আমি প্রথমদিকে যখন যেতাম, তখন কবিতাদি থাকতেন গোবিন্দ ঘোষাল লেনে। মিত্র স্কুলে কাছে, ভবানীপুরের সেই বাড়িটি ছিল অপরিসর ও দীন। কবিতা সিংহকে তো আমি রেডিওর সূত্রে জানতামই। আমি তখনও তাঁর কোনও কবিতা পড়িনি। আমার সেই অল্পবয়সে আমি শুনেছিলাম রেডিওয় ঈষৎ খসখসে অথচ মাদকতাময় অত্যন্ত আকর্ষণীয় কণ্ঠস্বরে পড়া জীবনানন্দের ‘হায় চিল’ কবিতাটি। আজও যেন শুনতে পাই ‘হায় চিল’ কবিতার সেই লাইন। ‘…হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/ তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদোনাকো ধানসিড়ি নদীটির পাশে।’ জীবনানন্দর এই কবিতার শেষ লাইনের সঙ্গে কবিতা সিংহও যেন যুক্ত হয়ে গিয়েছেন। আমি সেই দীন বাড়িতে, নবনীতা দেবসেনের ভাষায় ‘দীপশিখার মতো উজ্জ্বল’ কবিনারীকে যেন মেলাতে পারছিলাম না। পরে বুঝেছি, বাড়ির ভেতরের ওই দীন পরিবেশ কবিতা সিংহের ব্যক্তিত্বকে, তাঁর অস্তিত্বকে অনেক তীব্র ও উজ্জ্বল করতে সাহায্য করত।
সাতের দশকের শুরুতে আমি যখন বাংলা কবিতা লিখতে আসি, তখন আমার আগে যেসব কবিনারী আধুনিক বাংলা কবিতা লিখছিলেন, তাঁদের মধ্যে অবশ্যই কবিতা সিংহ ছিলেন সব চাইতে উজ্জ্বল, সব চাইতে তীব্র।
আমি যেদিন প্রথম কবিতাদির বাড়িতে যাই, আমার পত্রিকা ‘অহঙ্কার’-এর প্রথম সংখ্যার জন্য কবিতা আনতে, সেদিন আমার সঙ্গে ছিলেন দেবারতি মিত্র। কবিতা সিংহকে প্রথম দেখে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। অপূর্ব সুন্দরী সেই নারী, সেদিন ছিলেন বিশেষভাবেই এলোমেলো পোশাকে সজ্জিত। বেশভূষার দীনতা আমাকে বিস্মিত করেছিল! ধীরে ধীরে জেনেছিলাম, নারীর রূপকে তিনি নারীর মননশীল অস্তিত্বের শত্রু বলে মনে করতেন। অত্যন্ত রূপবতী ছিলেন বলেই হয়তো তাঁর মনে হত, নারীর রূপ তাঁকে যে দরজার দিকে টেন নিয়ে যায়– তা তাঁর চেতনাদীপ্ত অস্তিত্বের বিরোধী। তিনি সব চাইতে বেশি মূল্য দিতেন চেতনাকে, মননশীলতাকে।
কবিতা সিংহ নিজেকে ‘মহিলা কবি’ বলতে চাইতেন না। এ ব্যাপারে আমার ভাবনা অবশ্য বিপরীত। আমি মনে করতাম এবং এখনও মনে করি, কবিতা সিংহের কবিতায় তাঁর নারী অস্তিত্ব জাজ্বল্যমান। কবিতা সিংহ যেসব কবিতা লিখেছেন তা কোনও পুরুষ কবির পক্ষে কখনওই লেখা সম্ভব ছিল না। একথা অবশ্য সব কবিনারী সম্পর্কেই প্রযোজ্য। মেয়েদের লেখা কবিতা পড়লেই বোঝা যায়, তা মেয়েদের কবিতা। সে যিনিই লিখে থাকুন না কেন– স্যাফো, এমিলি ডিকিনসন, রাজলক্ষ্মী দেবী বা কবিতা সিংহ।
এক তীব্র-তীক্ষ্ণ নারী অস্তিত্বকে তিনি লালন করতেন এবং প্রবলভাবে প্রকাশ করেছেন কবিতা সিংহ। নারীর সৃষ্টিশীলতাকে, নারীর মননশীলতাকে সমাজের অস্বীকার করার প্রবণতায় তিনি ক্ষুব্ধ ছিলেন। ধিক্কার দিতেন নারীর রূপ ছাড়া আর কোনও ক্ষমতাকে স্বীকার না করতে চাওয়ার মানসিকতাকে।
……………………………………….
