স্বামী বিবেকানন্দের নামাঙ্কিত প্রেক্ষাগৃহে রাজস্থানের শিক্ষামন্ত্রী আকবরের বিরুদ্ধাচারণ করছিলেন, যিনি আকবরের গুণকীর্তনকারী বই পোড়াতে বলছিলেন তিনি আর যাই হোক বই পড়েন না! স্বামী বিবেকানন্দের বইও যে তিনি পড়েননি, তা সুনিশ্চিত। পড়লে তাঁর হুকুমনামা অনুযায়ী বিবেকানন্দের দু’টি বই পোড়াতে হত। একটি ‘বর্ত্তমান ভারত’ অন্যটি ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’। ‘বর্ত্তমান ভারত’-এ বিবেকানন্দ রাম, অশোক ও আকবর তিনজনকে ‘মহামতি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।
রাজস্থানের শিক্ষামন্ত্রী বইয়ের ওপরে চটেছেন, রেগে একেবারে আগুন! সব বইয়ের ওপরে অবশ্য নয়। রেগেছেন সেই সব ইশকুলপাঠ্য ইতিহাস বইয়ের ওপর, যেগুলিতে আকবরকে ‘মহামতি’ বলা হয়েছে। ইতিহাস বইয়ের ওপর আজকাল মাঝে মাঝেই মন্ত্রীরা রেগে যান। তাঁর অভিমত, আকবরকে মহামতি বলা যাবে না। রানা প্রতাপের সঙ্গেও আকবর বাদশার তুলনা করা যাবে না। কোথায় রানা প্রতাপ আর কোথায় আকবর! মদন দিলওয়ার, শিক্ষামন্ত্রীমশাই, তাঁর এই আকবর বিরোধী রোষাগ্নি বর্ষণ করছিলেন মোহনলাল সুখাদিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবেকানন্দ প্রেক্ষাগৃহে। স্বামী বিবেকানন্দের নামাঙ্কিত প্রেক্ষাগৃহে যিনি আকবরের বিরুদ্ধাচারণ করছিলেন, যিনি আকবরের গুণকীর্তনকারী বই পোড়াতে বলছিলেন তিনি আর যাই হোক বই পড়েন না। স্বামী বিবেকানন্দের বইও যে তিনি পড়েননি, তা সুনিশ্চিত। পড়লে তাঁর হুকুমনামা অনুযায়ী বিবেকানন্দের দু’টি বই পোড়াতে হত। একটি ‘বর্ত্তমান ভারত’ অন্যটি ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’।
‘বর্ত্তমান ভারত’-এ বিবেকানন্দ রাম, অশোক ও আকবর তিনজনকে ‘মহামতি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিবেকানন্দ আকবরকে সশ্রদ্ধ চিত্তে ঠাঁই দিয়েছিলেন। ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য’ নামের ভ্রমণ-কাহিনিতেও মুঘল শাসকের উদারতার গুণগান স্বামী বিবেকানন্দ করেছিলেন। শিক্ষামন্ত্রী বাংলা জানেন না, বিবেকানন্দের মূল বাংলা লেখা তাঁর পক্ষে পড়া সম্ভব নয়। তবে স্বামী বিবেকানন্দের বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ হয়েছে, হিন্দি অনুবাদও অপ্রতুল নয়। কিন্তু পড়বে কে! জানতে গেলে পড়তে হবে। মন্ত্রীদের পড়তে হয় না, শিক্ষামন্ত্রী হলেও পড়াশোনা করার দরকার নেই। গরম গরম সাম্প্রদায়িক কথা বললেই বুঝি চলে। সুতরাং শিক্ষামন্ত্রীর এমন বুলি ও বুকনি এ-দেশের ‘শিক্ষামন্ত্রী সুলভ’ হয়েছে সন্দেহ নেই।
