বাংলায় কথা বলতেন গুরুজি। উনি যখন ক্লাস নিতেন তখন কড়া শিক্ষকের মতো ছাত্রদের সঙ্গে স্পষ্ট করে কথা বলতেন বাংলায়। যেমন চোখের চাহনি আস্তে আস্তে ছোট করা বা ছোট থেকে আস্তে আস্তে বড় করার সময় উনি বলতেন– চোখ ছোট, চোখ ছোট, চোখ ছোট, ব্যস্। চোখ বড়, চোখ বড়, চোখ বড়, চোখ বড়, ব্যস্। চোখ শক্ত, চোখ শক্ত, চোখ শক্ত, চোখ শক্ত। আমাদের চোখগুলোও কেমন ধীরে ধীরে হয়ে যেত ‘অর্ধনিমীলিত চক্ষু’ কিংবা ‘বিস্ফারিত নেত্র’।
৬.
একটা টুলের ওপর বসে আর একটা টুলের ওপরে ছোট্ট বাঁশের কাঠিতে ঠুকে ঠুকে তাল দিচ্ছেন গুরু। ধ্রুপদী নৃতশৈলী কথাকলির ‘কলাসম’। আমাকে তালিম দিচ্ছেন গুরু গোবিন্দন কুট্টি। পায়ের তলায় আঘাতে আঘাতে পেটানো চকচকে মেঝে। মাঝারি সাইজের ফাঁকা হলঘর। মুখে বোল, হাতে, কাঠের কাঠিতে তালের ঠোকাঠুকি। শব্দের ঘোরাঘুরি ঘরে, আলতো প্রতিধ্বনি।
তা, তা, কিটা তাকি তা,
তাক্ কিটা, কিটা তাকি তা।
কিটা তাকি, তাক্ কিটা,
কিটা তাকি, তা…
কেরলের শাস্ত্রীয় নৃত্যনাট্য, কথাকলির তাল এবং পদচালনার জটিল ছন্দ-বন্ধ, কলাসম। কোনও নৃত্যশিল্পী এবং অভিনেতার কঠোর প্রশিক্ষণের প্রথম ধাপ।
আমাকে যাঁরা চেনেন তাঁদের কাছে এখানে একটা খটকা! হঠাৎ ছবি আঁকা ছেড়ে নাচতে এল কেন? না, সেই অর্থে ‘ছবি আঁকা’ যাকে বলে তা ঠিকমতো শুরু হয়নি কিংবা বলা ভালো যে, এটাই বোধহয় ছবি আঁকা শুরুর আরেকটা ধাপ। সবই তো ছবি, অনির্দিষ্ট শিল্পকলা। একটা বোঝাপড়া। সে কথায় আসছি। তার আগে ভূমিকাটা আরেকটু করে নিই। জায়গাটা দক্ষিণ কলকাতার গড়িয়াহাটের কাছে ডোভার লেন। আরও একটা ব্যাপারেও জনপ্রিয় এই ডোভার লেন। তখনকার কলকাতায় ধ্রুপদী সংগীত সম্মেলনের পুণ্যভূমি। এইখানেই দক্ষিণ ভারতের কেরল কলামণ্ডলমের কলকাতা শাখা। কেরলের মূল প্রতিষ্ঠান কয়েক দশক ধরে সমগ্র বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ কথাকলি স্কুল হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। এটা শিল্প ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একটা অফিসিয়াল ইউনিভার্সিটিও। রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী পারফরমিং আর্টের সংরক্ষণ ও প্রচারের প্রধান প্রতিষ্ঠান। ১৯৩০ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে, এটি শিল্পী, শিল্প পণ্ডিত, ইতিহাসবিদ, থিয়েটার পরিচালক এবং কোরিওগ্রাফারদের জন্য নিঃসন্দেহে একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র।
