অফিসের একটা অংশের চক্ষুশূল ছিল ‘তারা করছেটা কী’। কারণ নিজেদের প্রোগ্রাম নিয়েই সমালোচনা করাই হজম হচ্ছিল না একটা অংশের। অতিরিক্ত খরচের দোহাই দিয়ে বন্ধ করা হল প্রোগ্রাম। ডিরেক্টর কৌশিকদাও রিজাইন করল। আমি আর চন্দ্রিল নিশ্চিত ছিলাম, আমাদেরকেও ছেড়ে যেতে বলা হবে, কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণবশত রয়ে গেলাম সে যাত্রায়। ঋতুদা পুরোদমে তখন ‘আনন্দলোক’ নিয়ে ফের মেতে উঠল। তারার ম্যানেজমেন্ট নিয়ে তখন আমি সন্দিহান। একই জিনিস কেবল বুঝেছিলাম, এই অনিশ্চয়তাই জীবন, এই বস্তুর সঙ্গেই সহবাস চলবে সারাজীবন। বাইরের কারওর পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না এই সিচুয়েশনটা, মিডিয়ার গ্ল্যামার বা চাকচিক্য বেশি দেখে সবাই, এদিকে ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন দশা!
১৭.
ঋতুদার ‘তারা’ ছেড়ে দেওয়ার খবরটা মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছিল। কাগজের পুরনো বন্ধুবান্ধবও খোঁজ নিচ্ছিল ফোন করে। যতবার যতজনের সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলাম, ততবারই মনখারাপ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, বড় তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল পিকনিক। একটা চাকরি যে শুধুই একটা চাকরি নয়, ভালোবাসার কাজ– সেটা ঋতুদার অ্যাপ্রোচের মধ্যে খুব বেশি করে ছিল। নতুন ভাবনার মিটিং, আরও কিছু বইয়ের সন্ধান, ছবির গল্প– ঋতুদার সঙ্গে কাজ করার একটা অন্য মজা ছিল। বসগিরির চাপ নেই কিন্তু দাদাসুলভ দেখিয়ে দেওয়া আছে। প্রিন্ট মিডিয়া ছেড়ে অডিও ভিজুয়ালের নৌকায় চেপে বসি ঋতুদার কারণে। যার জন্য আসা, সে-ই যদি স্যাটেলাইট থেকে উধাও হয়ে যায়, তাহলে তারা কি আর সমান জ্বলজ্বল করে? ঋতুপর্ণ ঘোষ আর অভিজিৎ দাশগুপ্ত, যদ্দুর মনে পড়ছে একই সময় ছেড়েছিলেন। আরও অনেক বাঘা মাইনের চাকুরেও। আসলে কস্ট কাটিংয়ের একটা মহা অভিযান চলছিল। আমরা বেঁচে গেলাম, স্রেফ মাইনে কম বলে। ঋতুদা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ‘তারা করছেটা কী’ বন্ধ হয়ে যায়। অফিসের একটা অংশের চক্ষুশূল ছিল এই অনুষ্ঠান। কারণ নিজেদের প্রোগ্রাম নিয়েই সমালোচনা করাই হজম হচ্ছিল না একটা অংশের। অতিরিক্ত খরচের দোহাই দিয়ে বন্ধ করা হল প্রোগ্রাম। ডিরেক্টর শৌভিকদাও রিজাইন করল। আমি আর চন্দ্রিল নিশ্চিত ছিলাম, আমাদেরকেও ছেড়ে যেতে বলা হবে, কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণবশত রয়ে গেলাম সে যাত্রায়। ঋতুদা পুরোদমে তখন ‘আনন্দলোক’ নিয়ে ফের মেতে উঠল। তারার ম্যানেজমেন্ট নিয়ে তখন আমি সন্দিহান। একই জিনিস কেবল বুঝেছিলাম, এই অনিশ্চয়তাই জীবন, এই বস্তুর সঙ্গেই সহবাস চলবে সারাজীবন। বাইরের কারও পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না এই সিচুয়েশনটা, মিডিয়ার গ্ল্যামার বা চাকচিক্য বেশি দেখে সবাই, এদিকে ভেতরে ছুঁচোর কেত্তন দশা! ‘ইনহাউস ডিরেক্টর’ নামের একটা গোবদা পোস্ট নিয়ে টেনশনে মরছি, এই বুঝি কেউ চাকরি খেল!