১৯৮০ সালের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা উত্তমকুমারের মৃত্যু। এত তাড়াতাড়ি যে চলে যাবেন কেউ ভাবেনি, দূরদর্শন কর্তৃপক্ষও নয়, তাই তাঁর কোনও সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়নি, হয়তো তিনি সময় দিতে পারেননি, সে ক্ষতি আমাদের। জুলাই মাসের কান্না ভেজা বিকেলে রাধা স্টুডিওর দোতলা বাড়ির ছাদ থেকে সুব্রত কর ক্যামেরাবন্দি করছিলেন টালিগঞ্জ ট্রামডিপোর দিক থেকে আসা বিশাল শবযাত্রা, আমি সুব্রতদার ঠিক পাশটিতে দাঁড়িয়ে দেখলাম ফুলে ফুলে ঢাকা নায়ককে তাঁর শেষযাত্রায়।
৯.
ফিরলাম ’৮০-র ফেব্রুয়ারিতে, নিজের কাজের জগতে, নিজের ভালো লাগার জায়গায়।
একটা বেশ দারুণ ব্যাপার হল একদিন। আমাদের যেখানে ট্রান্সমিটার টাওয়ার অর্থাৎ এখন যেখানে দূরদর্শন ভবন সেখানে এক দুপুর-বিকেলে আমাদের নিয়ে গেলেন প্রিয়দর্শী সেন। আমাদের মানে, প্রায় সব মহিলা কর্মীকে, মীরাদি, শিপ্রাদি থেকে শুরু করে আমরা। লিফটে করে টাওয়ারের প্রায় চূড়ায় পৌঁছলাম, যেন ‘আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি’। সকলের মুখে খুশির হাসি, মীরাদিও সেদিন কত সহজ ছিলেন আমাদের সঙ্গে। আমরা গান গাইলাম, শর্মিষ্ঠাদি, শাশ্বতী আর আমি নাচলাম, জলখাবার খেলাম সক্কলে ভাগাভাগি করে।
এ বছরের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা উত্তমকুমারের মৃত্যু। এত তাড়াতাড়ি যে চলে যাবেন কেউ ভাবেনি, দূরদর্শন কর্তৃপক্ষও নয়, তাই তাঁর কোনও সাক্ষাৎকার গৃহীত হয়নি, হয়তো তিনি সময় দিতে পারেননি, সে ক্ষতি আমাদের। জুলাই মাসের কান্নাভেজা বিকেলে রাধা স্টুডিওর দোতলা বাড়ির ছাদ থেকে সুব্রত কর ক্যামেরাবন্দি করছিলেন টালিগঞ্জ ট্রামডিপোর দিক থেকে আসা বিশাল শবযাত্রা, আমি সুব্রতদার ঠিক পাশটিতে দাঁড়িয়ে দেখলাম ফুলে ফুলে ঢাকা নায়ককে তাঁর শেষযাত্রায়।
এ বছর থেকেই শুরু হল এক নতুন অনুষ্ঠান সাপ্তাহিকী। যদি ধরে নেওয়া যায়, দর্শকের দরবারে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান তাহলে বলতে হয় তারপরেই সাপ্তাহিকীর স্থান। প্রদ্যোৎ সমাদ্দারের প্রযোজনায় এই অনুষ্ঠানের সূত্রপাত, মাঝে বেশ কিছুদিন ও ছিল না, পুনায় ট্রেনিং-এ গিয়েছিল, ফিরে এসে শুরু করল সাপ্তাহিকী। সারা সপ্তাহের অনুষ্ঠান সূচি বলাটাও যে শিল্প হয়ে ওঠে, সাপ্তাহিকী তার প্রমাণ। নতুন কিছু পেয়ে আমরাও জমিয়ে দিলাম। নিজের মতো করে নিজের লেখা সুচারু রূপে বলার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ আর তৃপ্তি আছে। প্রথম দিনের টেলিকাস্ট এক উৎসব যেন, মনে আছে আমি জাম রঙের বালুচরী শাড়ি পরেছিলাম।
হালকা রঙের ঢাকাই বা বাটিকের শাড়ি পরতাম ২৫ বৈশাখ সকালে, যখন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি বা রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণ থেকে আমরা লাইভ টেলিকাস্ট করতাম তখন। ওইসব ভোরবেলাগুলো যে কত উত্তেজনার কত ভালো লাগার ছিল, তা বলার নয়। আমি অবশ্য অবসর গ্রহণের পরেও পঁচিশে বৈশাখ সকালে লাইভ টেলিকাস্টে থেকেছি স্টুডিও থেকে, সেসব গল্প পরে বলব।
সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগ দেখতেন পঙ্কজদা, ওই ঘরে কত কবি-সাহিত্যিকরা আসতেন। একদিন এলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র, দেখা করতে গেলাম। ছোটবেলায় অনেকবার দেখেছি, ঠাকুরদার কাছে আসতেন, সম্পর্কে বাবার দাদা হতেন, তাই ওঁকে ‘প্রেমেন জ্যাঠা’ বলতাম । বড় হয়ে কখনও বলতে পারিনি যে, আমি ওঁর লেখার কত বড় ভক্ত, যেমন কবিতার, তেমনই গদ্যের। ঘরে আরও সব বিখ্যাত মানুষ বসেছিলেন, আমি কাছে গিয়ে যাতে অন্যরা শুনতে না পান তাই নিচু গলায় ডাকি, ‘প্রেমেন জ্যাঠা’, আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘অসিতের মেয়ে তো?’ আমার টেলিভিশনে কাজ করার ব্যাপারে উনি যে অবগত সেটা জানতাম, মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলে প্রণাম করি।