আমি এখানে ঠিক কথাকলির ইতিহাস লিখতে বসিনি এখন। এ আমার পুরনো দিনের উৎসাহের উদ্দীপনার আর উত্তেজনার গল্প। এই ডান্স ফর্মটাতে আকৃষ্ট হই দুটো কারণে। একটা হচ্ছে, তাদের অসম্ভব সুন্দর মেকআপ। উজ্জ্বল ছবির মতো তার আকর্ষণী ক্ষমতা আর দৃশ্যশক্তি। আর একটা হচ্ছে কস্টিউম, তার মধ্যেও একটা সাংঘাতিক ধরনের বিস্তারিত দৃশ্য কল্পনা। মঞ্চে আবির্ভাবের মুহূর্তেই দর্শক জেনে যান চরিত্রটা। বেশিরভাগই পুরাণ কথা, রামায়ণ এবং মহাভারতের গল্প, তাই তার চরিত্রগুলো দর্শকের কাছে অনেকটাই চেনা। তাছাড়া কিছু কিছু প্রতীকী ভিস্যুয়াল, মানে পোশাক, মুখের মেকআপ-এর রং ইত্যাদিতে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না যে, চরিত্রটি একটি প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তিত্ব, যেমন রাজা, দেবতা ইত্যাদি না সাধু বা দানব।
কথাকলির চরিত্র-চিত্রণের আরও একটা জোরালো বিষয়, কোডেড ভিস্যুয়াল। বাংলাতে যেমন আমাদের পরিবেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী চরিত্রগুলোর কিংবা সাজ-সরঞ্জামের কী মানে বা গুরুত্ব, দর্শকরা অনেকটাই আন্দাজ করে নিতে পারার মতো ক্ষমতা রাখেন। ভালো দর্শক অথবা বুদ্ধিমান দর্শকদের এটা একটা অদ্ভুত ধরনের ক্ষমতা। যাত্রাপালায় স্কুলের মাঠে যখন দেখি মঞ্চে রাখা ক্লাসরুম থেকে নিয়ে আসা চেয়ারটিতে রাজা এসে বসেন, তখন কোনও দর্শকের বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না, এটা একটা সিংহাসন। আবার অন্য দৃশ্যে একটা বানর যখন ওই চেয়ারটির ওপরে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায় তখন হয়ে ওঠে একটা পাহাড়ের চূড়া বা উঁচু ঢিবি। আমার দক্ষিণ ভারতে বসবাসকালে আরেকটি জ্ঞান হয়েছে ওখানকার শিল্পের ক্ষেত্রে কিন্তু ততটা দর্শকের উপর ছেড়ে দেন না কিংবা আরও গভীরে যান। যেমন ধরা যাক, দক্ষিণ ভারতের মন্দির ভাস্কর্যের বেলায় তাদের মাপজোখ দেখছি রামের ক্ষেত্রে দশতাল, সীতা নবতালে, অঞ্জণেয় বা হনুমানের বেলায় তার নিজস্ব স্টেটাস অনুযায়ী শরীরের পোশাকের, অলংকারের মাপজোখ। তেমনভাবেই ধ্রুপদী নৃত্যের ক্ষেত্রেও সেই রকম কিছু কিছু মাপজোখ, পোশাকের, মুখোশের বা মেকআপের প্রতীকী রং ইত্যাদির আয়োজন থাকে, যেটাকে বলতে চাইছি, ‘কোডেড ভিস্যুয়াল’।
