অমলেন্দু দে ও নাসিমা বানুর যৌথ জীবন শুরু ১৯৫৫ সালে। ঠিক তার এক বছর আগেই সংসদে পাস হয়েছে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট। পশ্চিমবাংলায় নাসিমা-অমলেন্দুর বিয়েটাই স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুসারী প্রথম বিয়ে। বিয়েতে সাক্ষী ছিলেন নাসিমার কমিউনিস্ট পার্টির বন্ধুরা। উনি তখন হেস্টিংসের বি. টি. কলেজে পড়ছেন এবং কলকাতা জেলা কমিটির সদস্য। ওই সময়ে মেয়েদের মধ্যে মাত্র দু’জনের স্থান হয়েছিল পার্টির কলকাতা জেলা কমিটিতে— মণিকুন্তলা সেন ও নাসিমা বানু।
আজ যে নাসিমা বানু-অমলেন্দু দে’র সহযাত্রার দু’-চার কথা লিখতে বসেছি, তার সবটাই শোনা নাসিমাদির মুখে এবং অনেক পরে তাঁদের দুই সন্তানের কাছে। বাঘাযতীনের অজন্তা পার্কে– যা একসময় ছিল এস. পি. ডি. ব্লক উদ্বাস্তু কলোনির অংশ– ওঁদের বাড়ি গিয়ে, নাসিমাদির সঙ্গে আলাপ হয়ে, তাঁর দৃপ্ত সৌন্দর্য অনুভব করে যে মুগ্ধতায় আবিষ্ট হয়েছিলাম, এখনও সেই প্রথম আলাপের রেশ রয়ে গেছে।
নাসিমাদি-অমলেন্দুবাবুর বাড়িতে আমি প্রথম যাই ২০০৫ নাগাদ ‘সওগাত’ পত্রিকা ও বাঙালি মুসলমান ভদ্রমহিলার পরিচয় নির্মাণ নিয়ে কাজ করতে করতে। গবেষণা বিষয় সুপরিচিত ইতিহাসবিদ অমলেন্দু দে’র পরামর্শ নিতেই যাওয়া। শুনেছিলাম তাঁর স্ত্রী যাদবপুর সম্মিলিত (প্রথমে নাম ছিল সম্মিলিত উদ্বাস্তু বালিকা বিদ্যালয়) বালিকা বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা ও বামপন্থী কর্মী। তবে নাসিমাদিকে চিনতাম না।
আলাপ করে জানলাম ওঁদের যৌথ জীবন শুরু ১৯৫৫ সালে। ঠিক তার এক বছর আগেই সংসদে পাস হয়েছে স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট। পশ্চিমবাংলায় নাসিমা-অমলেন্দুর বিয়েটাই স্পেশাল ম্যারেজ অ্যাক্ট অনুসারী প্রথম বিয়ে।
নাসিমা বানু হলেন সেই মেয়ে, যে ক্লাস সিক্স-সেভেন থেকেই ছক ভাঙা শুরু করে। বরিশালে পৈতৃক গ্রামের স্কুলে পড়তে পড়তে সরকারি চাকুরে বাবার বদলির সূত্রে ১৯৪০ সালে কলকাতায় এসে ক্লাস ফোরে ভর্তি হয়েছিলেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে। দিলখুশা স্ট্রিট থেকে স্কুলবাসেই যাতায়াত ছিল তাঁর। সম্ভ্রান্ত পরিবারে নিজের দিদিদের ও অন্যান্য আত্মীয়ার বোরখা পরে ট্রাম রাস্তায় এসে স্কুল বাসে উঠতে দেখতেন তিনি। দু’-তিন বছরের মধ্যে নাসিমার পালা যখন এল, তিনি একদিনের জন্যও পরলেন না বোরখা। সাহিত্যপ্রেমী মা সৈয়দা মোতেহারা বানুর সমর্থনেই সম্ভব হয়েছিল তাঁর এই প্রতিবাদ।
তাঁদের বাড়িতে নাসিমাদির বাবার নিজের মামা, অবিভক্ত বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী (তখন প্রধানমন্ত্রী বলা হত) ফজলুল হক সাহেবের আসা-যাওয়া ছিল নিয়মিত এবং খুবই রাজনীতি আলোচনা হত বাড়ির মধ্যে। পরিবারের কেউই মুসলিম লিগপন্থী না হওয়ায় দেশভাগ মেনে নেওয়া এবং দেশ ছেড়ে পাকিস্তান চলে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠেনি। ১৯৪৭ সালে ম্যাট্রিক দিয়ে নাসিমা প্রথমে ব্রেবোর্নে ও পরে কলকাতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে এম.এ. পড়েন। এর মধ্যেই অবশ্য তিনি ছাত্র ফেডারেশনের অন্যতম নেত্রী হয়েছেন, ১৯৪৯-’৫০-এ দাঙ্গাকবলিত হিন্দু এলাকাগুলোতে গিয়ে রিলিফের কাজ করেছেন ‘অসীমা’ নাম নিয়ে এবং ১৯৫১-তে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পেয়েছেন। বয়স তখন ২০। এরপর এম.এ. পড়তে পড়তে মন দেওয়া-নেওয়া সহপাঠী অমলেন্দুর সঙ্গে।