আমার এম.এ. পরীক্ষার ভাইভায় (viva) বাইরের পরীক্ষক হিসেবে ছিলেন অধ্যাপক ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেন, একদিন তাঁকে দেখলাম ওই ঘরে। পরীক্ষার দিন যেরকম রাগী রাগী চেহারা দেখেছিলাম সেদিন দেখলাম, সেরকম নন।
আমার মাস্টারমশাই শঙ্খ ঘোষ আসতেন, তবে তাঁকে কখনওই রাজি করানো যায়নি ক্যামেরার সামনে বসতে। বহু অনুষ্ঠানের উপদেষ্টা হিসেবে থাকতেন, তারই মধ্যে একটি অনুষ্ঠানের কথা বলি। ‘জন্মদিন-মৃত্যুদিন’ শীর্ষক অনুষ্ঠান, বাইশে শ্রাবণ স্মরণে, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন আর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চলে যাওয়ার দিন এই ছিল বিষয়।
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ে, শক্তি চট্টোপাধ্যায়– এঁরা তো আসতেনই। একদিন দুপুরের দিকে আমাদের দিনের বেলা যেখানে বসার জায়গা সেই লাইব্রেরি ঘর থেকে বেরিয়েছি কোনও দরকারে, দেখি একটা রিকশা গেট দিয়ে ক্যাম্পাসের মধ্যে ঢুকছে, ব্যতিক্রমী দৃশ্য, রিকশাটা এসে থামল কনফারেন্স হলের সামনে, ঠাহর করে দেখি, তার থেকে নামছেন এক ব্যতিক্রমী মানুষ। নামতে গিয়ে টাল সামলাতে পারেননি, তাড়াতাড়ি কাছে গিয়ে ওঁকে ধরি। ‘বউমা’! হ্যাঁ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমাকে এই বলেই সম্বোধন করতেন, আমার শ্বশুরমশাই হরিসাধন দাশগুপ্তের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে। পঙ্কজদার ঘর অবধি পৌছে দিই। ওঁর জন্যই বাকিরা অপেক্ষা করছিলেন, এবার সবাই রেকর্ডিংয়ের জন্য স্টুডিওর পথে পা বাড়ালেন। বউমা বলে আরেজনও ডাকতেন, সূত্র একই, শ্বশুরমশাইয়ের বন্ধু, তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।
’৮১-তে হল এক পরিবর্তন। যিনি এই টেলিভিশন পরিবার গড়ে তুলেছিলেন সেই মীরা মজুমদারের অবসর গ্রহণের দিন এসে গেল। সকলেরই মন খারাপ। একদিন ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানের জন্যে ম্যারাপ বাঁধা হল। মীরাদি সারাদিন কাজ করেছেন, খুবই শ্রান্ত। আমি আর শাশ্বতী আবদার করলাম যে ওয়াড্রব সেকশনে রাখা নতুন শাড়ি ওঁকে পরতে হবে। এই শাড়ির বিষয়ে গল্প বলে নিই। এর কিছু দিন আগে মীরাদি আমাদের দু’জনকে পাঠিয়েছিলেন কটেজ ইন্ডাস্ট্রিতে অ্যানাউন্সারদের জন্য কিছু শাড়ি কিনতে, কখনও দরকারে অদরকারে, বৃষ্টির দিন শাড়ি ভিজে গেলে যদি লাগে, ওয়ারড্রব সেকশনের অসীম গিয়েছিল সঙ্গে। সেই শাড়ির মধ্যে যেগুলি তখনও নতুন রাখা ছিল, তেমনই একটি সিল্কের শাড়ি আমাদের অনুরোধে পরলেন মীরাদি। সুন্দর চেহারা আরও সুন্দর হয়ে উঠল।
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………
যিনি অধিকর্তা হয়ে এলেন, তাঁর নাম মি. শিব শর্মা। চেহারায়, ব্যক্তিত্বে, কথা বলায়, সহকর্মীদের প্রতি অ্যাপ্রোচ– এক কথায় যাকে বলে ‘ডায়নামিক’। অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এবং প্রোডাকশন সর্ব দিক দিয়ে দেখলে শর্মাজির সময়টিই বোধ হয় আমার দেখা দূরদর্শনের শ্রেষ্ঠ সময়।
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব ……………………………
পর্ব ৮: যেদিন বীণা দাশগুপ্তার বাড়ি শুট করতে যাওয়ার কথা, সেদিনই সকালে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলাম
পর্ব ৭: ফতুয়া ছেড়ে জামা পরতে হয়েছিল বলে খানিক বিরক্ত হয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
পর্ব ৬: ভারিক্কিভাব আনার জন্য অনন্ত দাস গোঁফ এঁকেছিলেন অল্পবয়সি দেবাশিস রায়চৌধুরীর মুখে
পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে