মাইক গ্যাটিং ও অ্যান্ড্রু স্ট্রস– বেচারা দু’জন! এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুটো বল ওঁদেরকে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু সে তো বলবিন্দর সিং সাধুর ইনসুইংও শ্বাপদের মতো সাবাড় করেছিল গ্রিনিজ-কে। যদিও তা ‘বল অফ দ্য সেঞ্চুরি’ থেকে ১০০ যোজন দূরে, কিন্তু আমার কথা তা নয়। সাধু আর ওই ইনসুইং জীবনে করেননি। বিস্ময়কে রিপিট করাটাই একজনকে কিংবদন্তি বানায়। পায়ের পিছন দিয়ে বোল্ড করাটা শেন একটা স্টেটমেন্ট, একটা নিয়ম করে ফেলেছিলেন।
শেন ওয়ার্ন– কী বলি বলুন তো এই মানুষটাকে নিয়ে?
আমার দেখা তিন বিভাগের তিন সর্বশ্রেষ্ঠর নাম শচিন, আক্রম, ওয়ার্ন। তার মধ্যে ওয়ার্ন আমাদের প্রজন্মের কাছে ছিলেন চলমান বিস্ময়! সোনালি চুল, কানে হিরের স্টাড, তিন পা হেঁটে আলতো লাফ, আহা কবিতা! ঘটনাচক্রে আমিও কবজি স্পিনার ছিলাম। শেনকে দেখে দু’পা হেঁটে বল করা শুরু করেছিলাম নেটে। কোচ দু’দিন দেখে আমাকে ডেকে বললেন, ‘যাকে নকল করে এই বলটা করার চেষ্টা করছিস, তাঁর শোল্ডারের সাইজ দেখেছিস? আর দু’দিন এইভাবে বল করলে হাতে প্লাস্টার লাগিয়ে ঘুরতে হবে।’ আমি আমার পুরনো রান আপে ফিরে গেলাম।
স্টারিং মাইক গ্যাটিং ও অ্যান্ড্রু স্ট্রস– বেচারা দু’জন! এই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দুটো বল ওঁদেরকে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু সে তো বলবিন্দর সিং সাধুর ইনসুইংও শ্বাপদের মতো সাবাড় করেছিল গ্রিনিজ-কে। যদিও তা ‘বল অফ দ্য সেঞ্চুরি’ থেকে ১০০ যোজন দূরে, কিন্তু আমার কথা তা নয়। সাধু আর ওই ইনসুইং জীবনে করেননি। বিস্ময়কে রিপিট করাটাই একজনকে কিংবদন্তি বানায়। পায়ের পিছন দিয়ে বোল্ড করাটা শেন একটা স্টেটমেন্ট, একটা নিয়ম করে ফেলেছিলেন। এবং সেই ফর্দে পৃথিবীর অনেক তাবড় নাম আছে। এরকম আক্রমণাত্মক স্পিনার যাঁর ফ্লিপার নাকি ম্যাকডারমটের চেয়ে জোরে ছিল, হিলির মতে– আমি দেখিনি। ওর এক-একটা বলে আউট হয়ে ব্যাটারদের মুখ ‘নক আউট’ পাঞ্চ খাওয়া বক্সারদের মতো হত। রাফ অ্যান্ড টাফ পিচে একটু রাফ দেখলেই ব্যাটারদের জীবন টাফ করায় তাঁর জুড়ি ছিল না।
Shane warne one of the greatest captain Australia never had
শেন সহ-অধিনায়ক হয়েছিলেন, পন্টিংয়ের আগে তাঁরই ক্যাপ্টেন হওয়ার কথা। কিন্তু এঁকে সামলাবে কে? আজ নোংরা টেক্সট, কাল সেক্স টেপ, পরশু গোটা পৃথিবীর জন্য সিগারেট খারাপ বলে মিলিয়ন ডলার নিয়ে পাবলিক স্পেসে ফুঁকে দিয়েছেন– কেলেঙ্কারি লোক! তার সঙ্গে ড্রাগ টেস্টে ধরা পড়ে ২০০৩ বিশ্বকাপ থেকে বাদ পড়া এবং এক বছর সব ধরনের ক্রিকেট থেকে ব্যান হওয়া– এ কী করে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে! কিন্তু একজন স্পিনারের শ্রেষ্ঠ সমঝদার হয় কিপার। হিলি ও গিলক্রিস্ট– দু’জনেই বলেছেন এরকম ক্ষুরধার বারখুরদার তাঁরা দেখেননি।
দেশের যে দায় থাকে, ফ্র্যাঞ্চাইসির সে দায় থাকে না। তাই আইপিএল লুফে নিয়েছিল এই ক্যাপ্টেনকে, একই সঙ্গে বুঝেছিল, একে ক্যাপ্টেন করলে অন্য কাউকে কোচ করে লাভ নেই, এ খ্যাপা শুনবে না। সবটাই এ করুক। ততদিনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছেন ওয়ার্ন। আইপিএলের সবচেয়ে সস্তা টিম রাজস্থান রয়্যালস জিতেছিল প্রথম আইপিএল। তখন জনৈক ‘বাচ্চা’র নাম দিয়েছিলেন ‘রকস্টার’, কারণ তাঁর হাতেই ওঁর জন্ম– তিনি রবীন্দ্র জাদেজা।
