মুজতবা আলী ছিলেন বিশ্বভারতীর কলেজের প্রথম বহিরাগত মুসলমান ছাত্র। তিনি এসেছিলেন শ্রীহট্ট থেকে। শান্তিনিকেতনে তিনি থাকতেন পরিমল গোস্বামী এবং অনিলকুমার চন্দর মতো সহপাঠীদের সঙ্গে একই বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষভাবে তাঁদের পড়িয়েছিলেন কিট্স, শেলি এবং নিজের লেখা ‘বলাকা’ কাব্যগ্রন্থটি। তিনি ছিলেন সেখানকার প্রথম ব্যাচের স্নাতক।
সৈয়দ মুজতবা আলী আসলে এমনই একটি নাম, যাঁর সঙ্গে চলিত ও রম্য বাংলায় লেখা সরস গদ্যের এক বর্ণময় লেগ্যাসি মিশে আছে। তাঁর আগে বাংলা ভাষায় রম্য গদ্য লিখে যাঁরা শুকনো পাথরে ফিকে বেগুনিরঙা ফুল ফুটিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কালীপ্রসন্ন সিংহ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং প্রমথ চৌধুরী মশায়ের নাম সবার আগে মনে পড়ে। এঁদেরও আগে ছিলেন রামমোহনের সমসাময়িক ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু তাঁকে কেন জানি না, এক পথভ্রষ্ট নাবিক বলেই মনে হয়েছে বরাবর। তাই তাঁকে আমি এই অক্ষরের ছায়াপথে আর টেনে আনছি না। আর বাকিদের মধ্যে একমাত্র কালীপ্রসন্ন সিংহ ছাড়া অন্যদের গদ্যভাষা ও কথনভঙ্গিমার থেকে আলীসাহেবের দূরত্ব আলোকবর্ষের। অবশ্য এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত, অন্যরা সহমত না-ও হতে পারেন।
তাঁর গদ্যের ছিল একটি সহজ বৈঠকি চাল। যে কোনও গুরুগম্ভীর বিষয়কে সরল করে এবং মজা-মিশিয়ে প্রকাশ করার এক অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল তাঁর। ভ্রমণ সাহিত্যে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল মাইল-ফলকের মতো। আমি প্রথম তাঁর লেখা পড়ি স্কুলপাঠ্যে। রচনাটির নাম ছিল ‘যাত্রাপথে’। এটি ছিল তাঁর বিখ্যাত ভ্রমণের বই ‘দেশে বিদেশে’-র একটি টুকরো অংশ। এর এক জায়গায় লেখা ছিল– ‘ভোরের নমাজ শেষ হতেই সর্দারজি ভেঁপু বাজাতে আরম্ভ করলেন।’ খুবই সহজ-সরল বাক্য। সর্দারজি গাড়ির চালক। তিনি ভেঁপু বাজাচ্ছেন গাড়ি ছাড়বেন বলে। কিন্তু একবার চিন্তা করে দেখবেন তো, এই ‘ভেঁপু’ শব্দটির জায়গায় অন্য কোনও জুতসই শব্দ এখানে নিকতি-মেপে বসানো যায় কি না! আমি অনেক ভেবেও কিন্তু খুঁজে পাইনি। এই গ্রন্থ পড়তে গিয়ে আরও একটি নতুন শব্দবন্ধ খুঁজে পেয়েছিলাম– ‘কড়াক্-পিঙ্’। পরে জেনেছিলাম এটি হল বন্দুক থেকে ছিটকে গুলি বেরিয়ে যাওয়ার শব্দ। ভ্রমণের সময় তাঁর অভ্যেস ছিল নানা শ্রেণির মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করা। তাদের জীবন ও যাপনকে তিনি যেভাবে তাঁর সাহিত্যে নিয়ে এসেছেন, তাতে করে ওই মানুষগুলোকে যেন চোখের সামনে দেখতে পাওয়া যেত।
মুজতবা আলী ছিলেন বিশ্বভারতীর কলেজের প্রথম বহিরাগত মুসলমান ছাত্র। তিনি এসেছিলেন শ্রীহট্ট থেকে। শান্তিনিকেতনে তিনি থাকতেন পরিমল গোস্বামী এবং অনিলকুমার চন্দর মতো সহপাঠীদের সঙ্গে একই বাড়িতে। রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষভাবে তাঁদের পড়িয়েছিলেন কিট্স, শেলি এবং নিজের লেখা ‘বলাকা’ কাব্যগ্রন্থটি। তিনি ছিলেন সেখানকার প্রথম ব্যাচের স্নাতক। বিশ্বভারতীতে তিনি একই সঙ্গে শিখেছিলেন ফার্সি, ফরাসি এবং জার্মান ভাষা– যা একমাত্র সেখানেই শেখানোর উপায় ছিল। আর সেই সুবাদে তিনি শান্তিনিকেতন ছেড়ে চাকরি নিয়ে চলে গিয়েছিলেন কাবুলে। পরে অবশ্য অধ্যাপনা করার জন্যে আবার শান্তিনিকেতনে ফিরেও এসেছিলেন, কিন্তু তখন রবীন্দ্রনাথ অস্ত গিয়েছেন।
মুজতবা আলী রবীন্দ্রনাথকে যে কী অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন, তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। সমস্ত বিষয়ের ওপর আগ্রহ থাকার ও আনন্দ পাওয়ার তাঁর যে অভ্যেস, সেটা তিনি পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকেই। আর পেয়েছিলেন মুক্ত আনন্দময় আড্ডা দেওয়ার প্রভাবটিও। রবীন্দ্রনাথের প্রায় সমস্ত গান এবং বিখ্যাত কবিতা থাকত আলীসাহেবের ঠোঁটের ডগায় এবং সময়বিশেষে তিনি সেগুলির সার্থক প্রয়োগও করতেন। মুজতবা আলী বলতেন, রবীন্দ্রনাথের গান চিরস্থায়ী এবং তারাই তাঁকে অমরত্ব দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা তাঁর ‘গুরুদেব ও শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থটি তাই আমাদের কাছে কোনও দিনও পুরনো হবে না। যেমন পুরনো হবে না ‘শবনম’-এর মতো করুণ-মধুর প্রেমের উপন্যাস বা ‘পঞ্চতন্ত্র’-র মতো রম্যপ্রবন্ধের সংকলন।
অনেক আগে বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং ছড়াকার অমিতাভ চৌধুরী মশায়ের একটি স্মৃতিলেখায় পড়েছিলাম, আলীসাহেব যখন শান্তিনিকেতনে আসেন, তখন তিনি ছিলেন ধুতি-পাঞ্জাবি পরা সুদর্শন এবং দীর্ঘকায় একজন তরুণ। তাঁর মাথাজোড়া বিশাল টাকটিও নাকি তাঁর চেহারার সঙ্গে বিশেষ মানানসই ছিল। সুরসিক অমিতাভ চৌধুরী তাঁকে ‘লেডি-কিলার’ বলে উল্লেখ করেছিলেন সেই রচনায়। সুন্দর কথা-বলা এবং জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যে কত বড় শিল্প হতে পারে, সেটার জলজ্যান্ত উদাহরণ নাকি ছিলেন আলীসাহেব নিজে। শান্তিনিকেতনে থাকতে তিনি সাইকেলে চেপে টুকটাক এর-ওর বাড়িতে কিংবা কালোর চায়ের দোকানে চলে যেতেন আড্ডা দিতে। আড্ডার বিষয় ছিল তাঁর স্নেহময়ী মায়ের কথা, মায়ের হাতের রান্নার কথা, পুরনো শান্তিনিকেতন এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের কথা। আড্ডা দেওয়াটাকে আলীসাহেব জীবনের পবিত্র কর্তব্য বলেই মনে করতেন। তাঁর রম্য প্রবন্ধগুলির মধ্যে তাই আড্ডার এই মেজাজটা ভালোরকম খুঁজে পাওয়া যেত। ‘আড্ডা’ নামের একটি চমৎকার গদ্যও আছে তাঁর। তাতে কায়রোর এক আড্ডায় ‘ফর্শী’ হুঁকোয় সুগন্ধী তামাক খেতে খেতে আড্ডা দেওয়ার বর্ণনা দেওয়া আছে।