আমি একদিন ওই বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, কবিতা সিংহের স্বামী– বিমল রায়চৌধুরী ক্ষুব্ধ ও বিচলিত। কারণ কবিতা সিংহ অত্যন্ত প্রত্যুষে উঠে একা একা চলে গিয়েছিলেন হাঁটতে ময়দান পর্যন্ত। বিমল রায়চৌধুরী বলছিলেন, অত ভোরে ওঁর একা একা যাওয়া উচিত হয়নি, সঙ্গে তিনিই যেতে পারতেন। কবিতা সিংহ বলছিলেন তিনি একা হাঁটতেই পছন্দ করেন। ময়দানের গাছ থেকে তুলে আনা ফুলের ডাল সংগ্রহ করে এনেছিলেন। সেই ফুল আমাকে দেখালেন ও জেদ করে বলতে লাগলেন, এরপরও তিনি একাই যাবেন হাঁটতে– কেননা ওই গাছপালা ও রাস্তার সৌন্দর্য তিনি একাই বেশি ভালো করে অনুভব করতে পারেন। এই ভাবনার মধ্য দিয়ে আমরা কবিতা সিংহকে চিনতে পারি।
……………………………………….
আমি প্রথমদিকে যখন যেতাম, তখন কবিতাদি থাকতেন গোবিন্দ ঘোষাল লেনে। মিত্র স্কুলে কাছে, ভবানীপুরের সেই বাড়িটি ছিল অপরিসর ও দীন। কবিতা সিংহকে তো আমি রেডিওর সূত্রে জানতামই। আমি তখনও তাঁর কোনও কবিতা পড়িনি। আমার সেই অল্পবয়সে আমি শুনেছিলাম রেডিওয় ঈষৎ খসখসে অথচ মাদকতাময় অত্যন্ত আকর্ষণীয় কণ্ঠস্বরে পড়া জীবনানন্দের ‘হায় চিল’ কবিতাটি। আজও যেন শুনতে পাই ‘হায় চিল’ কবিতার সেই লাইন। ‘…হায় চিল, সোনালি ডানার চিল, এই ভিজে মেঘের দুপুরে/ তুমি আর উড়ে-উড়ে কেঁদোনাকো ধানসিড়ি নদীটির পাশে।’ জীবনানন্দর এই কবিতার শেষ লাইনের সঙ্গে কবিতা সিংহও যেন যুক্ত হয়ে গিয়েছেন। আমি সেই দীন বাড়িতে, নবনীতা দেবসেনের ভাষায় ‘দীপশিখার মতো উজ্জ্বল’ কবিনারীকে যেন মেলাতে পারছিলাম না। পরে বুঝেছি, বাড়ির ভেতরের ওই দীন পরিবেশ কবিতা সিংহের ব্যক্তিত্বকে, তাঁর অস্তিত্বকে অনেক তীব্র ও উজ্জ্বল করতে সাহায্য করত।
আমি একদিন ওই বাড়িতে গিয়ে দেখলাম, কবিতা সিংহের স্বামী– বিমল রায়চৌধুরী ক্ষুব্ধ ও বিচলিত। কারণ কবিতা সিংহ অত্যন্ত প্রত্যুষে উঠে একা একা চলে গিয়েছিলেন হাঁটতে ময়দান পর্যন্ত। বিমল রায়চৌধুরী বলছিলেন, অত ভোরে ওঁর একা একা যাওয়া উচিত হয়নি, সঙ্গে তিনিই যেতে পারতেন। কবিতা সিংহ বলছিলেন তিনি একা হাঁটতেই পছন্দ করেন। ময়দানের গাছ থেকে তুলে আনা ফুলের ডাল সংগ্রহ করে এনেছিলেন। সেই ফুল আমাকে দেখালেন ও জেদ করে বলতে লাগলেন, এরপরও তিনি একাই যাবেন হাঁটতে– কেননা ওই গাছপালা ও রাস্তার সৌন্দর্য তিনি একাই বেশি ভালো করে অনুভব করতে পারেন। এই ভাবনার মধ্য দিয়ে আমরা কবিতা সিংহকে চিনতে পারি।
একাকিত্ব ও অন্ধকার– এই দুই প্রিয় ছিল কবিতা সিংহের। যে চেতনাদীপ্ত, বোধদীপ্ত অনুভূতির তিনি অধিকারিণী ছিলেন, তা শুধু একাকিত্বকেই বরণ করে নেয়। তাঁর সমস্ত কবিতার ভেতরে ভেতরে বয়ে যাচ্ছে সচেতন নারীর একাকিত্ব। যে একাকিত্ব ছিল এমিলি ডিকিনসনের, আনা আখতামোভা, ছিল রাজলক্ষ্মী দেবীর– যে একাকিত্ব শিল্পীর বেঁচে থাকার সঙ্গে অবধারিতভাবে জড়িয়ে থাকে। শিল্পী নারীর ক্ষেত্রে একাকিত্বের বোধ আরও তীব্র হয়ে ওঠে।
