ঋতুদার বেশ উৎকণ্ঠা ছিল নতুন প্রোগ্রামগুলো নিয়ে। চন্দ্রিল এসআরএফটিআই থেকে বেরনো ডিরেক্টর, ওকে নিয়ে চিন্তা কম ছিল ঋতুদার। ভয় ছিল আমায় নিয়েই। তাই ইউনিটটা পুরো সাজিয়ে দিয়েছিল। ঠিক হয়েছে ‘তারাদের কথা’ প্রথম শুট করা হবে পিসি সরকারের বাড়িতে। বালিগঞ্জের বাড়িতে গেলাম আমরা। সারাদিন বাড়ির ভেতর শুটিং হবে, ব্যাপারটায় মোটেও খুশি হননি জয়শ্রীদি। জাদুকরের মুখে ছিল সবসময় ম্যাজিক-হাসি।
১০.
প্রথম শুটিং শুরু করতে হবে ‘তারাদের কথা’-র। ঋতুদা বাড়িতে ডাকল একদিন। গিয়ে দেখি লম্বা-চওড়া, দশাসই এক মানুষ আড্ডা মারছে। ঋতুদা আলাপ করিয়ে দিল।
–তোর প্রথম ক্যামেরাম্যান, সরি, ক্যামেরাম্যান বলছি কেন, সিনেমাটোগ্রাফার। ওর নাম লালু, পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে পাস করে সটান কলকাতায়। ভালো নাম কী, নিজেই মনে রাখতে পারে না, শুভাশিস বাঁড়ুজ্জে।
দিলখোলা লম্বা হাসির লালুকে প্রথম দর্শনেই ভালো লেগে গেল। বন্ধুত্বটা তুই-তোকারিতে গড়াতে সময় লাগেনি বেশি। প্রি-প্রোডাকশন করার সময় আমি যারপরনাই নার্ভাস, আনাড়ি ডিরেক্টর হলে যা হয়, লালুর একটা চেনা ভঙ্গি ছিল, চোখ টিপে বলত, ‘ভাবিস না, আমি করে দেব।’
পড়ুন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋতুপর্ণ ঘোষের আইডিয়ায় নতুন প্রোগ্রামের সিরিজ সেই শুরু হচ্ছে। এর আগে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয়েছে ‘উৎসব’ ছবির। দুরন্ত ভিউয়ারশিপ ছিল। ঋতুদার বেশ উৎকণ্ঠা ছিল নতুন প্রোগ্রামগুলো নিয়ে। চন্দ্রিল এসআরএফটিআই থেকে বেরনো ডিরেক্টর, ওকে নিয়ে চিন্তা কম ছিল ঋতুদার। ভয় ছিল আমায় নিয়েই। তাই ইউনিটটা পুরো সাজিয়ে দিয়েছিল। ‘রেকি’ বলে একটা নতুন শব্দের সঙ্গে পরিচিত হলাম। যেখানে শুটিং হবে, সেই জায়গায় প্রথম পরিদর্শনকে বলে ‘রেকি’। ঠিক হয়েছে ‘তারাদের কথা’ প্রথম শুট করা হবে পিসি সরকারের বাড়িতে। বালিগঞ্জের বাড়িতে গেলাম আমরা। সারাদিন বাড়ির ভেতর শুটিং হবে, ব্যাপারটায় মোটেও খুশি হননি জয়শ্রীদি। জাদুকরের মুখে সবসময় ম্যাজিক-হাসি। বাড়ি তো নয়, যেন সাক্ষাৎ মিউজিয়াম! আফ্রিকার জুলু মুখোশ থেকে মোম্বাসার তির-ধনুক– দেখতে দেখতে বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে ওঠে। ওঁর বসার ঘরের ঠিক বাইরে এক অদ্ভুতদর্শন সেন্টার টেবিল। বড় একটা কাচের স্ল্যাব ঝকঝক করছে, কাচটাকে নীচ থেকে ধরে রয়েছে চার পিতলের সিংহ, সামনের দু’পা তুলে। এ জিনিস আগে দেখিনি।
প্রদীপদা বললেন, ‘গ্লাসটা দেখো, বেলজিয়াম থেকে আনা, দুর্মুল্য পিস!’ লালু ফেরার সময় দেখি চিন্তিত। কী ব্যাপার?
–না, এত দামি দামি সব জিনিস। আমাদের শুটিং পার্টিকে তো জানিস না। একবার ঢুকলে সব তছনছ করে দেয়। ওই বেলজিয়ান গ্লাসটার যদি কিছু হয়, তারা দিতে পারবে কমপেনসেশন?
এসব শুনেই বুক ঢিপঢিপ করছে! ‘অ্যাকশন’ আর ‘কাট’ বলব এটুকুই ভেবেছিলাম। ডিরেক্টরকে এসব নিয়েও ভাবতে হয় নাকি! শুটের আগের দিন ফোন করল ঋতুদা উইশ করতে। ‘থ্যাঙ্কু’ বলে রাখতে যাব, ঋতুদা বলল, ‘শোন, একটা কথা কনফিডেনশিয়ালি বল তো? লালু কি মদ খেয়ে আসছে কাজে?’
