার সিগনাল পাওয়া যায় খানিক। ‘চ’ অ্যালবাম বেরনোর আগে থেকেই মনে হচ্ছিল, বড় কিছু ঘটতে চলেছে! রেকর্ডিং হয়ে যাওয়ার পর দিব্যেন্দু ও মহুয়া লাহিড়ী ডিস্ট্রিবিউটারদের ক্যাসেট শোনাতে শুরু করেছিল। এতটা পজিটিভ রেসপন্স আসছিল, আশা অডিও-ও আশায় বুক বাঁধছিল। মহুয়া আমায় বলল, তোমার সঙ্গে তো ঋতুপর্ণ ঘোষের আলাপ আছে, ওঁকে একবার বলা যায়, এই ক্যাসেটটা উদ্বোধনের জন্য? ঋতুদা চন্দ্রবিন্দুর গান এমনিই এত ভালোবাসে, আমি নিশ্চিত ছিলাম ‘না’ করবে না। মহুয়া বলল, তাহলে একটা বড় করে রিলিজ অনুষ্ঠান করব মিউজিক ওয়ার্ল্ড-এ। ভাবা যায়! চার নম্বর ক্যাসেটে এসে প্রথম উদ্বোধন। তার কারণ এর আগের তিনটে ক্যাসেট বের হয়েছিল কোনও প্রকাশ অনুষ্ঠান ছাড়াই। ‘গাধা’ ক্যাসেটটা প্রেস ক্লাবে রিলিজ করেছিল আরও পনেরোটি অ্যালবামের সঙ্গে। সেদিক থেকে এটা বিরাট সম্মান! কিন্তু সবার আগে রাজি করাতে হবে ঋতুপর্ণকে।
একটু ভয় নিয়েই ফোন করলাম ঋতুদাকে। দেশে না থাকলেই কেলেঙ্কারি! ঋতুদা শোনা মাত্রই রাজি হয়ে গেল একবাক্যে– ‘তোদের অ্যালবাম বলে কথা! রিলিজ করব না, ওমা।’ মহুয়াকে ফোন করে জানালাম, ঋতুদা রাজি। ওর আবদার, আরও দু’-একজন এমন মানুষকে বলো। সেরেছে, আর চিনি কাকে? মনে পড়ে গেল মমতাশঙ্করের কথা। চন্দ্রবিন্দুর গান ওঁর খুব পছন্দের, বলেছিলেন একবার। ফোন করলাম মমোদিকে। সময়টা খুব ভাল যাচ্ছে চন্দ্রবিন্দুর। মমোদিও এককথায় ‘হ্যাঁ’ বলে দিলেন। ব্যস, আর আমাদের পায় কে! ‘আমার শহর’-এর শুটিংয়ের ফাঁকে জয়দেবকে বললাম, অ্যালবাম রিলিজের কথা। জয়দেব বলল, তোদের লিরিক এত স্পেশাল, ‘তোরা কোনও কবিকে বলবি না? সে কী রে?’ আমি মুখ ব্যাজার করে বললাম, চিনি না তো কাউকে। ‘স্যরকে বলে দিচ্ছি আমি, স্যর উদ্বোধন করবেন।’ কিন্তু… সব কিন্তুকে সিগারেটের টুকরোর মতো পায়ের তলায় পিষে জয়দেব ঘোষণা করল, চন্দ্রবিন্দুর ‘চ’ উদ্বোধন করবেন শঙ্খ ঘোষ।
এই জোর একমাত্র জয়দেবেরই ছিল। এমন পাগলামো ওকেই মানাত। কাঙালি খেতে পেলে শুতে চায়। এই অবধিই হজম হচ্ছে না, তারপর আবার আমতা আমতা করে বললাম, আর সুনীলদা? বললে আসবেন? জয়দেবের বাবার বাৎসরিকে চন্দ্রবিন্দু যখন গান গেয়েছিল, তখন অতিথি বলতে তো ওই দু’জনই– শঙ্খ ঘোষ ও সুনীল গাঙ্গুলি। ফলে সুনীলদা এলে গোটা অনুষ্ঠানটা একটা আলাদা মাত্রা পেয়ে যাবে। বাংলা ব্যান্ডের এত বড় উদ্বোধন হয়নি এর আগে। জয়দেব চুপ করে শুনল। দু’দিন পর ফোন করে জানাল, স্যর রাজি হয়ে গিয়েছেন। আমি ঋতুদাকে ফোন করে বললাম, শঙ্খ ঘোষ আসবেন। খুব খুশি হয়েছিল ঋতুদা।
শঙ্খবাবু যদিও আমাকে দু’টি কড়া শর্ত দিয়ে রেখেছিলেন। এক, মিউজিক ওয়ার্ল্ডের প্রোগ্রামে তিনি থাকবেন, কিন্তু মঞ্চে উঠবেন না। দুই, তিনি কোনও কথা বলবেন না। শর্ত দু’টি খুবই মনখারাপ করে দেওয়ার মতো, কিন্তু কী করা, আফটার অল শঙ্খ ঘোষ। সুনীলদাকে ফোন করলাম দুরু দুরু বক্ষে। অলসগম্ভীর স্বরে স্বভাবসিদ্ধ– ‘হ্যালো’। থতমত খেলেও ব্যাপারটা বললাম। সুনীলদা খুবই খুশি হয়ে উঠলেন– ‘তোমাদের নতুন গান বেরচ্ছে, খুবই ভাল কথা। কিন্তু ওই দিন আমার হবে কি না বুঝতে পারছি না। পরে, অন্য কোনও অনুষ্ঠানে যাব, কেমন?’ ফোন রেখে দিলেন। বুঝলাম, সুনীলদা হল না।