অমলেন্দু ১৯৪৬ সালে মাদারীপুরে তাঁর দেশের বাড়ি থেকে এসে কোনওমতে উত্তর কলকাতায় একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই জুটিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। দু’বেলা খাওয়া জুটত না সব দিন। বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে তাঁর ওপর ছোট ভাই-বোনেদের দেখার দায়িত্ব ছিল। দেশভাগের পর যখন ভাইরা কলকাতায় চলে এলেন, দায়িত্ব হল দ্বিগুণ। উলুবেড়িয়া কলেজে পড়ানোর চাকরি নিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট শেষ হতে না হতে। ওঁদের প্রথা-বহির্ভূত বিয়েটা তার পরে পরেই।
বিয়েতে সাক্ষী ছিলেন নাসিমার কমিউনিস্ট পার্টির বন্ধুরা। উনি তখন হেস্টিংসের বি. টি. কলেজে পড়ছেন এবং কলকাতা জেলা কমিটির সদস্য। ওই সময়ে মেয়েদের মধ্যে মাত্র দু’জনের স্থান হয়েছিল পার্টির কলকাতা জেলা কমিটিতে– মণিকুন্তলা সেন ও নাসিমা বানু।
বৈষ্ণব শ্বশুরমশাই গোপালচন্দ্র দে মেনে নিয়েছিলেন বড় ছেলের বউকে আর তাঁদের সহায় ছিলেন অমলেন্দুবাবুর বড়দি-জামাইবাবু। নাসিমাদির মা ও মেজদির নৈতিক সমর্থন ছিল, যদিও তাঁর বাবা খান বাহাদুর আবু নাসিরের আশীর্বাদ পেতে আরও দশ-বারো বছর অপেক্ষা করতে হয়। বিয়েটা প্রথমে মেনে নিতে না পেরে নাসিমাদির এক ভাই পার্টি নেতাদের কাছে নিজের বোনকে বহিষ্কার করার আর্জি জানালে, এককথায় বাতিল হয়ে যায় সেই আর্জি। এটাই তো হওয়ার কথা!
তবে পাঁচ-ছয়-সাতের দশকে নিজেদের কঠিন লড়াইয়ের দিনে যে দম্পতি পার্টিকে সর্বতোভাবে পাশে পান, বার্ধক্যে এসে তাঁদেরই দেখতে হয় নববিবাহিত রিজওয়ানুর রহমান-প্রিয়াঙ্কা টোডিকে বিচ্ছিন্ন করতে প্রশাসনিক যোগসাজশ এবং রিজওয়ানুর রহমানের মর্মান্তিক মৃত্যু। বড় খবর না হলেও রিজওয়ানুরের মৃত্যু যে সময় ঘটে, তার দু’-তিন বছর আগে আমার পরিচিত দুই স্কুলশিক্ষক-দম্পতির চরম হেনস্তা ঘটে যায় দু’টি জেলায় শাসক দলের প্রভাবশালীদের হাতে। তাঁদের অপরাধ– ভিন্ন ধর্মের কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেওয়া! এসব দেখেশুনে নাসিমা-অমলেন্দুর হতাশা কতটা গভীর ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ওঁদের বাঘাযতীনের যে বাড়িতে আমার চার-পাঁচ বছর যাতায়াত ছিল, সেই পাড়ায় নাসিমাদিরা থিতু হয়েছিলেন ১৯৬৭ থেকে। স্ত্রীর সিঁদুরহীন সিঁথি দেখে ও তাঁর নাম শুনে, অমলেন্দুবাবুকে বিনা প্রশ্নে বাড়ি ভাড়া দিয়েছিলেন ওই পাড়ার দুই ব্রাহ্ম মহিলা। তার আগের ১২ বছর, অর্থাৎ ১৯৫৫ সালে যৌথ জীবন শুরু হওয়া ইস্তক, শ্যামবাজার থেকে সেলিমপুর বাড়ি ভাড়া পেতে নাকানিচোবানি খেতে হয়েছে ওঁদের। নাসিমাদির কাছে শুনেছি সেলিমপুরে তাঁদের বাড়িওয়ালার একটা জার্মান শেপার্ড পোষ্য ছিল। একতলার উঠোনে যখন নাসিমাদি কাপড় মেলতেন তখন দোতলায় ইচ্ছাকৃতভাবে কুকুরটিকে ব্রাশ করা হত এমনভাবে যাতে কাপড়ের ওপরে বা ওঁর গায়ে লোম পড়ে।
ছয়ের দশকের শুরুতেও সেলিমপুরে কিছু মুসলিম জনবসতি ছিল। ১৯৬৪-এর দাঙ্গার সময় বিপদে পড়েন সেইসব মানুষজন। নাসিমাদিরাও আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে ওঠেন। সেই অবস্থায় এলাকার বিপন্ন মানুষকে নিজেদের উঠোনে আশ্রয় দেন তাঁরা। বামপন্থী চিন্তক ও সম্প্রীতি আন্দোলনের পুরোধা শান্তিময় রায় ছিলেন তাঁদের বিশেষ শ্রদ্ধার ও কাছের মানুষ। অমলেন্দুবাবু ও তাঁর ছোট ভাই রাত জেগে পাহারা দিতেন সেইসব দিনে আর নাসিমাদি করতেন আশ্রয়প্রার্থী মানুষের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা।
যে সময়টা মাথার ওপর একটা নিরুপদ্রব ছাদ পাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠছিল, সহযাত্রার সেই প্রথম দিকের বছরগুলোয় নাসিমাদিকে চাকরি পেতে ও চাকরি টিকিয়ে রাখতেও বহু অপমান সহ্য করতে হয়েছে। প্রথমত হিন্দু-মুসলিম বিয়ে, দ্বিতীয়ত সিঁথিতে সিঁদুর না থাকা ও নাম-পদবি না বদলানো, তৃতীয়ত ফর্মে ধর্মের জায়গাটা ফাঁকা রাখা এবং চতুর্থত কমিউনিস্ট পার্টি করা। হিন্দুকে বিয়ে করেও সিঁথিতে সিঁদুর দেননি কেন– চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে নাসিমাদিকে প্রায়ই এই প্রশ্নের মুখে পড়তে হত। পুজো প্যান্ডেলে যেতে, ঠাকুর ভাসান দেখতে খুব ভালবাসতেন তিনি। কিন্তু যখন দেখলেন বিজয়া দশমীর দিনে প্যান্ডেলে থাকলে, প্রতি বছর তাঁকে সিঁদুরখেলায় নামানোর জন্য জোরাজুরি অব্যাহত, ছেড়ে দিলেন যাওয়া।
সম্মিলিত উদ্বাস্তু বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ও বামপন্থী সংগঠক রবীন্দ্রনাথ গুহ-র সমর্থন না পেলে চাকরি টিকিয়ে রাখা একপ্রকার অসম্ভব হত নাসিমাদির পক্ষে। কংগ্রেসি জমানায় স্কুলে তাঁর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হত যতটা না মুসলিম বলে, তার থেকেও হয়তো বেশি কমিউনিস্ট বলে। তার চরম উদাহরণ হল ১৯৭৩/’৭৪ সাল নাগাদ নাসিমাদির মা যখন মারা যান ঢাকায়, মা-র শেষ কাজে উপস্থিত থাকার জন্য তাঁর ছুটির আবেদন মঞ্জুর না হওয়া।
বাইরের আঘাতের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে ঘরের মধ্যে অন্য এক পরিসর রচনা করেছিলেন নাসিমা-অমলেন্দু। একজোট হয়ে বহু মানুষের পাশে থেকেছেন তাঁরা নানা সময়ে, যদিও এটা ঠিক যে তাঁদের বাড়ির মধ্যে লিঙ্গভিত্তিক শ্রম বণ্টন পাল্টায়নি।
ছেলেমেয়ে সরস্বতী পুজো করতে চাইলে তাঁরা বাধা দেননি কখনও। নাসিমা কিনে আনতেন সরস্বতী প্রতিমা আর পুরোহিত-বিহীন পুজো হত বাড়িতে। অমলেন্দু বেছে রাখতেন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কিছু কবিতা। সেইসব কবিতা পড়ে, গান গেয়ে বাণী বন্দনা হত। প্রতি বছর ঈদের দিন বাড়ির সবাইকে খাওয়াতে নিয়ে যেতেন অমলেন্দু।
সিরিয়াস বইয়ের দিকে ছেলেমেয়েদের আকর্ষণ করার চেষ্টা ছিল তাঁদের বাবার। কিন্তু বাচ্চারা ভূতের গল্প, রহস্য সিরিজ ভালোবাসবেই। তাই নাসিমা সেইসব বই পড়া ও সিনেমা দেখায় সঙ্গ দিতেন তাঁদের।
দশ বছর আগে দেড় মাসের তফাতে চলে গেছেন এই দুই সহযাত্রী। দেহদানের অঙ্গীকারেও দু’জনেই ছিলেন সহব্রতী।
কৃতজ্ঞতা: অমিত দে, তাপ্তি দে
…পড়ুন দোসর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১। ‘গীতাঞ্জলি’ আসলে বাংলা অনুবাদে বাইবেল, এই বলে জাপানিদের ধোঁকা দেন সুহাসিনী