সমস্ত শিক্ষার ক্ষেত্রেই শুরুতে একটা পরীক্ষা থাকে, বড্ড ভয়ের ধাপ। গুরুজি, কলামণ্ডলম গোবিন্দন কুট্টি, আমার আপাদমস্তক, চোখ দিয়ে মাপলেন। শারীরিক গঠন, মানে অ্যানাটমি, চোখের মুখের চেহারা, হাত-পায়ের গড়ন, আঙুলের দৈর্ঘ্য– এমনকী, উচ্চতা সমেত সমস্ত কিছুই। মানুষের শরীরের অঙ্গভঙ্গি, অঙ্গচালনা এবং চলাফেরার মধ্যে দিয়ে যে একটি গতিমান শিল্প তৈরি হয়, তা সাংঘাতিকভাবে নির্ভর করে এই শারীরিক গঠনের ওপর। তাই, দেখে নিলেন, আমার মুন্ডুতে চোখ দুটো এক সমান, স্বাভাবিকভাবে খোলে, বন্ধ হয় এবং কালো চোখের মণির চারপাশে যথেষ্ট সাদাটাও দেখা যায়। কপাল, নাক এবং ঠোঁট মোটামুটি স্বাভাবিক আছে। গলা আছে যথাযথ, ঘাড়ে-গর্দানে এক নয়। উনি আমাকে দেখে যা বোঝার বুঝলেন, আমি তখন কিছুই বুঝলাম না। সবশেষে আমার না বেঁটে, না লম্বা চেহারার জন্যও মনোনীত হয়ে গেলাম।
কলকাতায় একটা জিনিস লক্ষ করার মতো। বিভিন্ন কাজে কলকাতার বাইরে থেকে যাঁরা আসেন, কিংবা পাকাপাকি ভাবে বসবাস করেন তাঁরা বাংলা ভাষাটা আগে শিখে নিতে চান। গুরুজিও বাংলায় কথা বলতেন। এটা শুধু উনি নন, ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে, শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রে, রেডিও-টেলিভিশন থেকে শুরু করে সবাই। শিল্পে-সাহিত্যে-অভিনয়ে সিনেমায়। শান্তিনিকেতনে এটা আরও বেশি। বাংলা ভাষা শিক্ষাটাই যেন সবচেয়ে জরুরি এবং প্রথম কাজ। মনে আছে চিন দেশে গিয়ে একজন চিনা ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ হয় এবং তিনি দিব্যি আমার সঙ্গে ডাল-ভাত মার্কা বাংলায় কথা বললেন। দীর্ঘদিন শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেছিলেন। আর একবার মরিশাসে একজন ফরাসি মহিলা শিক্ষকতা করছিলেন, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম ভাস্কর রাধাকৃষ্ণনের সঙ্গে। রাধাকৃষ্ণন মলায়ালম ভাষায় নয়, আর ওই ফরাসি মহিলাও ফরাসি ভাষায় না, আমরা তিনজনেই কথা বলছিলাম দিব্যি বাংলায়। শান্তিনিকেতনের ছাত্র এরাঁও। চমৎকার লাগছিল।
একটু অন্য দিকে চলে গেলাম। যা বলছিলাম, বাংলায় কথা বলতেন গুরুজি। উনি যখন ক্লাস নিতেন তখন কড়া শিক্ষকের মতো ছাত্রদের সঙ্গে স্পষ্ট করে কথা বলতেন বাংলায়। যেমন চোখের চাহনি আস্তে আস্তে ছোট করা বা ছোট থেকে আস্তে আস্তে বড় করার সময় উনি বলতেন– চোখ ছোট, চোখ ছোট, চোখ ছোট, ব্যস্। চোখ বড়, চোখ বড়, চোখ বড়, চোখ বড়, ব্যস্। চোখ শক্ত, চোখ শক্ত, চোখ শক্ত, চোখ শক্ত। আমাদের চোখগুলোও কেমন ধীরে ধীরে হয়ে যেত ‘অর্ধনিমীলিত চক্ষু’ কিংবা ‘বিস্ফারিত নেত্র’। ঠিক একই সুরে মুদ্রার ব্যবহারের বেলায় বলতেন– মুদ্রা শক্ত, মুদ্রা শক্ত, মুদ্রা শক্ত। কখনও একা থাকলে উনি আমাকে বোঝাতেন, মুদ্রাতে আঙুলের সাহায্যে যে প্যাটার্ন তৈরি হবে। সেই আঙুলের প্যাটার্নটাকে টোটালি ফ্রিজ করে দিতে হবে, ধরে রাখতে হবে। কবজি