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ঋতুদার সঙ্গে কাজ করার একটা অন্য মজা ছিল। বসগিরির চাপ নেই কিন্তু দাদাসুলভ দেখিয়ে দেওয়া আছে। প্রিন্ট মিডিয়া ছেড়ে অডিও ভিজুয়ালের নৌকায় চেপে বসি ঋতুদার কারণে। যার জন্য আসা, সে-ই যদি স্যাটেলাইট থেকে উধাও হয়ে যায়, তাহলে তারা কি আর সমান জ্বলজ্বল করে? ঋতুপর্ণ ঘোষ আর অভিজিৎ দাশগুপ্ত, যদ্দুর মনে পড়ছে একই সময় ছেড়েছিলেন। আরও অনেক বাঘা মাইনের চাকুরেও। আসলে কস্ট কাটিংয়ের একটা মহা অভিযান চলছিল। আমরা বেঁচে গেলাম, স্রেফ মাইনে কম বলে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ঋতুদা একদিন বাড়িতে ডাকল। তারা-র খবরাখবর খুঁটিয়ে জানার পর বলল, ‘শোন, আমি একটা ছবি করব রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস নিয়ে। তোর তো বিষয় ছিল বাংলা। চোখের বালি নিশ্চয়ই পড়েছিস?’
মাথা নাড়লাম।
–দারুণ হবে না? ঋতুদার চোখে চিকচিকে সুখবর। ‘চোখের বালি’ আমার মোটেই পছন্দের উপন্যাস নয়। ওই তিন সম্পর্কের কমপ্লেক্সিটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথও ঘোরপ্যাঁচে পড়েছিলেন নিশ্চয়ই, নইলে অতবার কেউ শেষ অধ্যায় বদলায়!
–কে করবে বিনোদিনী?
–নন্দিতা করবে। আনন্দে হইহই করে উঠল মন। ঋতুপর্ণর ছবিতে নন্দিতা দাশ– ভাবনাটাই যথেষ্ট খুশির, তায় আবার বিনোদিনী।
–বাকি চরিত্র?
–এখনও লুকসেট হয়নি কিছু, হবে একটু একটু করে। তোকে যেটা জিজ্ঞেস করার, তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় এই ছবিতে?
প্রস্তাবটা শুনেই যেন কারেন্ট খেলাম। বলে কী রে! সেসময় ঋতুপর্ণ ঘোষের ইউনিটে ঢোকা মানে হাতে চাঁদ পাওয়া। আর এ নিজের থেকে বলছে!
–আমি কি পারব কাজটা?
ঋতুদা আমার সংশয় বুঝতে পেরে নিজে থেকেই বলল, ‘‘দ্যাখ, চিত্রনাট্য নিয়ে আলোচনার জন্যও আমার দরকার লাগবে সাহিত্যের কোনও ছাত্রকে। যে রেয়াত না করে দু’-তিনটে অবজারভেশন বলবে। সেটা তুই পারবি, তারপর শুটিং, যদি ছুটি পাস তখন ভেবে দেখিস। সময় নে, আমি স্ক্রিপ্টটা আর একটু এগোই, তারপর ডাকব তোকে।’’
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বাড়ি ফেরার পথে রাজ্যের চিন্তা ভিড় করে এল। একে তো তারা-র অফিস নিয়েই জেরবার, এরপর যদি ‘চোখের বালি’র শুটিংয়ে যাই, আরও কতটা যে অনিশ্চিত হবে ভবিষ্যৎ?
