স্মৃতির বিশ্রামতলায় আমরা, আমাদের জীবন। প্রতিটি মানুষ যদি গল্প, তবে সে-গল্প স্মৃতি দিয়েই ঘেরা। স্মৃতির ভিতর আরও অনেক মানুষ। মানুষের মেলা। স্মৃতি মানুষকে বহু মানুষের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ করে। একদিন হাত পেতে জীবনের পোয়াটুকু গল্প যদি তাই জীবনের থেকেই চেয়ে নিতে হয় তাহলে স্মৃতির কাছেই আমাদের যাবতীয় ঋণ এবং সমর্পণ।
আশ্চর্য এক গন্ধ আজীবন তাড়া করে ফেরে। আমাদের প্রত্যেককেই, সম্ভবত। আমরা হেঁটে যাই। সামনের দিকে। পিছু ফিরে তাকাই। মাঝেমধ্যে। গন্ধের কোনও অবয়ব হয় না। তবু অনুভবে জানি, সে আছে। একদিন তার সান্নিধ্য না-পেলে সন্দেহ হয় আস্ত জীবনটাকেই। তারপর অকস্মাৎ এগিয়ে যাওয়ার মুখে জনৈক নিরুপায় একজন মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। দু’হাত পেতে যে অপেক্ষায়। প্রতিদিন তাঁকে অতিক্রম করে যেতে যেতে, সম্ভবত আমরা প্রত্যেকেই ভাবি যে, আমাদের চেহারাতেই কে আমাদের কাছে হাত পাতে রোজ! আমরা কি তেমন অন্নপূর্ণা, বাড়িয়ে দেওয়া ওই হাতে কী-ই বা তুলে দিতে পারি! প্রতিদিন সেই ভিখারির ফাঁকা পাত্রে তখন একটু করে গন্ধ ঢেলে দিই বরং। পেরিয়ে আসা নিজেদের কাছে জমা করে রাখি নিজেদেরই অংশবিশেষ। আয়ু লিখতে লিখতে জীবন যত এগোয়, ততই সে পাত্র ভরা-ভরা। একদিন ফিরে দেখতে গেলে বিস্ময় জাগে।
স্মৃতি সেই বিস্ময়-সুগন্ধী। স্মৃতির বিশ্রামতলায় আমরা, আমাদের জীবন। প্রতিটি মানুষ যদি গল্প, তবে সে-গল্প স্মৃতি দিয়েই ঘেরা। স্মৃতির ভিতর আরও অনেক মানুষ। মানুষের মেলা। স্মৃতি মানুষকে বহু মানুষের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ করে। একদিন হাত পেতে জীবনের পোয়াটুকু গল্প যদি তাই জীবনের থেকেই চেয়ে নিতে হয় তাহলে স্মৃতির কাছেই আমাদের যাবতীয় ঋণ এবং সমর্পণ। গোপা দত্ত ভৌমিক জাদুমন্ত্রে স্মৃতির জানলাটিকে যেদিন খুললেন সেদিন উড়াল-জীবনের ডানায় মুছে যাওয়া ‘রোদ্দুরের গন্ধ’ আবার ফিরে এল তাঁর হাতে। এক এক করে ফিরে এলেন চারুবালা দাসী থেকে নীহারিকা পিসিমা কিংবা বাজ্গা বেগম আর আরও অনেকেই।
চারুবালা, চারুবালাই চুম্বক টানে আটকে রাখেন বহুক্ষণ। কায়স্থের ঘরের মেয়ে, তাই দেবী নন, দাসী। ছাপোষা বাঙালি ঘরের বিধবা। এদিক-ওদিক ফেলে ছড়ানো জিনিস কুড়িয়ে কুড়িয়ে চলা এক নিস্তরঙ্গ জীবন। তাঁর সম্পর্কে যা বলা হয়, কোনওটাই আমাদের অচেনা নয়। তাঁর জন্য যাবতীয় নিয়মকানুন তো পুরুষদেরই সৃজন। চারুবালা অতএব জীবনের বরাদ্দ নিষ্ঠুরতা সইতে সইতে, গদ্যের মরমী আড়াল সত্ত্বেও, আমাদের মনে করিয়ে দেবেন রবীন্দ্রনাথকে। ন্যাশনালিজমের বিপদ, তার ভিতরকার নৃশংসতার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি অবধারিত টেনে এনেছিলেন বিধবাদের নির্জলা উপবাসের বিধানের উপমাই। আদতে কী তা? রবীন্দ্রনাথ দ্ব্যর্থহীন বলবেন– নিষ্ঠুরতা, হীনতা, অমানবিকতা। মানুষকে মানবেতর করে তোলার তা যেন এক ষঢ়। এখন এই চব্বিশে জাতীয়তাবাদের অতিমাত্রায় বাড়বাড়ন্তের দিনে চারুবালার সেই কষ্টজীবনের কথা যখন পড়ছি, তখন মানুষকে মানবেতর করে তোলা ধারাবাহিক এক সামগ্রিক বিকারের পর্যায়ে। চারুবালা ফলত আমাদের কাছে অন্য মাত্রা নিয়ে যখন দেখা দিচ্ছেন, ঠিক তখনই গোপা যেন আমাদের খানিক ঝাঁকুনি দিয়েই স্বভাবসিদ্ধ শান্ত স্বরে বলে ওঠেন, ‘কেন জানি না মনে হয় বাঙালি বিধবাদের এই আশ্চর্য নিরামিষ রান্না– অতি সামান্য তেল মশলায়, হাতের জাদুতে তৈরি সব ব্যঞ্জন একটি নিরুচ্চার বিদ্রোহ’। অনুমান করতে পারি, ব্যক্তি চারুবালার মতো অনেকেরই তাহলে ছিল এই বিদ্রোহ! খেয়াল করেছি কিংবা করিনি।