ঘুরিয়ে তাকে যেদিক খুশি ঘোরাও কিংবা মুদ্রাটাকে কাঁপাও, আঙুলের অবস্থানের যেন নড়চড় না হয়। সেটাকে উনি বলছেন, মুদ্রা শক্ত, মানে ধরে থাকো। মুদ্রা, মুখ এবং শরীরের ভঙ্গিমা মিলিয়ে টোটাল ভিস্যুয়াল কমিউনিকেশন। কথাকলি নিজেই একটা সম্পূর্ণ ভাষা। তাতে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ আছে, তার সংলাপে যতি আছে। বাঁ-হাতে মুদ্রার জন্য অনেক সময় আঙুলে লম্বা করে নখের মত রুপোলি রংয়ের ধাতুর অলংকার, যাতে দূর থেকেও মুদ্রার আকার এবং চালনা পরিষ্কার দর্শক বুঝতে পারে। ২৪ বা তারও বেশি মুদ্রা, ঠিক যেন অক্ষর বা হরফের মতো। ইংরেজি ভাষায় যেমন ২৬। অতএব এই হরফগুলো দিয়েই যেন একটি পরিপূর্ণ ভাষা, কমপ্লিট সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ। মঞ্চে এমনই একটি জোরালো শিল্পশৈলী দেখে মনে হল, এই তো আমাদের দেশের ধ্রুপদী মূকাভিনয়।
কথাকলি শিখতে এসেছিলাম একটাই উদ্দেশ্য নিয়ে, খুব পরিষ্কারভাবে মন তৈরি করে। এটা আমার মূকাভিনয়ে কাজে লাগাব বলে, পেশাদারি নৃত্যশিল্পী হতে নয়। মূকাভিনয়ের একটা নতুন মাত্রা দিতে উঠে-পড়ে লেগেছি তখন। মঞ্চে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে, দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে আর পুরুষালী প্রকাশভঙ্গির জন্য এর জুড়ি নেই। কথাকলির মানেটাও তাই। এখানে ‘কথা’ মানে গল্প, কাহিনি আর ‘কলি’ মানে বলা, পরিবেশন। আমি গুরুজিকে বলেওছিলাম সেকথা। তবে এই শিল্প মাধ্যমটি হাতে-কলমে, গায়ে-গতরে খেটেই শিখছিলাম, কারণ কথাকলি নৃত্যশৈলীতে আছে মঞ্চকে ধরে রাখার নানা রকম উপাদান আর পুরুষদের পক্ষে খুবই উপযুক্ত ডান্স ফর্ম। অল্পদিনেই গুরু শিষ্যের আড়ষ্টতা কাটিয়ে ওঠার পর গুরুজির সঙ্গে আমার একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হল এখানেও। আর শুরু হল নানারকম গল্প।
আমার ছবি আঁকার কথা, মূকাভিনয়ের চর্চার কথা উনি শুনতেন। কলামণ্ডলমের অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে আলাপ হতে থাকলো। ভেঙ্কিট, অসাধারণ নৃত্যশিল্পী, আলাপ হল। আর ছিলেন গুরুপত্নী, শ্রীমতি থাঙ্কমণি কুট্টি। ভরতনাট্যম আর মোহিনীঅট্টম শেখাতেন। রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যকে সমৃদ্ধ করার কাজে ওঁর অবদান অনেক। তাঁর ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা গুরুজির চেয়ে অনেক বেশি। তিনি কেরলে গুরু গোবিন্দন কুট্টির ছাত্রী ছিলেন। দু’জনে ঘর বেঁধে চলে এলেন সুদূর দক্ষিণ প্রান্ত থেকে দেশের পূর্ব প্রান্ত, কলকাতায়। আকর্ষণ, রবীন্দ্রসংগীতম। গড়ে তুললেন নিজেদের শিল্পের কর্মভূমি। প্রত্যেকে তার নিজের জায়গা বিশেষ করে জন্মভূমির গল্প এবং প্রশংসা করতে পারলে ছাড়তে চায় না। গুরুজিও সময় পেলেই তেমনই গল্প করতেন কেরলে। জন্মেছিলেন কথাকলির গ্রামে। সেখানকার অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনাদিকাল থেকেই বিশ্বজুড়ে ভ্রমণকারীদের এবং দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করেছে। সুগন্ধি মশলা, আয়ুর্বেদ চিকিৎসাশাস্ত্র, এমনকী, বিশ্বের প্রথম মার্শাল আর্টের আদি রূপেরও উৎপত্তি কেরলে।
আলাদা নৃত্যশৈলী হিসেবে কথাকলি সপ্তদশ শতকে শুরু হয়েছিল বলে ধরা হয় এবং শুধুমাত্র পুরুষদের দ্বারা পরিবেশিত হত। সেকালে নারী চরিত্রে পুরুষরাই অভিনয় করত। গুরুজি নিজেই বেশিরভাগ নারী চরিত্রে অভিনয় করতেন। যদিও অন্যান্য আরও পুরনো নৃত্যনাট্যের ধারা অনুসরণ করে এসেছে তাই স্পষ্টভাবে সনাক্ত করা যায় না এই নৃত্যশৈলীর বয়স। শাস্ত্রীয় নৃত্যের এ ধরনটি মন্দির এবং লোকশিল্প থেকেও উদ্ভূত বলে মনে করা হয়, যা প্রথম সহস্রাব্দ বা তারও আগে থেকে শুরু। হাজার বছরেরও পুরোনো আদি বা আদিম নৃত্যকলা। কর্মসূত্রে দক্ষিণ ভারতে বসবাসকালে আমার আরও অসাধারণ সব লোকনৃত্য আর প্রাচীন নৃতনাট্য দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছে। কথাকলির রূপ এবং তার দৃশ্য কল্পনায় আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম, মেকআপ, পোশাক, দর্শনীয় পরিবেশন, সংগীত-বাদ্য এবং আলোকসজ্জা মিলে মহাকাব্যের কিংবদন্তি চরিত্রগুলোর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়। শুরু শুরুতে কৃত্রিম আলোর অভাব। কেবলমাত্র প্রদীপের আলোয়-ছায়ায়, খোলা আকাশের নিচে স্বল্প পরিসরের পরিবেশে একটি পরাবাস্তব বিশ্ব তৈরি হয় যা আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে আচ্ছন্ন করে।
যেহেতু ছবি আঁকি তাই গুরুজির ইচ্ছে আমি মাঝে মাঝে অনুষ্ঠানের মেকআপের ব্যাপারে একটু হাত লাগাই। বিস্মিত হয়েছিলাম প্রথম যেদিন সত্যিকারের দেখলাম মেকআপ করার হ্যাপা। শিল্পীর চোখগুলো বড় করে দেখাতে গেলে প্রথমে সেটাকে পেনসিল বা তুলি দিয়ে আউটলাইন ড্রইং করে নেওয়ার কাজটা ওরা করে একটা কাঠের কাঠির সাহায্যে। কাঠির সরু ডগা দিয়ে ড্রয়িং, সেই কাঠি আড়াআড়িভাবে টেনে লম্বা লাইন, সেটাকেই পেতে রংগুলো সরিয়ে সরিয়ে ভরাটের কাজ। খুব মোটা করে রং ভরাট করা হয় সেই কারণে। ঠিক অয়েল পেইন্টিং-এর যেমন স্প্যাচুলা বা পেন্টিং নাইফ দিয়ে