বিমল রায়চৌধুরীর মৃত্যুর পর ওই বাড়ি ছেড়ে গল্ফগ্রিনের ফ্ল্যাটে চলে এসেছিলেন কবিতাদি। কবিতাদির বড় মেয়ে অভিনেত্রী রাজেশ্বরীর মৃত্যুর পর আমি গিয়েছিলাম সেই ফ্ল্যাটে। এই মৃত্যুর খবর আমি পেয়েছিলাম জলপাইগুড়িতে, আমার কর্মক্ষেত্রে। তখনই কবিতাদিকে আমি একটি চিঠি লিখেছিলাম। ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখলাম, তখন সমস্ত হৃদয়বিদারক শোককে সংহত করে কবিতাদি কলম নিয়ে বসেছিলেন। আমাকে দেখে বললেন, ভাস্বতী, তোমার চিঠি আমাকে গভীর স্বান্ত্বনা দিয়েছে। বারবার তোমার চিঠিটি পড়েছি। তখনই আমার মনে হয়েছে, চিঠিতে আমি কী লিখেছিলাম কে জানে, যা কবিতাদিকে গভীর স্বান্ত্বনা দিতে পেরেছিল! আমার সেই চিঠির কথা আমার এখনও মাঝে মাঝে মনে হয়। কী ছিল সেই চিঠিতে! চিঠির কোনও কপি তো আমি রাখিনি!
একদিন হঠাৎ ফোন করলেন কবিতাদি। ‘বিভাব’ পত্রিকার কবিতা সংখ্যায় আমার একটি কবিতা বেরিয়েছিল। কবিতাদি সেই লেখাটি পড়েই আমাকে ফোন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কবিতাদি বললেন, কী আশ্চর্য কবিতা লিখেছ! লিখে যাও ভাস্বতী! লিখে যাও। লেখা কখনও থামিও না। সেই অগ্রজ কবির আন্তরিকতা আমার কাছে চিরকালের প্রেরণা হয়ে রয়ে গিয়েছে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম– সুখ, যন্ত্রণা, হতাশা, বেদনা, অত্যন্ত দায়িত্বশীল চাকরির প্রবল চাপ– সব বহন করে তিনি লিখে গিয়েছিলেন, তাই বলেছিলেন এই কথাগুলি।
শেষবার যখন গল্ফগ্রিনের ফ্ল্যাটে আমার সঙ্গে দেখা হল, তখন তিনি আমেরিকায় যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। তাঁর কনিষ্ঠ কন্যা পরমেশ্বরীর কাছে যাবেন বললেন। বললেন, আমি ঘুরে এসে এবার তোমার কাছে একবার জলপাইগুড়িতে যাব। আমাকে তুমি জলদাপাড়ার অরণ্য দেখাতে পারবে? জলঢাকার মূর্তি দেখাতে পারবে? আমি সাগ্রহে বলেছিলাম, পারব। কিন্তু সেই সুযোগ আর পেলাম না। আমেরিকায়, তাঁর পরমেশ্বরীর কাছেই, কবিতা সিংহের মৃত্যু হল।
কিন্তু কবিতা সিংহের মৃত্যুর খবর আমি সঙ্গে সঙ্গে পাইনি। কারণ কোনও কাগজেই এক কোনাতেও কবিতাদির মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হয়নি। কোনও কোনও লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হল সে সংবাদ, কিন্তু তা অনেক পরে। রাজলক্ষ্মী দেবীও ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, কারণ কবিতাদির মৃত্যুর কথা তিনি জেনেছিলেন ‘সাহিত্যসেতু’ নামের একটি লিটল ম্যাগাজিন থেকে।
আধুনিক কবিতার জগতে পথিকৃত কবিনারী, কিন্তু জীবৎকালে, তিনি স্বীকৃতি পাননি। কবিতাদির মতো কবিরা উপযুক্ত মর্যাদা না পাওয়ায় আমরা তো দুঃখিত ছিলামই। আমরা, যারা তাঁকে দেখেছি একসময়, যারা তাঁকে চিনেছি। আজ মনে হচ্ছে পরবর্তী প্রজন্ম তাঁকে হয়তো পথিকৃতের মর্যাদা দেওয়া শুরু করেছে। এখন আমরা খুশি হচ্ছি, সন্তুষ্ট হচ্ছি। আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠছে আধুনিক কবিতার জন্য অনেক হতাশা, অনেক অভিমান, অনেক বেদনা সহ্য করতে করতে এগিয়ে চলা সেই কবিনারীকে, যাঁর নাম নাম ছিল কবিতা সিংহ।