হোটেল, সিকিউরিটি, প্রোডাকশন সকলেই টগবগ করে ফুটছে, বম্বের সুপারস্টার আসছে ঋতুপর্ণর ছবি করতে প্রথমবার। ঋতুদা নিজেও খুব উত্তেজিত ‘মিঠুনদা’ আসছে বলে। ঋতুদার মুখে ‘মিঠুনদা’ ডাকটা শুনলেই হাসি পেত, কারণ মিঠুন হল মিঠুন– অমিতাভকে ‘অমিতাভদা’ কিংবা রজনীকান্তকে ‘ও রজনীদা’ বলে ডাকা চলে না কি! ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছি মিঠুন ডিস্কো, মিঠুন ছাঁট, মিঠুন গেঞ্জি, (তখনও টি শার্ট কথাটা অত চালু ছিল না) শুনে, হঠাৎ সেই লোকটাকে দাদা ডাকলে কেমন যেন লাগে।
২০.
শুটিংয়ের শোরগোল, দাপটের চোটে কেমন যেন একটু গুলিয়ে গেলাম। একবার মনে হল, ঋতুদাকে বলে, কলকাতা পালিয়ে গেলে কীর’ম হয়! আমি যে হোটেলে থাকতাম, সেখান থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই গমগমে বাস টার্মিনাস। টুক করে উঠে বসলেই কলকাতা। সে শহরে এমন কিছুই নেই আমার, যে জন্য এত মনকেমন করতে পারে। তবু চলে যেতে ইচ্ছে করছে রোজ! কারণটা আমি বুঝতে পারছি পুরোপুরি। নিজেকে মিসফিট লাগছে। ঋতুদাকে বলি বলি করে ফেরার কথাটা বলা হল না কিছুতেই। রাত্রে আমাদের হোটেলের রুমে রোজই বসে মদের আসর। বাংলা সিনেমার গতিবিধি এবং কিছু কেচ্ছা– এই মোটামুটি আলোচনার টপিক। চিঙ্কুদার অভিজ্ঞতা এবং নেশা করার ক্ষমতা– দুই-ই খুব বেশি। যে কোনও আসরে চিঙ্কুদা থাকলেই সময় কেটে যায়। কতরকম গল্প জানে, কতরকমের হুজ্জোতি। নেশা না করলে একরকম, নেশা করলেই বাঘ! একদিন দেখলাম ঋতুদা স্বকুঘো’কে বলছে, চিঙ্কু কি খুব মদ খাচ্ছে, বেশি খেলে আমায় জানাবে, আমি মা’কে বলে দেব। বিচিত্র সম্পর্ক ছিল দুই ভাইয়ের। ছেলেমানুষের মতো ঝগড়া হত, আবার পরস্পরের প্রতি বিরাট টানও। ঋতুদা চেঁচামেচি করলে যদি চিঙ্কুদা না শোনে, সেইজন্য ভয় দেখাচ্ছে মায়ের কাছে নালিশ করার। দু’জনেই দু’জনের থেকে দূরে দূরে থাকে, আবার একে-অপরকে ছাড়াও চলে না। কেউ ঋতুদাকে নিয়ে কিছু বললে, চিঙ্কুদা এক ধমক দিয়ে বলত, ‘শোন, এখানে যত মাল আছে না, সবাইকে দাদা হাতে করে সিনেমাটা শিখিয়ে দিতে পারে।’ প্রথম আলাপে, সত্যি বলতে কী, আমি চিঙ্কুদাকে ভয়ই পেতাম। অনেক পরে দেখেছি, বাইরেটা যতই কাঠখোট্টা হোক, অন্তরে একটা বাচ্চা বাস করে চিঙ্কুদার। তা হাসিটা দেখলে বোঝা যেত। এখানে ব্র্যাকেটে লেখা উচিত ছিল, ‘আমার হাসি পাচ্ছে না’ পোজেই বেশিরভাগ সময় কাটাত চিঙ্কুদা।
রেইকির জন্য একদিন ছুটলাম কার্শিয়াং। ফেরার রাস্তায় ক্যাসেলটন টি গার্ডেন। ঋতুপর্ণ ঘোষ এসেছে বলে মহার্ঘ ফার্স্ট ফ্লাশ খেলাম দুধ সাদা বোন চায়নাতে। চায়ের রং যে আসলে সোনালি, সেই প্রথম জানা। ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা ক’দিন ধরেই। কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে। হোটেল, সিকিউরিটি, প্রোডাকশন সকলেই টগবগ করে ফুটছে, বম্বের সুপারস্টার আসছে ঋতুপর্ণর ছবি করতে প্রথমবার। ঋতুদা নিজেও খুব উত্তেজিত ‘মিঠুনদা’ আসছে বলে। ঋতুদার মুখে ‘মিঠুনদা’ ডাকটা শুনলেই হাসি পেত, কারণ মিঠুন হল মিঠুন– অমিতাভকে ‘অমিতাভদা’ কিংবা রজনীকান্তকে ‘ও রজনীদা’ বলে ডাকা চলে নাকি! ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছি মিঠুন ডিস্কো, মিঠুন ছাঁট, মিঠুন গেঞ্জি, (তখনও টি শার্ট কথাটা অত চালু ছিল না) শুনে, হঠাৎ সেই লোকটাকে ‘দাদা’ ডাকলে কেমন যেন লাগে। ‘তিতলি’ ছবির শুটিংয়ে এই একটাই আমার অ্যাচিভমেন্ট, সুপারস্টারকে একবারও কোনও সম্বোধনেই ডাকিনি আমি। মিঠুন কবে আসবে’র চেয়েও আমার বেশি আগ্রহ ছিল অপর্ণা সেন কবে আসবে? ঋতুদা যাকে ‘রীণাদি’ বলে ডাকে, কে জানত কোনও একদিন আমিও সেই নামেই ডাকার সুযোগ পাব মানুষটাকে।
…………………………………………………………………………………………………………………………………
ঋতুদা নিজেও খুব উত্তেজিত ‘মিঠুনদা’ আসছে বলে। ঋতুদার মুখে ‘মিঠুনদা’ ডাকটা শুনলেই হাসি পেত, কারণ মিঠুন হল মিঠুন– অমিতাভকে ‘অমিতাভদা’ কিংবা রজনীকান্তকে ‘ও রজনীদা’ বলে ডাকা চলে নাকি! ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছি মিঠুন ডিস্কো, মিঠুন ছাঁট, মিঠুন গেঞ্জি, (তখনও টি শার্ট কথাটা অত চালু ছিল না) শুনে, হঠাৎ সেই লোকটাকে দাদা ডাকলে কেমন যেন লাগে।
………………………………………………………………………………………………………………………………….
শুটিং যত এগিয়ে আসছে, রাতের আড্ডা তত সরগরম হচ্ছে। মোদো আড্ডায় তখন বাংলা সিনেমা, ঋতুপর্ণ, মিঠুনের বম্বে জয় থেকে অপর্ণা সেনের ‘পরমা’– তর্কের খই ফুটছে। খুব যে যুক্তি-টুক্তি ছিল, তা নয়। বরং কে বেশি কাকে চেনে তার গল্প– এসব শুনতে শুনতে লম্বা লম্বা হাই তুলতাম, বারবার বলতাম, তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়া উচিত– কিন্তু মাতাল না শোনে ধম্মের কাহিনি। এর মধ্যে একদিন কী একটা নিয়ে প্রবল ঝগড়াঝাটি লাগল, চিঙ্কুদা ঠাস করে চড় মেরে বসল একজনকে। অপমান, অভিমান মিলিয়ে সে একেবারে যাচ্ছেতাই হুলুস্থুল। পরিস্থিতি একটু ঠান্ডা হতে চিঙ্কুদাকে বললাম, চড়টা না মারলেই পারতে। চিঙ্কুদা টাকরায় শব্দ তুলে বলল, ‘ছাড় তো। আর একটু কোল্ড ড্রিঙ্ক লাগবে, দ্যাখ তো।’
রাত তখন আড়াইটে। হোটেলে কেউ জেগে নেই। চিঙ্কুদাকে জানালাম। চিঙ্কুদা শেরিফ হ্যাটটা পরে নিয়ে বলল, ‘চল আমার সঙ্গে।’ কোল্ড ড্রিঙ্ক অভিযান। রিসেপশনে ঘুটঘুটে অন্ধকার। টিমটিম করে জ্বলছে কাচের একটা মেশিন, যার ভেতরে ঠান্ডা পানীয় দেখা যাচ্ছে। চিঙ্কুদা বলল, ওই তো বোতল। কিন্তু ফ্রিজটা তো লক করা। দাঁড়া, ব্যবস্থা হবে। চিঙ্কুদা কোথা থেকে একটা আধলা ইট নিয়ে এল। আমার তখন মুখ শুকিয়ে আমসি। কী করবে বলো তো? ভাঙব। সত্যি সত্যি ইট মেরে সেই কাচ ভাঙা হল। আমি তখন ইষ্টনাম জপ করছি, অ্যাসিস্ট করতে এসে জেলহাজত না হয়। থাম্পস আপ বের করতে গিয়ে চিঙ্কুদা নিজেরই ভাঙা কাচে হাত কাটল। গলগল করে রক্ত বেরতে শুরু করল। উপায় না দেখে আমি সারণ আর রাজীবকে ডেকে আনলাম। ভোর অবধি রক্ত পরিষ্কার, ব্যান্ডেজ এবং চোরাই কোল্ডড্রিঙ্ক চলল। ঘুমোতে যাওয়ার আগে জানি পরদিন সকাল অন্যরকম কিছু ঘটবে। এবং যা অনুকূল নয় একেবারেই।
পরদিন সকাল থেকে একটা হইহই লেগে গেলে হোটেল জুড়ে। ভাঙা কাচের টুকরো, চোরাই মাল নিয়ে কারও কোনও হুঁশই নেই, কারণ মিঠুন এসে গিয়েছে। গোটা শিলিগুড়ি পথে নেমে পড়েছে। সেই ভিড় থইথই রাস্তায় আমরাও পাশের হোটেল ম্যানিলায় যেতে পারছি না। গোটা রাস্তা পুলিশ কর্ডন করে রেখেছে। সুপারস্টারদের অদ্ভুত সব পাওয়ার থাকে। দশচক্রে ভগবান ভূত হয়, সেদিন মিঠুনচক্রে আমরা চার ভূত কেমন পার পেয়ে গেলাম হঠাৎ।
(চলবে)
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?