শুনেছিলাম দেবব্রত বিশ্বাস আসবেন, আমায় আর পায় কে! ফ্লোর ম্যানেজার ধ্রুবদাকে অনুরোধ করলাম আমাকে স্টুডিও ফ্লোরের একপাশে যদি থাকতে দেন। দেওয়ার কথা নয়, কিন্তু দিলেন আমার অনুনয় বিনয়ে। এলেন তিনি, মুখে একটু বিরক্তির ভাব। কারণটা জানতাম, মেকআপ রুম থেকেই শুনে এসেছিলাম, আমাদের মেকআপ করিডরের পাশেই ওয়ার্ড্রোব সেকশন, সেখান থেকে একটা জামা পরতে হয়েছে ওঁর নিজের ফতুয়া বদলে, তাই। আমার একটু ভয় ভয় করছে যদি আমাকে দেখে কিছু বলেন। না, কে কোথায় আছে সেসব খেয়াল করলেন না, বসলেন নিজের জায়গায়, হারমোনিয়ামটা টেনে নিলেন, শুরু হল রেকর্ডিং। কোথায় রাগ বা বিরক্তি, সব ঊধাও নিমেষে, হেসে হেসে গাইলেন।
৭.
১৯৭৯। নতুন অধ্যায় শুরু হল, গার্হস্থ্য জীবনের মতো কর্মজীবনেও। রবিবার ও দ্বিতীয় শনিবার ছাড়া বাকি দিনগুলো সকাল সাড়ে দশটায় কনফারেন্স হলে প্রোগ্রাম মিটিং হত, এবার থেকে সেখানে যোগ দেওয়া আবশ্যিক হয়ে গেল। শিফট ডিউটিতে ভাগ হল আমাদের, তবে হঠাৎ কোনও জরুরি দরকারে কেউ আসতে না পারলে ডাবল শিফটও করতে হত। মানে আর খেলা খেলা নয়, রীতিমতো চাকরি ! তবে পরিবেশটা এতটাই আনন্দের ছিল যে, ‘মোদের যেমন খেলা তেমনি যে কাজ’ বলে লেগে পড়লাম।
অ্যানাউন্সারদের নিজস্ব কোনও ঘর ছিল না। ওই যে প্রায় সকলের ঘরের কথা লিখেছিলাম কিন্তু নিজেদের ঘরের কথা লিখিনি, খেয়াল আছে বোধহয়। এতদিন তার প্রয়োজনও পড়েনি কারও কাছে। আমরা ডিউটি রুমে বসে কিউ শিট্ দেখে অ্যানাউন্সমেন্ট লিখতাম, স্টুডিও ফ্লোর থেকে বেরিয়ে মাঝের সময়গুলোতে মেকআপ রুমে কাটাতাম, অনেকটা সময় ফাঁক পেলে একবার বড়জোর ক্যান্টিনে আসতাম, ট্রান্সমিশনের আগে এবং ট্রান্সমিশনের সময়টা এভাবেই কেটে যেত। কিন্তু এবার কী হবে? ঘর তো দিতেই হবে, পার্মানেন্ট পোস্ট! অথচ কোনও ঘর তো খালি নেই। তখন ব্যবস্থা হল, লাইব্রেরি ঘরে। এতদিন কেবল অপর্ণার টেবিল চেয়ার ছিল, এবার আরেকটা টেবিল ও দুটো চেয়ার এল সেখানে। ঠান্ডা ঘরে বসার ব্যবস্থাটা শিপ্রাদির তত্ত্বাবধানে হয়েছিল বলে যতদূর মনে পড়ছে। এতদিনে নির্দিষ্ট একটা বসার জায়গা পাওয়া গেল।
সে বছর আমাদের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান দর্শকের দরবারে পঞ্চম বর্ষে পড়ল। শুরু হয়েছিল ১৯৭৫-এর ১৩ অগাস্ট, অর্থাৎ ৯ আগস্টের পর প্রথম বুধবার। এইবারের আগস্টে পঙ্কজদা ঠিক করলেন অডিয়েন্সকে ডাকবেন, যাঁরা চিঠি লেখেন সেইসব দর্শককে। সেদিন তিনি আমাকে সহযোগী করলেন। স্টুডিও ফ্লোর ভর্তি দর্শক সমাগমে, তারই মধ্যে আমি লাল সিল্কের শাড়ি (তখন যদিও রং বোঝা যেত না) পরে ঘোরাঘুরি করেছি এটুকুই মনে আছে। পরবর্তী কালে দীর্ঘদিন ধরে দর্শকের দরবারে বসার হাতেখড়ি এদিনই।
রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর, বহুরূপীর ডাকঘর দূরদর্শনে ক্যামেরাবন্দি হবে বিভাসদার প্রযোজনায়, খবরটা কানে এসেছে। হবি তো হ’ সেদিনই আমার ট্রান্সমিশন ডিউটি। ট্রান্সমিশন মিটিং শেষ করে মেকআপ রুমের (রুম তো নয়, একটা করিডর) দিকে যাচ্ছি হঠাৎ পা আটকে গেল, দরজার সামনে শম্ভু মিত্র, রেকর্ডিং শেষ করে সবে ফ্লোর থেকে বেরিয়েছেন। গম্ভীর মানুষ, সাহস সঞ্চয় করে কাছে গিয়ে প্রণাম করি, মাথায় হাত রাখলেন। পাশে ছিল চৈতি ঘোষাল, অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বাড়ির টিভিতে আমাকে দেখতে পায় তাই এই বিস্ময়, নিচু গলায় জানাল ডাকঘরের অমল।