শাসক আকবর বাদশার অবশ্য জ্ঞান পিপাসা তীব্র ছিল। অক্ষরের প্রাচীর ভেদ করতে পারতেন না বলে তিনি শুনতেন, আলাপ-আলোচনা করতেন। ছবি দেখে দেখে গল্প অনুসরণ করতেন। রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনি শ্রবণের বাসনা তিনি পূর্ণ করেছিলেন। তাঁর রাজকোষ থেকে গ্রন্থাগার রক্ষার জন্য বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হত। একটু কষ্ট করে রাজস্থানের মন্ত্রীমশাইকে যদি তাঁর কোনও বন্ধু ‘আইন-ই-আকবরী’ পড়ে শোনাতেন তাহলে মন্ত্রীমশাই এ-ও জানতে পারতেন আকবর বাদশা গোসম্পদ রক্ষার্থেও বিশেষ মনোযোগ দিয়েছিলেন। রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছবি আঁকার জন্য শিল্পীদের নিয়োগ করেছিলেন। ‘রজমনামা’-র ছবিগুলি ভারতীয় শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। আকবরকে লোকে এমনি এমনি মহামতি আখ্যা দেয়নি। বলদর্পী গ্রন্থবিরোধী শিক্ষামন্ত্রীর অবশ্য এতে বোধোদয় না-ও হতে পারে। বলা তো যায় না! আমাদের দেশের এখনকার মন্ত্রীদের যা বোধ-বুদ্ধি! তিনি একই চিতায় বিবেকানন্দের বই আর আকবরের সময় শিল্পীদের আঁকা রামায়ণ-মহাভারতের ছবি তুলে দিয়ে রামরাজ্যের দ্বারোদ্ঘাটন করার কথা ভাবতেও পারেন! রাম নাম সত্য হ্যায়!
………………………………………………………
মন্ত্রীর কাছে বই দাহ্য পদার্থ। বইপ্রেমীর কাছে বই মশাল। আলো জ্বালায় মনে, আগুন জ্বালায় চেতনায়। কলুষকে নাশ করে। সত্যজিতের হীরক রাজার দেশের কথা মনে পড়বে। সেখানে রাজার আদেশে শিক্ষামন্ত্রী গিয়ে ইশকুল বন্ধ করে দিয়েছিল। বই পুড়িয়ে দিয়েছিল। কারণ, যত বেশি পড়ে/ তত বেশি জানে/ তত কম মানে। তাই বই পোড়াও। মগজ ধোলাই করতে গেলে বই পোড়াতেই হয়। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন মাস্টারমশাই। তিনি বলেছিলেন, পাঠশালা একদিন খুলবেই। পাঠশালা খুলেছিল। হীরক রাজার মূর্তি খানখান হয়ে জিতে গিয়েছিল বই।
………………………………………………………
মন্ত্রীদের কথা থাক। মানুষের কাছে ফেরা যাক। মন্ত্রীরা আদর্শ নন। তাঁরা অনেকেই গ্রন্থ ষড়যন্ত্রী। মানুষেরা কিন্তু বইয়ের কাছে ফিরতেই চান। সে প্রয়াসের খবর কাগজে ভেসে এল। উত্তরবঙ্গে আলিপুরদুয়ারের কাছে ছোট্ট একটি গ্রাম, নাম তার পানিঝোরা। সেই গ্রামটিকে ‘বইগ্রাম’ হিসেবে গড়ে তুলতে চাইছেন একটি সংস্থা। বই থাকবে, থাকবে নিভৃত গ্রন্থাগার। পর্যটকেরা আসবেন। প্রকৃতির টানে শুধু নয়, বইয়ের টানে। বই পড়বেন, থাকবেন, চলে যাবেন। বই আসলে পড়তে জানলে মশাল। মন্ত্রীর কাছে বই দাহ্য পদার্থ। বইপ্রেমীর কাছে বই মশাল। আলো জ্বালায় মনে, আগুন জ্বালায় চেতনায়। কলুষকে নাশ করে। সত্যজিতের হীরক রাজার দেশের কথা মনে পড়বে। সেখানে রাজার আদেশে শিক্ষামন্ত্রী গিয়ে ইশকুল বন্ধ করে দিয়েছিল। বই পুড়িয়ে দিয়েছিল। কারণ, যত বেশি পড়ে/ তত বেশি জানে/ তত কম মানে। তাই বই পোড়াও। মগজ ধোলাই করতে গেলে বই পোড়াতেই হয়। এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন মাস্টারমশাই। তিনি বলেছিলেন, পাঠশালা একদিন খুলবেই। পাঠশালা খুলেছিল। হীরক রাজার মূর্তি খানখান হয়ে জিতে গিয়েছিল বই। এখানে, এদেশেও বইকে হারানো যাবে না। একদিকে মন্ত্রী বই পোড়ানোর হুকুম দেন অন্যদিকে নিভৃত গ্রামে খুলে যায় বইয়ের ঘর।
