সাম্প্রতিককালে প্রকাশিত দু’টি কবিতার বই। দুই কবি হয়তো কখনও মুখোমুখি হননি তাঁদের কাব্যবোধ নিয়ে। কিন্তু এই পাতায়, এখানে তাঁদের একসঙ্গে এনে ফেলা হল। তাঁদের কবিতা, কীরকম কবিতা, কী বলতে চায় সেই নতুন, কী ভাবে বলতে চায়– রইল সেসব কথাই।
ধরুন, আর জি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনাই, এই ঘটনা জানার পর থেকে আপনি কি বুকের ভিতরে কোনও বেদনা নিয়ে ঘুরছেন? যদি সত্যিই ব্যথা জাগে, তবে মনে রাখবেন, এই ব্যথা, শূন্যতা বা বেদনাবোধই ঈশ্বর। গত শতাব্দীর সাতের দশকের অন্যতম কবি রণজিৎ দাশ বলেছেন, ‘মানুষের বুকের ভিতরের বেদনাবোধই ঈশ্বর’। অন্তর্যামী এই বেদনা কিংবা গভীর আনন্দও নিশ্চিত ‘পাড়া বেড়ানো’ টাইপ জিনিস না। তাছাড়া উপনিষদের বক্তব্য হল ‘কবি হলেন ঈশ্বরের মুখপাত্র।’ ঈশ্বর সরাসরি বলবেন না যে ভাষ্য, তা বলাবেন সাধক কবিকে দিয়ে। কবিতা সম্পর্কে যখন এতখানি বিশুদ্ধতার প্রশ্ন ওঠে, তখন তা প্রকাশের বিষয়ে অন্তর্মুখী কবির দ্বিধা স্বাভাবিক ঘটনা। আলোচ্য কাব্যগ্রন্থ ‘প্রাবৃষ্য জাহ্নবী পারে’-র রচনাকার তরুণ আকাশ দেবনাথও দ্বিধান্বিত এক শিল্পী।
কবিতাগ্রন্থের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘কবিতাগুলি সর্বসমক্ষে আনার বিষয়ে শুরুতে এক প্রকার দ্বিধা ও জড়তা ছিল।’ এই দ্বিধা হয়তো একজন প্রেমিকের দ্বিধা। বর্তমান কাব্যগ্রন্থে রয়েছে একাধিক প্রেমময় উচ্চারণ। তেমনই একটি সার্থক কবিতা ‘রিনির জন্য কবিতা’। যেখানে পাঠকের পাওনা হয় তীব্র রোম্যান্টিক পঙক্তি– ‘রিনি, আমাদের আয়ু মাপা হবে বৃষ্টিতে।’ এবং ‘রিনি, আমাদের আয়ু মাপা হবে কবিতায়।’ ছন্দে নয়, স্বচ্ছন্দে সুররিয়াল ইমেজারি জুড়ে জুড়ে জীবনবোধের জানলা গড়েছেন আকাশ। যেমন, ‘চারদিকে আয়না ঘেরা ঘরে, আমরা নিদ্রামঙ্গল গাইব’। শব্দের চেনা অর্থ এখানে স্বাধীন হয়েছে শব্দ-সঙ্গমের শক্তিতে।
এই কবি ধীরে ধীরে তাঁর লিরিকাল কাব্য-জালে ফেলেন পাঠককে। যেমন, বইটির অন্যতম শক্তিশালী কবিতা ‘দেশভাগ’। যা শুরু হয়, ‘আমার বর্তমান আর প্রাক্তন দেশের সীমানার মাঝে শুয়ে আছে জনৈক বৃশ্চিক নদ।’ চমকে ওঠেন পাঠক! অনুভব করেন, বিভাজনকামী জাতীয়তাবাদের নেশায় বুঁদ আধুনিক সভ্যতার তিন সন্তান– যুদ্ধ, দেশভাগ এবং উদ্বাস্তু। ‘বৃশ্চিক নদ’-এর দংশন কতখানি বেদনার তা জানে বাংলা থেকে পাঞ্জাব, প্যালেস্তিনীয় যুবক, রোহিঙ্গা শিশু, ইউক্রেনীয় তরুণীও। এই মারণ রোগ নীল-সবুজ গ্রহের সর্বত্র, সব মহাদেশে। এমন সংকটেই হয়তো সচেতন মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে, ‘এই জীবন লইয়া কী করিব?’ তখনই লিখিত হয় ‘মৃত্যু ও ধানক্ষেত’-এর মতো কবিতা। যেখানে আকাশ বলেন, ‘মৃত্য়ু,/ তোমাকে আমার সোনালী ধানক্ষেত মনে হয়/ জীবনের পর অন্ধ ঘুম, তারপরই তুমি’ কবিতাটি শেষ হয়, ‘মৃত্যু,/ নিশ্চল এখন এই জন্ম নিয়ে আমি কী করি?’ এমন সব উজ্জ্বল পঙক্তিতে আশা জাগান তরুণ কবি আকাশ দেবনাথ। তবে কোনও কোনও কবিতায় বড্ড বেশি জীবনানন্দের গন্ধ। এবং কবিতাগাছে আবেগের ভারী ফল, মাটি ধরায় সেই ডালপালাকে, যা হয়তো সবচেয়ে উঁচু আকাশ ছুঁতে পারত।
‘‘মৌলিক ও আধুনিক হাইকু পদ্যের সংকলন ‘ঝরে জল’।” ভূমিকায় ঘোষণা দিয়েছেন গ্রন্থকার, কবি অমিতাভ সেন। আরও জানিয়েছেন ‘হোসেমি (মেদহীনতা) হাইকু কাব্যের মূল কথা– ভাব ও প্রকাশভঙ্গি, দুইদিক থেকেই।’ হাইকু কেন, সমস্ত শিল্পের যে কোনও ফরম্যাটে আধুনিকতা এটাই দাবি করে– মেদহীনতা। যেমন ধরুন, রবীন্দ্রনাথের সমকালে আধুনিক গীতিকবিতার ধারায় কবিতা রচনা করে খ্যাতি পাওয়া গোবিন্দ চন্দ্র দাস। পাক্কা দু’-লাইনের ‘অন্তর-দৃষ্টি’ লিখেছিলেন, ‘দর্পণে কেবল দেখ আপনার মুখ/ হৃদয়ে চাহিয়া দেখ পাপ কতটুক!’ বেশ কয়েক দশক ডিঙিয়ে শ্যামল সিংহ লেখেন, ‘ব্যাঙ ডাকছে। বৃষ্টি পড়ছে।/ যুবতীর পেটের ভিতরে বসে/ আমি শুষে নিচ্ছি ব্লটিং-পেপারের দুঃস্বপ্নগুলি।’ এরপরই হয়তো হাইকু সম্রাট মহাকবি মাৎসুও বাশোর সেই ব্যাঙ, পুকুর এবং লাফ দেওয়ার কথা মনে পড়বে পাঠকের। ‘ঝরে জল’-এর কবি অমিতাভও সাধ্য মতো গভীরে ডুব দিয়েছেন।
বর্তমান কাব্যগ্রন্থের ৫৩ নং (কবিতাগুলির আলাদা শিরোনাম নেই। সবগুলিরই নাম ঝরে জল) কবিতাটি চমৎকার, ‘উড়ছে কৃষ্ণ প্রজাপতি/ হেমন্ত স্বেচ্ছানির্বাসনে/ বুড়বুড়ি উঠছে সাদা জলে।’ কিংবা ৫২ নং কবিতা, ‘মাথায় তারার টুপি/ বালিতে নখের দাগ/ মেলায় বেদম ভিড়।’ এবং এ কাব্যের অন্তিম (৫৪ নং) কবিতা, ‘ঘড়িটা ঠায় তাকিয়ে/ পায়রার ফুলের ডানা/ পায়ে স্পর্শী গঙ্গাজল।’ একইসঙ্গে উল্লেখ করতে হবে গ্রন্থনাম কবিতা, ‘ঝরে জল/ বেঁধে দল,/ চোখ করে ছলছল’। এই প্রতিটি কবিতায় কাব্যের বহুস্তর বেজে উঠেছে। অর্থহীনতা থেকে অর্থময়তার দিকে যাত্রা করেছে শব্দজোট। ‘ঝরে জল/ বেঁধে দল,/ চোখ করে ছলছল’ উচ্চারণ সফল, কারণ তা বিরাট ও বিচিত্র এই মানব সভ্যতার বহু খণ্ডিত বেদনাবোধকে মাত্র তিন লাইনে, আটটি শব্দে, ১৭টি অক্ষরে বেঁধে বা রেধে দিতে পারে! যদি ৫+৭+৫=১৭ অক্ষর বা মাত্রা সংখ্যা না হত, দু’-এক শব্দ বা অক্ষর বেশি হত, কিন্তু ব্যাঞ্জনায় অবিচল থাকত ভাষা, তবে তাও হত সার্থক কবিতাই।
যদিও অমিতাভ সেনের হাইকু কবিতার সংকলন ‘ঝরে জল’-এর সবকটি কবিতার ক্ষেত্রে এই বহুস্তরের কথা বলা যাবে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে উপলব্ধিকে অন্তমিলে ধরার চেষ্টা। জোর করা হয়েছে কি? সত্যি বলতে কবি মাত্রই জানেন, অন্তমিল জিনিসটা জীবনের মতোই অমৃত এবং বিষ। কখন যে সে হিরো থেকে পালটি খেয়ে ভিলেন হয়ে উঠবে, তা বোঝা কঠিন!
প্রাবৃষ্য জাহ্নবী পারে
আকাশ দেবনাথ
বিচিত্রপত্র গ্রন্থন বিভাগ
১২৫ টাকা
ঝরে জল
অমিতাভ সেন
ধানসিড়ি
১৮০ টাকা