টেলিভিশনে থাকার দৌলতে এর আগে এবং পরে কত বিখ্যাত মানুষকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য যে হয়েছে, স্মরণীয় ঘটনা সেসব। আগের কয়েকটা ঘটনা বলি। ’৭৬ থেকে ’৭৮-এর মাঝামাঝি সময়।
শুনেছিলাম দেবব্রত বিশ্বাস আসবেন, আমায় আর পায় কে! ফ্লোর ম্যানেজার ধ্রুবদাকে অনুরোধ করলাম আমাকে স্টুডিও ফ্লোরের একপাশে যদি থাকতে দেন। দেওয়ার কথা নয়, কিন্তু দিলেন আমার অনুনয় বিনয়ে। এলেন তিনি, মুখে একটু বিরক্তির ভাব। কারণটা জানতাম, মেকআপ রুম থেকেই শুনে এসেছিলাম, আমাদের মেকআপ করিডরের পাশেই ওয়ার্ড্রোব সেকশন, সেখান থেকে একটা জামা পরতে হয়েছে ওঁর নিজের ফতুয়া বদলে, তাই।
আমার একটু ভয় ভয় করছে যদি আমাকে দেখে কিছু বলেন। না, কে কোথায় আছে সেসব খেয়াল করলেন না, বসলেন নিজের জায়গায়, হারমোনিয়ামটা টেনে নিলেন, শুরু হল রেকর্ডিং। কোথায় রাগ বা বিরক্তি, সব উধাও নিমেষে, হেসে হেসে গাইলেন, ‘কেন তোমরা আমায় ডাকো…’, আমার শ্রবণে কি সুধারস ঢালছেন তা আমিই জানি। আবার গান ধরলেন, ‘তুমি খুশি থাকো, আমার পানে চেয়ে চেয়ে খুশি থাকো…’। এই রেকর্ডিংটা এখনও আছে, অন্যান্য অনেক মূল্যবান জিনিসের মতো হারিয়ে যায়নি। সাদা-কালোয় কী ঔজ্জ্বল্য যে তিনি আনতে পারেন গানের মধ্য দিয়ে তা প্রত্যক্ষ করেছিলাম।
আরেকদিন, তৃপ্তি মিত্রর সাক্ষাৎকার নিতে এলেন কেয়া চক্রবর্তী, মনে আছে একটা বিচিত্রপুরী শাড়ি পরেছিলেন। ‘তিন পয়সার পালা’-র পারুল আমার সামনে, উন্মাদনাই আলাদা। ওঁকে আগেও সামনে দেখেছি অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে, তবু নিজের জায়গায় অন্যরকম শিহরণ। অসামান্য এক অভিনেত্রী নিলেন অনন্য এক অভিনেত্রীর সাক্ষাৎকার। জানি না সে সাক্ষাৎকার রক্ষিত হয়েছে কি না।
’৭৬-এর আরেকটি মনে রাখার মতো অনুষ্ঠানের কথা বলব। রাজেশ্বরী দত্তর সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন গৌরী ঘোষ। PCR (production control room)-এ দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম পুরো রেকর্ডিংটা। রাজেশ্বরী দত্তের গানের যেমন ভক্ত ছিলাম, ঠিক তেমনভাবেই কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের স্ত্রী হিসেবে আলাদা সম্মান দিতাম। অনবদ্য সেই কথোপকথন। ওই রেকর্ডিংয়ের কিছুদিনের মধ্যেই পথ দুর্ঘটনায় রাজেশ্বরী দত্ত মারা যান। তাই এই অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল স্মরণ অনুষ্ঠান (obituary program) হিসেবে।
এই পর্ব শুরু করেছিলাম লাইব্রেরি ঘর দিয়ে। অপর্ণার সঙ্গে বন্ধুত্বটা শেষে এমনই প্রগাঢ় যে একটা মজার ব্যাপার হল। প্রায় একই সঙ্গে আমরা মেটারনিটি লিভ নিলাম, ও কিছু আগে, আমি পরে। সুবিধে ছিল এই যে, যেহেতু আমাদের mid shot নেওয়া হত, তাই আমি শেষদিন অবধি ক্যামেরার সামনে আসতে পেরেছিলাম। ৩১ অক্টোবর রাত পর্যন্ত ট্রান্সমিশনে ছিলাম, কেবল মাঝখানে ফ্লোরের পাশে যে ঘর ছিল, যেখানে আমাদের ট্রান্সলেশন মিটিং হত এবং ভিআইপিরা অনেক সময় এসে বসতেন, সেই ঘরে এসে ঘোষণার মাঝে মাঝে পা তুলে বসতাম, কিছুটা আরাম হত।
ব্যস, পরদিন থেকে আর আসা হল না। তিন মাসের ছুটি।
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব …………………………….
পর্ব ৬: ভারিক্কিভাব আনার জন্য অনন্ত দাস গোঁফ এঁকেছিলেন অল্পবয়সি দেবাশিস রায়চৌধুরীর মুখে
পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে