হাবিব তনভীরের অভিনেতারা যতটা না ‘অভিনেতা’, তার থেকে বেশি ‘ন্যারেটর’। মঞ্চের এককোণে যখন গায়নদল ফিরে ফিরে আসে নাটককে থামিয়ে রেখে, তখন মিলেমিশে যায় লোকনাট্যের ঐতিহ্য আর ‘এপিক’ থিয়েটারের সংগীতের ভাবনা। অথচ ভারতীয় রাগসংগীতের মতো খোলা এই নাট্যের চলন যেখানে ‘ইমপ্রোভাইজেশন’-এর অবকাশ অগাধ; কিন্তু তলায় তলায় কাজ করে চলেছে এক সুঠাম বুনোট– এক নির্দেশকের গভীর নিয়মানুবর্তিতা। কেউ যদি মঞ্চে চরণদাস আর পুলিশের লুকোচুরি খেয়াল করেন, দেখবেন, প্রতিটি অভিনয়ে তা বদলে বদলে যায় কিন্তু কখনও মাত্রা ছাড়ায় না। মঞ্চ ব্যবহারের ক্ষেত্রে হাবিবসাব ‘চিত্রপট’-এর থেকে ‘চিত্তপট’-এ বেশি বিশ্বাসী ছিলেন।
আমার এই লেখার মূল অভিপ্রায় হাবিবসাবের নাট্যভাষ নিয়ে কিছু কথা বলার। সেটা বলতে গেলে একটু ঘুরপথে আসতে হবে। হাবিব তনভীরের থিয়েটারের মূল্যায়ন করতে গেলে আমাদের নাট্যসমালোচনার ঐতিহ্যের একটা বড় সমস্যার কথা বলতে হয়। সংলাপের বাইরে নাট্যভাষের বা শারীরিকতার যে প্রকাশ, তা নিয়ে বিশেষ আলোচনার অবকাশ দেখা যায় না। তাই বলা যেতে পারে, নাট্যাভিনয়ের যে ‘তাৎক্ষণিকতা’ নাটকের প্রাণ, সেটাকে বাদ দিয়ে নাট্যসাহিত্যের বা লিখিত নাটকের আলোচনাই মুখ্য হয়ে যায়। শঙ্খ ঘোষ যখন তাঁর ‘কালের মাত্রা ও রবীন্দ্রনাটক’ গ্রন্থে শম্ভু মিত্রের ‘রক্তকরবী’-র নাট্যাভিনয়ের আলোচনা করেছেন, তা প্রকৃত অর্থে সম্যক আলোচনা হয়ে উঠেছে। সে আলোচনা শুধু রবীন্দ্রনাটকের ব্যাখ্যা নয়, শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় রবীন্দ্র প্রযোজনার সমালোচনা। থিয়েটারের একটা প্রধান কাজ হল এমন একটা ‘ইভেন্ট’ তৈরি করা, যেখানে অনেকগুলি অসংলগ্ন টুকরো থেকে, আপাত-বিচ্ছিন্ন অনেকগুলো মুহূর্ত থেকে একটা সামগ্রিকতা সৃষ্টি করা। যখন এই জীবনের সাড়ে বত্রিশ ভাজা থেকে একটা সংশ্লেষণের মুহূর্ত আবিষ্কৃত হয়, তখনই থিয়েটারের মাহাত্ম্য টের পাওয়া য়ায়।
থিয়েটারের অভিনয়ই পারে বিচ্ছিন্নতার মধ্যে এই সাংকর্ষ তৈরি করতে। হাবিবজি পেরেছিলেন তাঁর নাট্যভাষে এই অমোঘ মুহূর্তের সংক্রমণ ঘটাতে। এমন এক অন্বয়, যেখানে জীবনকে একটা সুরে এনে বেঁধে ফেলা যায়। প্রথম যখন ‘চরণদাস চোর’ দেখি, তখন মনে পড়েছিল বিঠোফেনের একটা কথা। ‘হ্যান্ডেলের কাছে গিয়ে শিখে এসো কী করে সামান্য উপায়ে অসামান্য ফলাফল সৃষ্টি করা যায়।’ নিরাভরণ মঞ্চে কী ‘ম্যাজিক’ সৃষ্টি করা যায়, থিয়েটারের ভাষার এক নতুন বয়ান নির্মাণ করা যায়, তার অন্যতম উদাহরণ এই নাট্যাভিনয়। বাখতিন যেমন দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে খুঁজে পেয়েছিলেন বহুস্বর, হাবিবসাবের মঞ্চ তেমনই। তাঁর মঞ্চ স্থান-কাল সঞ্চরণে ‘কার্নিভালেস্ক’। হাবিবসাবের নির্মাণকে রাখতে হবে পৃথিবীর কয়েকজন আধুনিক নাট্যনির্দেশকের পাশাপাশি। দেখা যাবে ভিন্ন ভিন্ন দেশে কাজ করলেও এই নির্দেশকদের মধ্যে পাওয়া যাচ্ছে এক নিবিড় আত্মিক সমন্বয়। পিটার ব্রুক বলেছিলেন, ‘যাঁরা থিয়েটার নিয়ে সিরিয়াসলি কাজ করেন তাঁদের কারও পক্ষে ব্রেখটকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ব্রেখট আমাদের সময়ের একজন অন্যতম চরিত্র; সব থিয়েটারের কাজে তিনি হয় শুরুতে থাকেন বা আমাদের বারবার ফিরে আসতে হয় তাঁর কথা ও কীর্তির কাছে।’ তেমনই হাবিবজির নাট্যেও এসে পড়বে ব্রেখট প্রসঙ্গ। যেমন আসবে ভারতীয় লোকনাট্যের কথা, তেমনই আসবে স্তানিসলাভস্কির ম্যাজিক ‘ইফ’; মায়ারহোল্ডের ‘বায়োমেকানিক্স’; ‘আর্তোর ‘সিগন্যালিং থ্রে ফ্লেমস’; গ্রোটাউস্কির ‘পুওর থিয়েটার’; ব্রুকের ‘হোলি/ডেজলি/রাফ/ইমিডিয়েট থিয়েটার’; দারিও ফোর-এর রাজনৈতিক নাট্যে ‘কমেডিয়া ডেল আর্ট’-এর প্রয়োগ। আসতেই হবে রবীন্দ্র নাট্যে ‘পথ’-এর অনুষঙ্গ।
আমরা আধুনিক অর্থে ‘নির্দেশক’ বলতে যা বুঝি, হাবিব তনভীর অন্যতম। আমি তাঁদেরই ‘নির্দেশক’ বলব যাঁরা মঞ্চকে নতুন নতুন পাঠে পড়তে চেয়েছেন, নতুন মঞ্চভাষের সুলুকসন্ধান করেছেন ক্রমাগত। এবং অভিনেতার শিল্প সম্পর্কে যে নির্দেশক নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। একজন নির্দেশক কী করে একটা লিখিত নাটককে মঞ্চের ভাষায় পাঠ করছেন ও অভিনেতাদের কোন পদ্ধতিতে প্রস্তুত করছেন, সে প্রসঙ্গটি অত্যন্ত জরুরি। একটা লিখিত নাটককে হাতে পাওয়া যায়; যা একটা উপন্যাসের মতো বা গল্পের মতো– অপরিবর্তনশীল। কিন্তু থিয়েটার একটা ‘পারফরম্যান্স’; সেই অভিনয়কে তো আর পুনরুৎপাদন করা যাচ্ছে না, কারণ তা প্রতিদিন পাল্টে পাল্টে যায়। ‘ভিডিও রেকর্ডিং’ দিয়েও তাকে ধরা যাবে না। শুধু একটা ধারণা তৈরি করা যাবে মাত্র।
হাবিবসাবকে নিয়ে বেশিরভাগ আলোচনাই থমকে থাকে তাঁর লোক আঙ্গিক নিয়ে কাজের বর্ণনায় ও ব্যাখায়। কিন্তু আমি বলব ভারতীয় থিয়েটারের আঙ্গিনায় ব্রেখটের ‘এপিক থিয়েটার’-এর মডেলকে যদি কেউ স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে আত্মস্থ করে থাকেন, তিনি হলেন হাবিবসাব। ‘আগ্রা বাজার’ থেকে ‘বিসর্জন’ পর্যন্ত তাঁর যে যাত্রা, তা এক নিরলস সন্ধানের যাত্রা। তাঁর অভিনেতারা যে সহজ শারীরিকতায় শেক্সপিয়র থেকে মলিয়ের হয়ে ব্রেখট ঘুরে রবীন্দ্রনাথে পৌঁছতে পারেন, তার পিছনে রয়েছে হাবিবসাবের অভিনেতার শিল্প নিয়ে এক নিবিড় সন্ধান। ব্রেখট নির্মাণ করছেন এক অভিনয় পদ্ধতি ও বলছেন ‘গেস্টুস’-এর কথা, সেই বিশেষ শরীর চিহ্ন বা মুদ্রার ভাবনা, যা অভিনেতার সামাজিক সম্পর্ককে প্রকাশ করবে– এই ভাবনা আসছে ব্রেখটের ওপর চৈনিক ও জাপানি থিয়েটারের প্রভাব। আর্তো যে শারীরিকতার স্বরলিপি গড়তে চেয়েছিলেন, তা এসেছে বালিনিজ নৃত্যের প্রভাব থেকে।