এই ব্যক্তিক পরিসর থেকে কি সর্বজনীনে, মানুষের কোনও সত্যে পৌঁছনো সম্ভব? কেন স্মৃতির ভিতর গভীর ইতিহাসের প্রসঙ্গ আসছে, তা এই উত্তর সন্ধানের মধ্যেই হয়তো মিলবে। চারুবালার জীবন যে সংস্কৃতির দান, আর যে সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে, তার গভীরে মানুষের ইতিহাস গিয়ে মিলতে চায় প্রাণের ইতিহাসেই। বৃহত্তর পরিসরে তা আসলে মানবতারই খোঁজ। চারুবালা বা চারুবালাদের নীরব দ্রোহ, ইতিহাসের এই বাঁকবদলের মুখে এসে আমাদেরও কি তবে রুখে দাঁড়ানোর ইশারা করছে, অন্তত ব্যক্তিক স্তরেই! সময়ের সেই অভিপ্রায় ধরে আমরা কি ইতিহাসে নিজেদের ভূমিকা খুঁজে নিতে পারি? প্রশ্ন চলমান হয়ে ওঠে। চারুবালার গল্প, স্মৃতির অনিবার্য ভূমিকাতে তাই, আমাদের কাছে আধুনিক আখ্যানের মতো যেন দাবি করে পাঠকের নৈতিক অংশগ্রহণ। আমাদের নিজেদের গল্প, চারুবালার গল্প বাদ দিয়ে আর লেখা হতে পারে না।
…………………………
এই ব্যক্তিক পরিসর থেকে কি সর্বজনীনে, মানুষের কোনও সত্যে পৌঁছনো সম্ভব? কেন স্মৃতির ভিতর গভীর ইতিহাসের প্রসঙ্গ আসছে, তা এই উত্তর সন্ধানের মধ্যেই হয়তো মিলবে। চারুবালার জীবন যে সংস্কৃতির দান, আর যে সংস্কৃতির জন্ম দিচ্ছে, তার গভীরে মানুষের ইতিহাস গিয়ে মিলতে চায় প্রাণের ইতিহাসেই। বৃহত্তর পরিসরে তা আসলে মানবতারই খোঁজ।
…………………………
এই স্মৃতিচিত্রকথাকে কি তাহলে উপন্যাস বলব? চেনা ধারণায় হয়তো সেভাবে আঁটানো যাবে না। কেউ মানতে না-চাইলে আপত্তি নেই, জোরাজুরিও নেই। আমরা এগিয়ে গেলে দেখব, নিহারীকা পিসিমাকে কীভাবে লক্ষ্মীর পাঁচালির আর্কিটাইপের ভিতর সেঁধিয়ে যেতে হয়। তাঁর আত্মজনেরাই তাঁর সঙ্গে কী চাল খেলে তাঁর প্রেমকে ধূলিসাৎ করেন। আপত্তির প্রধান কারণ এই যে, নিহারীকা প্রেম করে নিজেই নিজের বিয়ে ঠিক করছে, মেয়ের এই স্বাধীনতাই মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। গল্প তো অজানা নয়। বাংলার ঘর জুড়ে এমন কত নীহারিকা! কী করতে পারেন তিনি? সুগৃহিণী হয়ে ওঠা ছাড়া! কিন্তু এই নীহারিকার যে ঘৃণা-দৃষ্টির সামনে আমরা পাঠক একেবারে অকস্মাৎ গিয়ে পড়ব, তার জন্য বোধহয় তৈরি ছিলাম না। সে ঘৃণা আত্মজন এবং পিতৃতন্ত্রের প্রতি উভয়ত। আমরা টের পাই, এই দৃষ্টিও ‘নিরুচ্চার বিদ্রোহ’। স্মৃতি সতত সুখের নয়। স্মৃতি বৈশ্য সমাজের ব্যবহার্য জিনিস (অশোক মিত্র যে আক্ষেপ করেন) মাত্র নয়। স্মৃতি পথে নেমে পথ চেনার ডাকও বটে। স্মৃতির এই জীবন তাই আমাদের স্মৃতি-বিস্মৃতির অন্য পারেই নিয়ে যেতে চায়। দেখি, বাজ্গা বেগম যেভাবে বৈচিত্রের সঙ্গে প্রাণকে সোনালি সুতোয় বেঁধে দেন তার গায়ে গায়েই থাকে বাণীমাসিমার পৌষপার্বণ। স্মৃতির এই চলচ্ছবির ভিতর আমরা জীবনের স্বাদ পাই, গন্ধ পাই। পুর্বনারীদের দুর্দশা দেখে লজ্জা পাই। তাঁদের অলৌকিক আঁচল তবু বইয়ের পাতা পেরিয়ে যেন আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সস্নেহে। ফিরে আসা রোদ্দুরের গন্ধ আর সেই ওম্টুকু এ-বই থেকে মস্ত পাওনা। স্মৃতিতে তা থেকে যাবে, পাঠকেরও।
রোদ্দুরের গন্ধ
গোপা দত্ত ভৌমিক
প্রকাশক- লা স্ত্রাদা
১৭৫ টাকা