মেয়ের আমার প্রথম চাকরি, সবে চার মাস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবন আর কাজের ভারসাম্য ঠিক খুঁজে নেবে ও। ভুল করেছিলাম বাবা। আনার সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আমি ভুল করেছিলাম। আমার উচিত ছিল দূরবর্তী গাছের ছায়ার মতো ওর মাথার ওপর ছাতার পরশটুকু ধরে রাখা। পারিনি। তাই আজ তোমার কাছে এসেছি বাবা। আমাদের মায়েদের কাছে তো সন্তানের কোনও বিচার হয় না। তাই তুমিও আমার সন্তানই। যে-কথা আনা বেঁচে থাকলে বলতাম, সেকথা তাই তোমায় বলে যাই আজ। কারণ তোমার বিপুল দায়িত্ব আছে বাবা। দায়িত্ব আছে তোমার অফিসের আরও চার লক্ষ ‘আনা’ আর তাদের আট লক্ষ বাবা মা-র ভালো থাকার। তুমি দেখো বাবা, ওরা সবাই যেন একটু দম নিতে পারে। একটু যেন বাঁচার মতো বাঁচতে পারে।
বাবা রাজীব,
আমায় তুমি চিনবে না। চেনার কথাও না। তুমি কত বড় মানুষ, তোমার লক্ষ কোটি টাকার কোম্পানি, লাখো ছেলেমেয়ে কাজ করে তাতে, বৃহৎ জগৎ, বিপুল কর্মকাণ্ড তোমার। আমার মতো এত সাধারণ এক মা-কে তুমি চিনবে কী করে বাবা?
আমি কিন্তু তোমায় চিনি। আমার মেয়ে চিনিয়েছিল তোমায়। বলেছিল, তুমি ওর অফিসের চেয়ারম্যান আর ওর জীবনের আদর্শ। জানো বাবা, ও খুব তোমার মতো হওয়ার স্বপ্ন দেখত। বলত, তোমার মেধা, বাচনভঙ্গি, ব্যক্তিত্ব, সব কিছুই… কী যেন আজকাল বলো তোমরা… হ্যাঁ, হ্যাঁ… মাইন্ডব্লোয়িং।
তুমি কি এসব জানতে বাবা? আমার মেয়ের গোপন পুজোর ডালি– কোনওদিন কি খোঁজ পেয়েছিলে তার? চিনতে তুমি তাকে? হ্যাঁ বাবা, আমার মেয়ে; আমার একমাত্র সন্তান– আনা সেবাস্টিয়ান পেরায়িল; তোমারই কোম্পানির অডিট টিমে কাজ করত। এই তো, মাত্র দু’-মাস আগেও। আত্মহত্যা করার ঠিক আগে অবধিও।
না না, ভয় পেও না বাবা। কোনও নালিশ নিয়ে আসিনি। সন্তান হারানো মা আমি। পৃথিবীর কাছে আর কীই বা নালিশ করব বল তো? ক’টা কথা শুধু বলব বলে আজ এই চিঠি লেখা। এই অব্যক্ত শব্দভার নিয়ে মরেও যে আমার শান্তি নেই বাবা।
জানো বাবা, আনা আমার ছোটবেলা থেকেই ছিল মেধাবী। ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করত, খেলাধুলাতেও। চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সি পাশ করে তোমার কোম্পানিতে চাকরি পেল যেদিন, সেদিন আমরা বাইরে খেতে গেছিলাম। চাইনিজ। আনা বলেছিল, এবার নাকি আমার সব দায়িত্ব শেষ। এবার ও চাকরি করবে আর সে-পয়সায় আমরা দেশবিদেশ ঘুরতে যাব। বোঝো মেয়ের কথা! আমরা নাকি ওর রোজগারে বিদেশ ঘুরব। ছাই!
ঘুরতে যাই না যাই, মেয়ের সঙ্গে ঘোরার প্ল্যানিং করার বড় সাধ ছিল আমার। কিন্তু অফিস শুরুর পর থেকেই কাজের এত চাপ পড়ল ওর… খেত না, ঘুমোত না, আমাদের সঙ্গে কথা বলা তো দূর, বন্ধুদের সঙ্গেও মিশত না। খালি কাজ আর কাজ। অফিসে, বাড়িতে, মোবাইলে, ল্যাপটপে… সব জায়গায়, সবসময়। অফিস থেকে ফিরতে রাত হত। তারপর না-খেয়েই শুয়ে পড়ত। আমি বাড়া-ভাত ফ্রিজে তুলে দিতাম, রোজ।
বলতাম, এত কী কাজ করিস মা যে নাওয়া-খাওয়ার সময় পাস না?
‘তুমি বুঝবে না মামনি’– এই এক উত্তর পেতাম। যেমনটা মায়েরা আজীবন পায় আর কি।
ঠিকই বাবা। আমরা তো পুরনো দিনের মানুষ, বেশি বুঝি না। স্মার্টফোন, ফেসবুক বুঝি না, অ্যালেক্সা, রোবোটিক্স, চ্যাট জিপিটি থেকে নতুন জেনারেশনের অর্ধেক ভাষাও বুঝি না আমরা। কিন্তু কি জানো বাবা, সন্তান ভালো আছে কি না, এই একটা সত্য বুঝি। শরীরের প্রতি রন্ধ্রে বুঝি, বুকের প্রতি দুদ্দারে বুঝি, নিশ্বাসে আর বিশ্বাসে বুঝি, ছেলেমেয়ের লুকিয়ে ফেলা চোখের জল আর আমাদের ওপর করা অকারণ চোটপাটের আড়ালে মনখারাপের আসল ছবি, অণুবীক্ষণে বুঝতে একটুও সময় লাগে না আমাদের।
আনার ক্ষেত্রেও বুঝেছিলাম। বুঝেছিলাম ও ভালো নেই। বুঝেছিলাম, ওর কাজের চাপ ওকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না। আনার বাকি টিম মেম্বাররা অনেক আগেই তাই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল। আমিও আনাকে বলেছিলাম, ছেড়ে দে। বুঝিয়েছিলাম, এটা জীবন নয়, হতে পারে না। বলেছিলাম, জীবন মানে ভালো থাকা। আর কিচ্ছুটি নয়।
বললে বিশ্বাস করবে বাবা, এসব শুনে মেয়ে আমার বলে কি না, ‘মামনি, ইন লাইফ ওয়ান হ্যাস টু ওয়াক থ্রু দ্য বুলেটস টু সারভাইভ। মনে নেই?’
জানি, জানি। গুয়েতামালার ডায়েরি। কোন এক জন্মদিনে আমিই বইটা উপহার দিয়েছিলাম। আমি যে চাইনি আমার মেয়ে আরব্য রজনী, সিন্ডারেলা আর মেয়েদের ব্রতকথা পড়ে বড় হোক। চাইনি তাকে রূপকথা দিতে। চাইনি সে পক্ষীরাজে উড়ে আসা রাজপুত্রের অপেক্ষা আর ঈশ্বরের করুণার পথ চেয়ে বড় হোক। চাইনি সে আমার মতো পরের নেওয়া ভাত-কাপড়ের দায়িত্বে জীবনটা কাটিয়ে দিক। তাকে আমি লড়তে, স্বপ্ন দেখতে, আর স্বপ্ন সফল করার জন্য জমি কামড়ে, মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকতে শিখিয়েছিলাম। বুঝলে বাবা, আমার শেখানো পাঠ অন্তরাত্মায় গ্রহণ করেছে আমার মেয়ে। লড়ছে জীবন দিয়ে। আমারই বিপরীতে দাঁড়িয়ে বলছে, মামনি, ভালো থাকা মানে জাস্ট ‘ভালো থাকা’ নয়। ভালো থাকা আসলে একটা যুদ্ধ; মেটাফিজিক্যালই হোক বা সত্যিকারের। ভালো থাকার ডিসকোর্সকে জয় করতে হয়। অনেক সয়ে, অনেক ক্ষয়ে।
ভাবতে পারছ বাবা, এত বড় হয়ে গেছিল মেয়ে আমার; এত সমঝদার।
আজি এসো আনন্দাশ্রু, বহ হে কপোল জুড়ে।
ভাসিয়ে দাও, সিক্ত কর,
পুণ্যস্নানে, ধন্য কর হে মোরে।
জীবন অনল যন্ত্রণা মম যত,
প্রাপ্তি আমার অশেষ ছাপিয়ে তা,
আজি এ-জীবন গৌরব জয়রথ,
আজি এ-জীবন ধন্য হল যে নাথ।
অন্তরাত্মাকে এমনটাই বলেছিলাম সেদিন। ঠিক করেছিলাম, আন্নাকে আটকাব না আর। ও যা করতে চায়, যত কাজ করতে চায়, করুক। ভেবেছিলাম, মেয়ের আমার প্রথম চাকরি, সবে চার মাস। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবন আর কাজের ভারসাম্য ঠিক খুঁজে নেবে ও। নিজের মতো গুছিয়ে নেবে সব।
ভুল করেছিলাম বাবা। আনার সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আমি ভুল করেছিলাম। আমার উচিত ছিল দূরবর্তী গাছের ছায়ার মতো ওর মাথার ওপর ছাতার পরশটুকু ধরে রাখা। পারিনি। বলতে পারো, আই ফেইলড হার।
তাই আজ তোমার কাছে এসেছি বাবা। আমাদের মায়েদের কাছে তো সন্তানের কোনও বিচার হয় না। তাই তুমিও আমার সন্তানই। যে-কথা আনা বেঁচে থাকলে বলতাম, সেকথা তাই তোমায় বলে যাই আজ। কারণ তোমার বিপুল দায়িত্ব আছে বাবা। দায়িত্ব আছে তোমার অফিসের আরও চার লক্ষ ‘আনা’ আর তাদের আট লক্ষ বাবা মা-র ভালো থাকার। তুমি দেখো বাবা, ওরা সবাই যেন একটু দম নিতে পারে। একটু যেন বাঁচার মতো বাঁচতে পারে। কাজের জন্য বাঁচা নয়, বাঁচার জন্য বাঁচা। জীবঙ্কে ভালোবেসে বাঁচা।
…………………………………………………………
আরও পড়ুন প্রহেলী ধর চৌধুরী-র লেখা: গোপন দৃষ্টিসুখের খেলায় মেয়েরা নিত্য বোড়ে
………………………………………………………….
জানো বাবা, আনা চলে যাওয়ার পর, গত দু’-মাসে আমি তোমাদেরই ওই ইন্টারনেট, গুগল… ওসব ঘেঁটে কিছু পড়াশোনা করেছি। জেনেছি যে বিদেশে, মানে ধরো এই নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড, ডেনমার্ক, অস্ট্রিয়া, ফিনল্যান্ড… এসব দেশে সপ্তাহে ৩৪ ঘণ্টার বেশি কাজই করে না ওরা। আর এতে কিন্তু ওদের কোম্পানির কোন ক্ষতি হয় না বাবা। আমার যে দিদির মেয়ে লন্ডনে থাকে, সে বলল ব্রিটেনের লেবার পার্টি নাকি বিল আনছে, সপ্তাহে চারদিনের বেশি ওদেশও আর কাজ করাবে না; যাতে দেশের মানুষ শারীরিকভাবে সুস্থ থাকে আর মানসিকভাবে শান্তি পায়। আচ্ছা বাবা, আমাদের ছেলেমেয়েগুলোর জন্য এমন কিছু ভাবি না কেন আমরা? কেন ওরা সপ্তাহে ৪৯ ঘণ্টারও বেশি কাজ করে? এত চাপ নেয় কীসের তাড়নায়, যদি দু’দণ্ড শান্তিই না মেলে জীবনে?
জানো বাবা, আমার এই শূন্য ঘরে আজ অপার্থিব শান্তি। অনাড়ম্বরের শান্তি, অব্যস্ততার শান্তি, অবিরাম, অনাবিল, চিরন্তন এক শান্তি। পারলে একদিন ঘুড়ে যাও এই সাত নম্বর স্ট্রিটের বাড়ি। আমার আনার ঘরটি দেখে যাও। সে যে তোমায় আদর্শ মেনেছিল বাবা।
তার শূন্য ঘর, একবারটি দেখলে বুঝবে, শান্তি কাকে বলে।
ইতি,
মা।
(না, এ চিঠি আন্না সেবাস্টিয়ান পেরায়িলের মা লেখেননি। তবু কি এসে যায় তাতে? তোমার, আমার আর বিশ্বসংসারের সকল সন্তানের কোনও এক মা-এর লেখা এ চিঠি, আসলে তো আমাদের বাঁচিয়ে রাখার; সুস্থ থাকার, শান্তি পাওয়ার আর সময় করে দু’বেলা দু’মুঠো অন্ন মুখে তোলার রিমাইন্ডার।
আসল কথা তো এইটুকুই।)