আবার পিকাসোর ‘কিউবিজম’-ও বাদ পড়ছে না। ব্রেখটের মাদার কারেজের নাট্যাভিনয়ের মৃত সন্তানের শোকে হেলেন ভাইগেলের আকাশের দিকে মাথা হেলিয়ে সেই নিস্তব্ধ কান্নার সংকেত তো পিকাসোর ‘গুয়েরনিকা’ থেকে ধার করা। যে কোনও আধুনিক শিল্পীর কাছে এই প্রভাব তো অনিবার্য। হাবিবসাবের নাটকে অভিনেতাদের মধ্যে এই বিশেষ মুদ্রার ব্যবহার কী অনায়াস ভঙ্গিতে হয়েছে। সে চরণদাসের গোবিন্দরাম বা দীপক তেয়ারি হোক বা বাহাদুর কালারিনের ফিদাবাই হোক। ফিদাবাই-এর মতো অভিনেত্রী ভারতের মঞ্চে কম এসেছে। তাঁর অভিনেতারা যতটা না ‘অভিনেতা’, তার থেকে বেশি ‘ন্যারেটর’। মঞ্চের এককোণে যখন গায়নদল ফিরে ফিরে আসে নাটককে থামিয়ে রেখে, তখন মিলেমিশে যায় লোকনাট্যের ঐতিহ্য আর ‘এপিক’ থিয়েটারের সংগীতের ভাবনা। অথচ ভারতীয় রাগসংগীতের মতো খোলা এই নাট্যের চলন যেখানে ‘ইমপ্রোভাইজেশন’-এর অবকাশ অগাধ; কিন্তু তলায় তলায় কাজ করে চলেছে এক সুঠাম বুনোট– এক নির্দেশকের গভীর নিয়মানুবর্তিতা। কেউ যদি মঞ্চে চরণদাস আর পুলিশের লুকোচুরি খেয়াল করেন, দেখবেন, প্রতিটি অভিনয়ে তা বদলে বদলে যায় কিন্তু কখনও মাত্রা ছাড়ায় না। মঞ্চ ব্যবহারের ক্ষেত্রে হাবিবসাব ‘চিত্রপট’-এর থেকে ‘চিত্তপট’-এ বেশি বিশ্বাসী ছিলেন। খোলা পথের মতো তাঁর মঞ্চ অসীমে বিস্তৃত। ‘স্থান’ ও ‘কাল’ তাঁর নাটকে এক অবাধ স্বাধীনতায় বিন্যস্ত। ‘মিট্টি কী গাড়ি’ নাটকে শূদ্রকের সময়কে যেমন নানা টুকরোতে ভেঙে দিলেন হাবিবসাব। শেক্সপিয়র (‘এ মিডসামার নাইটস ড্রিম’ থেকে ‘কামদেও কা আপনা বসন্ত ঋতু কা স্বপ্না’) বা ব্রেখটের (‘গুড পার্সেন অফ সেজুয়ান’ থেকে ‘সাজাপুর কি শান্তিবাই’) স্থান-কালকেও দিয়েছিলেন এক নতুন বিন্যাস। স্বাধীনতোত্তর ভারতে নির্দেশকরা মঞ্চের সীমানা ছাড়িয়েছেন– শম্ভু মিত্রের সন্ধান সোফোক্লিস থেকে রবীন্দ্রনাথ ঘুরে ইবসেন হয়ে বাদল সরকারে এসেও থামছে না; উৎপল দত্তের মঞ্চভাষে মার্কস, পিসকাটর, বার্নাড ’শ, সোভোদা আর শেক্সপিয়রের এক জটিল মিশেলে সৃষ্টি হচ্ছে ‘টিনের তলোয়ার’; বাদল সরকার চলে যাচ্ছেন ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ থেকে ‘মিছিল’-এ; পানিক্কর খুঁজছেন সংস্কৃত নাটকের ভিত্তিতে মঞ্চের এক নতুন সংকেত; রতন থিয়ামের সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে পিনা বাউসের আর রবার্ট উইলসনের; গিরিশ কারনাড, বিজয় তেণ্ডুলকর, মোহন রাকেশ, মোহিত চট্টোপাধ্যায় খুঁজছেন ভারতীয় নাটকের এক নয়া রূপ, যা বহুমাত্রিক, সারা পৃথিবীর সঙ্গে তাঁদের লেনদেন। আর হাবিব তনভীর তাঁর ‘নয়া থিয়েটার’ নিয়ে মঞ্চকে খালি বড় করছেন, অভিনেতাদের শরীরকে বহুস্বরে আবিষ্কার করছেন, মঞ্চভাষকে এক অনতিনির্দেশিত স্থানকালে বিন্যস্ত করছেন।
আর একটা বড় বিষয়– হাবিবসাবের রাজনৈতিক বোধ এবং রাজনীতি। তাঁর নাট্যভাবনায় গভীরভাবে সম্পৃক্ত ছিল সময়চিহ্ন। তাঁর নাট্যকীর্তিকে পাঠ করতে হবে সমসাময়িক রাজনীতির প্রেক্ষাপটে। ফলে বারবার তিনি আক্রান্ত হয়েছেন, অপদস্ত হয়েছেন নানা রাজনৈতিক দলের হাতে। কিন্তু তাঁর মতো মানুষকে, শিল্পীকে আটকাবে কে? কিন্তু আমরা আটকে গেছি, বিকিয়ে গেছেন আজকের শিল্পীরা রাজনৈতিক দলের কাছে বা চুপ করে আছেন। তাই তাঁর শতবর্ষে হাবিব তনভীরের নাট্যকীর্তির পাশাপাশি যেন স্মরণ করা হয় তাঁর রাজনীতিকে। তাঁকে আত্মগত করার কাজ শুরু হয়ে গেছে। সেটা আটকাতে হবে।