রং ভরাট করা হয় যেমন। আর এই খুব মোটা লেয়ার, মানে পুরু করে রং লাগানোর স্বতন্ত্রতার জন্য ‘গিনেস বুক অব রেকর্ডস’-এ জায়গা করে নিয়েছে কথাকলির মেকআপ। একেকজনের মেকআপ করতেই চার-পাঁচ ঘণ্টা চলে যায়। কখনও কখনও এই মেকআপ দুপুর থেকে শুরু করে সন্ধে পর্যন্ত চলে এবং শুইয়ে রেখে মেকআপ করতে করতে শিল্পী কখনও ঘুমিয়ে পড়ে। চোখকে লাল করার জন্য আবার কোনও এক ধরনের ফুলের বীজ চোখের মধ্যে লাগিয়ে রাখা হয়। কয়েক ঘণ্টায় চোখ একেবারে রক্তবরণ। রঙের ব্যাপারে এখানে আর একটা কথা বলে রাখা দরকার, ভেষজ, অর্থাৎ শাকসবজি এবং চালের পেস্ট থেকে প্রাপ্ত রং থেকে এ সমস্ত তৈরি করা হয়। তারপরে গালের দু’পাশে অর্ধচন্দ্রাকৃতি মোটা কাগজের ফ্রেম দিয়ে মুখখানাকে আলাদা করার ব্যবস্থা। সারা শরীরে, মুকুট থেকে পা পর্যন্ত পোশাক-আশাকে এত বিশাল আয়োজন তাতে মুখখানা হারিয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। তাই মুখখানা যাতে হারিয়ে না যায় সেই কারণে ওটাকে আলাদা করে রাখার জন্য কাগজের সাদা এই ফ্রেমের ব্যবস্থা। কথাকলিতে মুখের ভঙ্গিমার বিশেষ ভূমিকা।
সাত রকমের মৌলিক মেকআপে দেখেছি রঙের কোড বা মানে। প্রবাল বা লাল রঙের ঠোঁট সমেত সবুজ মুখ– শিব, কৃষ্ণ, রাম এবং অর্জুনের মতো দেবতা, ঋষি বা অন্যান্য মহৎ চরিত্রকে চিত্রিত করে। কমলা, জাফরান বা হলুদ রং ব্যবহার করে জানকী এবং পাঞ্চালীর মতো গুণী, ভালো মহিলা চরিত্র চিত্রিত হয়। অন্য মহিলা এবং সন্ন্যাসীদের রঙের কোড হল হলুদ। জটায়ু এবং গরুড়ের মতো বিশেষ চরিত্রগুলি আর একটা ভাগে। অন্যদিকে কালো হল শিকারি এবং বনের বাসিন্দাদের মতো চরিত্রর জন্য কোড। তেমনইই অন্ধকার, দুষ্টতা, বিশৃঙ্খল, ধ্বংসাত্মক ইত্যাদি চরিত্রর জন্য স্বতন্ত্র বরণ। লাল প্যাচ সমেত ভূত এবং অবিশ্বস্ত ইত্যাদি চরিত্রের আলাদা আলাদা মেকআপ।
একটা পেশাদারি ডান্স গ্রুপের সঙ্গে রবীন্দ্র সদনের মতো বিখ্যাত বড় অডিটোরিয়ামে জীবনে প্রথম নাচে অংশ নিলাম। তখনকার দিনে নামকরা কোরিওগ্রাফার অসিত চ্যাটার্জী, রবীন্দ্র নৃত্যনাট্য তাসের দেশ করছিলেন। সেখানে একটা তাসের দলের সামনে আমাকে রাখা হয়েছিল লিড করার জন্য। কথাকলির পায়ের চলন ব্যবহার হলো সেই অংশে। আসলে রবীন্দ্রসংগীতের বেলাতে যেমন একটা স্বরলিপির নির্দিষ্ট কঠোর নিয়মের মধ্য দিয়ে চলতে হয় তেমনই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যে নাচের বেলায় ততটা বাধ্যবাধকতা নেই। রবীন্দ্র-নৃত্য বলে কিন্তু উনি নিজে কোনও নির্দিষ্ট কোরিওগ্রাফ করেননি। সেখানে ডান্সফর্ম আমাদের দেশীয় ধ্রুপদী নাচের আঙ্গিক থেকে নেওয়া হয়েছে । যেমন মণিপুরী, ওড়িশি, ভরতনাট্যম, কথাকলি ইত্যাদি। একটা মিশ্র আঙ্গিক। সেই সময়ে মনে না হলেও পরবর্তীকালে মাথায় যে আসেনি তা নয়, বাংলায় মানে আমাদের পশ্চিমবঙ্গের কোন নৃত্যশৈলী কি স্বীকৃতি পেয়েছে ক্ল্যাসিক্যাল, অর্থাৎ ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পের? মনে পড়ে না। এতদিন পরে এখন দেখছি সংগীত নাটক অ্যাকাডেমি স্বীকৃতি দিচ্ছে ‘ছৌ’ নাচের, প্রতিবেশী আসামের ‘সত্রীয়া’ নাচ এই কিছুদিন আগে স্বীকৃতি পেল ধ্রুপদী নৃত্যশিল্পের।
আমাদের সমসাময়িক মূকাভিনেতা, শিক্ষক, নিরঞ্জন গোস্বামীর উদ্যোগে শিশিরমঞ্চে এক মূকাভিনয় উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। সে উৎসবে ছিল আমার মূকাভিনয় বিষয়ে ছবির প্রদর্শনী। বিশেষ বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ করা হয় গুরু গোবিন্দন কুট্টিকে। আমাদের মনের কথাগুলোই যেন অনেক গুছিয়ে বললেন সেদিন মঞ্চে। কীভাবে একাগ্রতা কাজে লাগাতে হয় সমস্ত শিল্প ক্ষেত্রে, শরীরের বিভিন্ন অংশের অনুভূতি প্রকাশের বিভিন্ন ভঙ্গিমা, মঞ্চের সঙ্গে দর্শকের যোগাযোগের বিষয়ে অনেক কিছুই বোঝালেন। অভিনেতার মাথায় অনেকগুলো ব্যাপার একসঙ্গে কাজ করতে থাকে মঞ্চে থাকাকালীন, সেগুলোকে সঠিক নিয়মে কাজে লাগিয়ে ঠিক ঠিক প্রকাশ এবং পরিবেশনার ক্ষমতা তৈরি করতে হয়। এই যে মনের ভাব প্রকাশ করার অভ্যাস, সেই অভ্যাসটা রপ্ত করতে অনেকটা নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে দিয়েই যেতে হয়, সেটার নাম চর্চা, সেটার নাম অধ্যবসায়, সেটার নাম অনুশীলন, সেটাই রেওয়াজ। সেটার নাম কথাকলিও বলতে চাইছিলেন হয়তো।
শিশির মঞ্চে ওই মূকাভিনয় উৎসবে আমার একটি প্রযোজনা ছিল। ‘মশা’ এই নামে যে স্কেচটি করেছিলাম সেখানে, তার বেশ খানিকটা অংশে কথাকলি নাচের স্টেপ কাজে লাগিয়েছিলাম। মশার গল্পটা ছিল এরকম– একজন বাঁশিবাদক, সে যখন একমন হয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে তখন একটি মশা তার কানে ঢুকে যায়। অতঃপর, মশার জ্বালাতন থেকে রেহাই পেতে এবং মশাটিকে ধরতে, মারতে বিস্তারিত অঙ্গ-ভঙ্গিমা। বাঁশির আয়োজনটা একটা বাড়তি প্রপ। মশা এমন একটা ক্ষুদ্র প্রাণী, মঞ্চে তার উপস্থিতি বোঝানো খুব মুশকিল। তাই ওই বাঁশিটা কখনো মশাকে পেটানোর লাঠি, কখনও আবার মশার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা। তখন লাঠিটা হয়ে গেল তলোয়ার। শেষে মশাটাকে মেরে, তাকে হাতে পিষেও শান্তি নেই। প্রচণ্ড রাগ দেখানোর জন্য সেটাকে মুঠো থেকে আছড়ে মাটিতে ফেলে পদাঘাতে পিষে মারা হচ্ছে। এই অংশটি মুহূর্তে নাচ হয়ে উঠল। পদাঘাতে মারাটায় পরিষ্কার আমি ব্যবহার করেছিলাম সিম্পল কলাসম, মানে মাটিতে পায়ের আঘাত করার কথাকলির পদচারণা। কলাসমের কথা শুরুতে বলেছি। যেখানে পায়ের পাতার বাইরের দিক মাটিতে জোরে আঘাত করা হয়। মানে ডান পায়ের পাতার ডানদিকের ধারটা আর বাঁ পায়ের পাতার বাঁদিকের ধারটার উপরে জোর দেয়া হয়। অন্য ডান্স ফর্মে পুরো পাতাটাই ফেলা হয় কখনও, কখনও পাতার ডগা বা গোঁড়ালি। এইভাবে মূকাভিনয়ের চলন বদলে যেতে থাকল দিনে দিনে।
পুরনো সেসব দিন পিছনে ফেলে এসেছি। পেরিয়ে এসেছি অনেকটা সময়। কলকাতা ছেড়ে দক্ষিণ ভারত, সেখান থেকে পশ্চিম ভারতের মুম্বই শহরের স্থায়ী বাসিন্দা এখন। আজও কথাকলি আমাকে ছাড়েনি কিংবা আমিও ছাড়িনি। সমান উপভোগ করি। একনিষ্ঠ দর্শক। এখন আমি মুম্বইয়ে যেখানে বসবাস করি ঠিক তার পাশেই অনেক পুরনো আইয়াপ্পা মন্দির। সেখানে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন নৃত্যশিল্পের পরিবেশনা চলতেই থাকে এবং বছরে একবার অন্তত মন্দির চত্বরে কথাকলির উৎসব। নানাভাবেই দেখেছি, কোনও চর্চা, কোনও শিক্ষার কিছুই যায় না ফেলা। একটা থেকে আর একটাতে মিশে যায়। পরবর্তীকালে চিত্রকলায় মুখটা আসলে একটা সাপোর্ট হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার কাছে। মুখটাই যেন পট, যাতে জলরঙে রং মাখানোটাই আমার খেলা। ঠিক যেমন করে হোলিতে অন্যের মুখে রং মাখিয়ে আনন্দ। পরে যখন ‘ফবিজ্ম’ পর্যায়ে পাশ্চাত্য ধারার চিত্রকলার কাজ ভালো লাগছে, কাজে প্রভাবিত হচ্ছি, সেখানে দেখছি হলুদ মুখ, সবুজ মুখ, লাল মুখ। তখনই পিছনে ফিরে ফিরে যাই কথাকলির সবুজ মুখ, কমলা মুখ আর কৃষ্ণবর্ণ, রক্তবর্ণ চোখের কাছে। আমি যে আজকাল এত মুখ আঁকি, ‘ফবিস্ট’দের মতো অবাস্তব রং মাখাতে ভালোবাসি মুখমণ্ডলে, তার পিছনে কি প্রচ্ছন্ন থাকে ফেলে আসা দিনগুলোর অভিজ্ঞতার কিছু কিছু? থাকতেও তো পারে। আমি জানি না। মনে হয় সমস্ত শিল্পকর্মই আপাত আলাদা। ধরন-ধারণ, সরঞ্জাম আলাদা। তবে শেষমেষ কোথাও যেন ভাব আর ভাবনার সমস্তটাই মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
এ ব্যাপারে লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তর্ক করেছিলেন। ১৯১০-এ লক্ষ্মীনাথের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাঁহী’ পত্রিকা। এই পত্রিকায় লক্ষ্মীনাথ অসমিয়া ভাষা-সংস্কৃতির নিজত্বকে যুক্তিনিষ্ঠভাবে প্রকাশ করেছিলেন।