এর কয়েক সপ্তাহ আগে ঋতুদা একবার হালকা করে বলেছিল আনন্দলোক-এ কাজের কথা, সেটাই মনে হচ্ছে বরং স্থায়ী একটা ব্যাপার। বহুবার ফোন করে বলতে চেয়েছি আবার যদি এডিটোরিয়ালে ফেরা যায়, বলা হয়ে ওঠেনি কখনও।
ঋতুদা ধরেই নিয়েছিল আমি ‘চোখের বালি’তে কাজ করব। একদিন তলব করল, ‘লুক টেস্ট আছে, লর্ডস-এর মোড়ে সাত্যকি ঘোষের স্টুডিওতে চলে আয়।’ ঘটনাচক্রে সেদিন রবিবার। তড়িঘড়ি ছুটলাম লেক গার্ডেন্স। নিমাই ঘোষের সুযোগ্য পুত্র সাত্যকি, সে সময়ের ফ্যাশন ফোটোগ্রাফির বড় নাম। সেই প্রথম আলাপ। সেদিন ঋতুদা লুক সেট করছেন মহেন্দ্র’র মা রাজলক্ষ্মী ও অন্নপূর্ণার। রাজলক্ষ্মীর ভূমিকায় সন্ধ্যা রায়, সামনাসামনি দেখলাম প্রথমবার। সাদা থান পরে সন্ধ্যা রায়ের ছবি তোলা হল অনেক। এরপর অন্নপূর্ণার চরিত্রে শুচিতা রায়চৌধুরী, চমৎকার মানিয়েছিল তাঁকেও। এছাড়া লুক টেস্ট হয়েছিল অমিতাভ মালাকার-এর, বিহারী চরিত্রে। মহেন্দ্র যে প্রসেনজিৎ হবে, সে বোধহয় অনেককাল ধরেই স্থির ছিল। আশালতা বা বিনোদিনীকে দেখতে না পেয়ে একটু আশাভঙ্গ হয়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু ‘চোখের বালি’ নিয়ে একটা উত্তেজনা তৈরি হচ্ছিল ভেতর ভেতর। কে জানত তখন, এ ছবি ফ্লোরে যেতে তখনও অনেক দেরি, সন্ধ্যা রায় নন, লিলি চক্রবর্তী হবেন রাজলক্ষ্মী, আর নন্দিতার কপাল পুড়বে– ঐশ্বর্য রাই বিনোদিনী রূপে আবির্ভূত হবেন বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে। সেদিন রাতে রবীন্দ্র রচনাবলি নামিয়ে, ধুলো ঝেড়ে ফের ‘চোখের বালি’ পড়তে বসলাম। খুব মন দিয়ে পড়তে লাগলাম, প্রতিটি উপমা, বাক্যাংশ খুঁটিয়ে। যদি একটু ভাল লাগানো যায় উপন্যাসটাকে। ৪০-৪৫ পাতার পর ‘সে গুড়ে বালি’ বলে বইটা বন্ধ করতে যাব, দেখি রবীন্দ্র রচনাবলির ভেতর কড়কড়ে ২৫০ টাকা! কবে রেখেছিলাম কে জানে। হঠাৎ টাকা পাওয়ার যে কী আনন্দ! ওইটুকু প্রাপ্তিই বা মন্দ কী!
(চলবে)
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?
পালোয়ানের পুত্র হিসেবে তাঁর হয়ে ওঠার কথা ছিল কুস্তিগির। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সে হঠাৎ মাতৃহারা হয় যে শিশু, তার ভেতরে গুঁড়ি মেরে বেড়ে ওঠে শূন্যতা। বাবার প্রখর নিয়মানুবর্তিতায় হাঁপিয়ে ওঠে সে, কিন্তু মুক্তি পায় সুরে। বাঁশিই হয়ে ওঠে তার আশ্রয়। পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়ার ৮৮-তম জন্মদিনে বিশেষ এই নিবন্ধ।