যেদিন ‘চ’ অ্যালবাম বেরবে মিউজিক ওয়ার্ল্ডে, তার আগের দিন বাঁকুড়া ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চন্দ্রবিন্দুর শো। সেসময় আমরা টাটা ৪০৭ গাড়ি চেপে অনুষ্ঠান করতাম। দূরের সফরে ঝাঁকুনি খেতে খেতে আধমরা হয়ে গন্তব্যে পৌঁছতাম। ‘চ’ রিলিজের আগের দিন যেহেতু শহরে নেই, সব যোগাযোগের দায়িত্ব চন্দ্রিলের। শঙ্খবাবুকে বাড়ি থেকে নিয়ে মিউজিক ওয়ার্ল্ডে ঢুকবে ও তিনটে নাগাদ। আমরা সকালবেলা কলকাতা ঢুকে দৌড়ব। সবকিছু অবশ্য প্ল্যানমাফিক হয় না।
বাঁকুড়া যেতে গিয়ে ড্রাইভার রাস্তা গুলিয়ে ফেলল। ঘণ্টা চারেকের পথ আমরা আটঘণ্টা পার করে পৌঁছলাম। শরীরের যা অবস্থা, তাতে তক্ষুনি স্টেজে ওঠা অসম্ভব। উদ্যোক্তারা কোথা থেকে একটু রাম এনে বলল, চলবে? না চলে উপায় ছিল না সেদিন। আমরা স্টেজে উঠেছিলাম রাত তিনটেয়। স্টেজ থেকে নামতে নামতেই বুঝতে পারছিলাম কোনওমতে কলকাতা পৌঁছেই দৌড়তে হবে রিলিজে। ‘আশা অডিও’ একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছে আনন্দবাজারে। সেখানে তিন অতিথির নাম ছাপা আছে। শঙ্খ ঘোষ, মমতাশঙ্কর, ঋতুপর্ণ ঘোষ। ভ্যানটা দক্ষিণেশ্বরে পৌঁছতেই কাগজ কিনলাম। ভেতরে ভেতরে একটা অসম্ভব উত্তেজনা কাজ করছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বাড়ি পৌঁছেই শুনি জয়দেব তিনবার ফোন করেছিল। ফোন করলাম। জয়দেব ফোন তুলেই বলল, ‘শোন, সুনীলদা তোদের ওপর খুব রেগে গিয়েছেন।’
(চলবে)
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩১। ত্বকের যত্ন নিন সেক্সিস্ট গান, বলেছিল ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩০: বাতিল হওয়া গান শোনাতে কার ভালো লাগে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৯: সামান্য দরকার থাকলেই মাথাখারাপ করে দিত ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৮: পত্রিকার ক্যাচলাইনের মতোই এডিটরের মুডও ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৭: জয়দেব বসু ছাড়া আর কেই বা ছিল কলকাতার সঙ্গে মানানসই?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৬: পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– খবরটা চাউর হয়ে গেল
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?
আজ যখন আমরা মার্কস ও এঙ্গেলসের বন্ধুত্বকে নতুন চোখে দেখে কমিউনিস্ট ইতিহাস রচনার কথা ভাবি, তখন একই সঙ্গে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নারীবাদী ইতিহাস খুঁজতে গেলে আমাদের মেয়েদের এই বিপ্লবী কমরেডশিপের সম্ভাবনার, নারীবাদী বন্ধুত্বের রাজনীতির দিকেও নজর দিতে হবে।