পড়ুন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
আমি জোর গলায় বললাম, ‘নাহ। একদিনও নয়, খুবই সদাশয় এবং হেল্পফুল।’
–হ্যাঁ ছেলে ভাল, ট্যালেন্টেড কিন্তু ও অ্যালকোহলিক, চোখে চোখে রাখবি ওকে!
আচ্ছা বিপদে পড়া গেল তো! লালুকে দেখে তো এমন মনে হয় না, অসম্ভব সোবার একটা মানুষ। কাজের পর সবাই একটু-আধটু খায়, কাজের মধ্যে না খেলেই হল।
শুরু হল আমার নতুন এক সফর। প্রথম দেখলাম ‘আলো করা’ কাকে বলে। বসার ঘরে নিজের আসনে বসে কথা বলতে শুরু করলেন পিসি সরকার। ওঁর কথা বলার মধ্যে একটা হিপনোটিক ব্যাপার আছে। গলার স্বর শুনলেই মনে পড়ে মহাজাতি সদন। সেই মায়াবী কণ্ঠস্বরে বলে চলেছেন বাবা– মানে সিনিয়র জাদুসম্রাটের মৃত্যুর কথা, কীভাবে বাবার অসমাপ্ত শো শেষ করেছিলেন তিনি। এমন তন্ময় হয়ে শুনছিলাম, ঘোর লেগে গিয়েছিল। প্রদীপদা একটু দম নেওয়ার জন্য থামলেন, আমি আশপাশ তাকিয়ে দেখি, গোটা ইউনিট আমায় অবাক চোখে দেখছে। লালুর ফরসা মুখটা রাগে থমথমে লাল– ‘কাট’ বলবি না তুই! আমি জিভ কেটে বিড়বিড় করে বললাম, ‘কাট।’ লাঞ্চের সময় লালুকে ‘সরি’ বললাম। চোখ টিপে বলল, ‘প্রথম শুটিং তো, এসব হয়েই থাকে। তুই শুধু কনটেন্টের ব্যাপারটা দ্যাখ, বাকি আমি সামলে নিচ্ছি।’
সত্যি একার হাতে সামলাল, আমায় আওয়াজ দিল, ‘‘এর’ম নরমসরম স্বভাবের ডিরেক্টর হলে চলবে? সকাল থেকে একটা গাল পর্যন্ত দেয়নি।’’ আমি হতবাক হয়ে বললাম, ‘পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!’ ‘আরও কিছুদিন রগড়া, তারপর টের পাবি।’ ঋতুদাও তো এত বড় ডিরেক্টর, মুখখারাপ করে না কি সেটে!
সারাদিনের শুটিং এবার শেষের পথে। আমাদের কড়া নজরে বাড়ির একটা মহার্ঘ জিনিসেও আঁচ পড়েনি। লালু বলল, ‘‘শেষ একটা ট্রানজিশন শট নি’। উনি তিনতলা থেকে দোতলা নেমে আসছেন, আমি নীচ থেকে ক্যামেরা করব।’’ শটটা না নিলেও দিব্যি চলত। কিন্তু তখন আমি মিনমিনে পরিচালক, আমার কথা পাত্তা দেয় কে! নীচে একটা ট্রলি পাতা হল, সেখানে লালু ক্যামেরা নিয়ে বসে, আমি রয়েছি তিনতলায় এমন একটা জায়গায়, যেখান থেকে টপশটে দেখা যায় পুরোটা। লালুর গলা পেলাম, ‘প্রদীপদা আসুন…।’ প্রদীপদা নামতে লাগলেন একই স্পিডে লালু সমেত ক্যামেরা পিছতে লাগল। শটটা যখন মাঝপথে, তখনই আমি বুঝতে পেরেছি একটা বড় সর্বনাশ হতে চলেছে, কোথায় চিৎকার করে কাট বলব তা না মুখ দিয়ে বেরল, ‘মাড়িয়েছে!’ লালুর তো চেহারাটা বড়, পশ্চাৎটিও সেই অনুযায়ী বৃহদাকার, ট্রলির শেষে লালুর পিছনটি গিয়ে টোকা দিল সেই অমূল্য বেলজিয়ান গ্লাসে, চোখ বড় বড় করে দেখলাম, চার-চারটে অপদার্থ পিতলসিংহ মুহূর্তে মাটিতে লুটোচ্ছে, আর আখাম্বা গ্লাসটপখানি শূন্যে ভাসছে। মহাজ্ঞানী বটগাছের মতো জীবনের প্রথম শুটিংয়ে দিব্যদৃষ্টি পেলাম স্টপ মোশন ফোটোগ্রাফির… ফাতনাটা জলে ডোবার মতো এক বাঁও, দু’-বাঁও, তিন বাঁও… কাচটা পড়ছে।
দারিদ্রে লালিত, আজন্ম বস্তুসুখে বঞ্চিত মেয়েটি যেন এক আশ্চর্যময়ী। সে দুয়ারের ভিখারিকে ভিক্ষা দেয় পিছনপানে সংকটের দিকে তাকাতে তাকাতে, মৃদু ভীত, অপারগ, যে সমস্যাগুলি সে এখনও পুরোপুরি বোঝে না, তাকে বুঝছে কিন্তু বুঝছে না... পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে ভাইয়ের গুরুত্ব বেশি সে জানে।