A person from oceania with a heart like an ocean
ভারতীয় সংস্কৃতি আর অস্ট্রেলিয়া এত আলাদা যে, বলে বোঝানো সম্ভব নয়। আমাদের ভদ্রতার ধার ওরা ধারে না। আবার আমরাও ওদের মাঠের ঝগড়া মাঠে ফেলে আসার কালচার অনেক দিন বুঝিনি। বুঝেছি, যখন শুনেছি পন্টিংয়ের মতো লোক কেকেআর-এর ২২তম ব্যাটারকেও সবটা শিখিয়েছে। এবং টিমে ওঁর নাম ‘পন্টিংদা’। সেই বেস্ট অস্ট্রেলিয়ান টিমের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অস্ত্র বলছেন, ‘সচিন আসে আমার দুঃস্বপ্নে।’ আপনাকে বুঝতে হবে দেশটা। এরা হার বরদাস্ত করে না। লারউড নিয়ে ব্র্যাডম্যান নাচছেন– এরকম নিদর্শন নেই, কিন্তু সচিনের জার্সি ওয়ার্ন চেয়ে নিচ্ছেন, এ আমাদের স্বচক্ষে দেখা। কতটা আকাশ একটা মানুষের মধ্যে থাকলে, কতটা আত্মবিশ্বাস একজন মানুষের মধ্যে থাকলে এভাবে নতজানু হওয়া যায়? নাদাল যখন ফেডেরারের শেষ ম্যাচে কাঁদছিল, আমি আপনাকে মিস করছিলাম শেন, বন্ধুত্বের ও প্রতিযোগিতার এই লেগ্যাসি যা আপনি রেখে গেলেন, তা এই ঘৃণার পৃথিবী থেকে অনেক দূরে।
শেষ দৃশ্য
শেন একটু বেশি ঘুমিয়ে পড়েছেন ম্যাসাজ করিয়ে এসে। স্প্যানিশ মেশানো ভাঙা ইংরেজিতে একজন ওঁকে ডাকলেন। থাইল্যান্ডের অস্তগামী সূর্যে লোকটার ঝাঁকড়া চুল ছাড়া কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সে শুধু বলল, ‘আমাদের একটা ক্লাব করেছি, আয়।’ ‘কীসের ক্লাব’ বলার আগেই শেন টের পেলেন শ্বাসের কষ্ট আর নেই, আঙুলের বাতটাও সেরে গেছে। এগুলো তো হওয়ার কথা নয়– বাচ্চাগুলো? তবু মনে হল ভুল হচ্ছে, অনেক কষ্টে জিগ্যেস করলেন শেন, ‘তুমি কে?’
“আমি তোর আয়না, তোর ডানহাত আয়নার নিয়ম মেনে দিক বদলে বাঁ পায়ে এসে গেছে। চ’, যাই।”
শেন ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘স্বর্গ না নরক– কোথায় যাচ্ছি স্যর?’
ঝাঁকড়াচুলো খুব ভাবার অ্যাক্টিং করলেন, যেমতি পেনাল্টি চায় কেউ। তারপর বললেন, “ওরা বুঝতে পারছে না কোথায় রাখবে আমাদের, নরকে রাখলে স্বর্গ বানিয়ে দিচ্ছি, স্বর্গে রাখলে নেশা করে, আরও যা-তা করে নরক বানিয়ে দিচ্ছি। আমাদের নিজস্ব একটা মাঝামাঝি জায়গায় প্লট দিয়েছে। এই নে তোর দুল ফেরত নে, অস্তগামী সূর্যের আলো পড়ল সেই হিরের আলোয়। শেন দেখলেন নিজের হিরোকে। অস্ফুটে বললেন, ‘হাত দিয়ে গোল ক্যানো করলেন…’”
শেনের হাত ধরে ঝাঁকড়াচুলো নিয়ে যেতে যেতে বললেন, ‘কারণ আমি জানতাম একদিন তোর বেটিং-এ নাম জড়াবে। নিখুঁত হতে নেই, খ্যাপা।’
হঠাৎ চাঁদের আলো একটা সেতুর আয়োজন করল, ভুলের মধ্যে দিয়ে যাওয়া শিল্পীর সেতু, সে কী অজস্র যাতায়াত! কয়েকজন নিজেই বড্ড কষ্ট পেয়েছেন, কিন্তু নিজের ভুলকে রাজার মতো উদযাপন করেছেন মাত্র কয়েকজনই।
তিনি শেন ওয়ার্ন, যদি সময়মতো জন্মাতেন, সূর্যকে ঘুরিয়ে দিতে পারতেন। তিনি মরে গিয়ে নিজেকে কী করেছেন জানি না, আই লস্ট অ্যা ফ্রেন্ড অ্যান্ড অ্যা লেজেন্ড। যে ঈশ্বর ছিল না, মানুষ ছিল।
কিছু মানুষ বাঁচতে আসে, বেঁচে থাকতে নয়। শেন ওয়ার্নের কোনও ডেডবডি নেই, ওটা থাকে না।