আবার বিবেকানন্দের কথায় ফিরি। বিবেকানন্দ ছিলেন গোগ্রাসী পাঠক! নানা বই পড়তেন আর নিজের মত সংশোধন করতে দ্বিধা করতেন না। বৌদ্ধধর্ম সম্পর্কে বেশ সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছিলেন তিনি। ১৯০১-এ মৃত্যুর কিছুদিন আগে একটি পত্রে তিনি জানিয়েছিলেন বুদ্ধদেব ও বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে তাঁর মতের পরিবর্তন হচ্ছে। তবে শরীর ভালো নয়। এই পরিবর্তিত মতের কথা হয়তো বলে যেতে পারবেন না। ১৯০২ সালে তাঁর প্রয়াণ হল। এই যে সচলমনা বিবেকানন্দ তিনি বইসচল বলেই মনসচল। বইয়ের জন্য মন খুলে রাখতে হয়। বই তো কেবল অক্ষরভরা অবয়ব নয়। বই তো অনেকরকম। এ দেশে মানুষের শ্রুতি আর স্মৃতিতেও কত বইয়ের চলাচল। কান পেতে রাখা চাই। যাঁর চোখ আর কান খোলা তিনিই তো পাঠক, তিনিই তো সচলমনা।
……………………………………………..
আরও পড়ুন পীযুষ দত্ত-র লেখা: স্বদেশ প্রেম থেকেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তৈরি হয়
……………………………………………..
হবে না, তবু যদি এমন হত! যাঁরা বই পোড়াতে চাইছেন তাঁরা বই খুলে পড়তে বসলেন! সে দৃশ্য সুন্দর।
শেষে বিধিসম্মত সতর্কীকরণ! মন্ত্রী ও রাজনীতিবিদ মাত্রেই কিন্তু বই-বিরোধী নন। চিত্তরঞ্জন, গান্ধী, নেহেরু, সুভাষ এঁরা প্রত্যেকেই গ্রন্থপ্রেমী ছিলেন। গ্রন্থপ্রেমী সুভাষ ইংরেজ পূর্ববর্তী ভারতবর্ষে দু’টি সুবর্ণযুগের কল্পনা করেছিলেন। একটির অস্তিত্ব গুপ্তযুগে, অন্যটির অস্তিত্ব আকবরের আমলে। এসব শিক্ষামন্ত্রীর জানার কথা নয়। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে ও সংসদে কিন্তু চমৎকার গ্রন্থাগার আছে। যাঁরা দেখতে পড়তে জানেন তাঁরা দেখেন, পড়েন।
………………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
………………………………………………..
‘মহুয়া’র প্রচ্ছদের নেপথ্যে নন্দলালের আঁকা সহজ পাঠের ছবি রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয়ই প্রাণিত করেছিল। সহজ পাঠের আগে আমরা দেখেছি, ১৯২২ সালের শেষে আন্দ্রে কারপেলেস প্যারিস থেকে এনেছিলেন একগুচ্ছ কাঠখোদাই। এমনকী, বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ যে কয়েকবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন, সেখানে জার্মানিতে ও ফ্রান্সে তাঁর রীতিমত চেনাজানা ঘটেছিল কাঠখোদাই মাধ্যমটির সঙ্গে।