আলীসাহেব একাধারে ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক, ভ্রমণ-সাহিত্যিক, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক, কবি এবং সাংবাদিক। বহুভাষাবিদ এই মানুষটির পড়াশুনো যে কী বিপুল পরিমাণে ছিল, তা আন্দাজ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর তেমনই ছিল তাঁর স্মৃতিশক্তি। একবার নাকি একজন পরিচিত মানুষের পিতৃশ্রাদ্ধে গিয়ে তিনি সেখানে বসে একটু গীতাপাঠ করার আর্জি জানান। সবাই একটু বিস্মিত হলেও সাগ্রহ সম্মতিও আসে। তখন আলীসাহেব সেখানে বসে সম্পূর্ণ স্মৃতি থেকে গীতার একটি অধ্যায় পাঠ করেন এবং উপস্থিত সকলে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা শোনেন। আর এটা করা তাঁর পক্ষে অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, কারণ বিভিন্ন ধর্ম ও ধর্ম-বিষয়ক গ্রন্থগুলির ওপর তাঁর ছিল সমান আগ্রহ। গীতা, কোরান, মহাভারত, বাইবেল, ত্রিপিটক– এসব তিনি এতটাই খুঁটিয়ে পড়েছিলেন যে, এদের প্রতিটি পৃষ্ঠা তাঁর মাথার মধ্যে ছাপা হয়ে থেকে গিয়েছিল। ফলে বিভিন্ন লেখায় এবং মুখের কথায় তিনি এইসব বই থেকে যখন-তখন নানারকম উদ্ধৃতি তুলে দিতেন। আলীসাহেবের ‘ধর্ম’ প্রবন্ধটি পড়লেই বোঝা যায় যে, তিনি প্রতিটি ধর্মের সারকথা নিয়ে কতটা আগ্রহী ছিলেন। ধর্মের গোঁড়ামি এবং বিধিনিষেধ নিয়ে তিনি যারপরনাই রঙ্গরসিকতা করতেন। আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ– যাঁর বিভিন্ন ভাষায় পড়া অজস্র বইয়ের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বই বলে মনে হত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত’-কে।
একবার পাঁচের দশকের বিশিষ্ট কবি সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত-র কাছে বসে অনেক গল্প শুনেছিলাম আলীসাহেবকে নিয়ে। সমরেন্দ্রবাবু যখন পার্ক সার্কাসে থাকতেন তখন আলীসাহেব ছিলেন তাঁর প্রতিবেশী। নিঃসঙ্গ আলীসাহেব মাঝে মাঝেই সমরেন্দ্রবাবুর বাড়িতে চলে আসতেন সময় কাটাতে। তিনি নিজের হাতে মাংসও রান্না করেছিলেন সে-বাড়িতে। সমরেন্দ্রবাবু বলেছিলেন, আলীসাহেব নাকি এক বিচিত্র পদ্ধতিতে পান খেতেন। পানের বাটা থেকে কখনও একটু পানপাতা, কখনও একটু সুপুরি, কখনও বা আঙুলে করে একটু চুন কিংবা একটিপ জর্দা তুলে নিয়ে মুখে দিতেন। পান সেজে খাচ্ছেন না কেন জিজ্ঞেস করলে নাকি বলতেন, সাজার দরকার কী? সবই তো পেটের ভেতরে গিয়ে একই জায়গায় মিশবে। সমরেন্দ্রবাবু আরও বলেছিলেন, আলীসাহেবের নাকি একসময় একটি পোষা অ্যালসিশিয়ান ছিল। সে ছিল তাঁর খুবই আদরের। কিন্তু আলীসাহেব তিন পাত্তরের বেশি পান করলেই সে নাকি চিৎকার করতে শুরু করত। মানে, তাঁকে শাসন করত। আলীসাহেব তাই তাকে খাতির করে ‘মাস্টার’ বলে ডাকতেন। শেষের দিকে আলীসাহেবের হাত যখন খুব কাঁপত, তখন সমরেন্দ্রবাবুই তাঁর পঞ্চতন্ত্র-র কিস্তিগুলি নিজের হাতে কপি করে দিতেন। তাঁর সম্পাদনাতেই বেরিয়েছিল মুজতবা আলীর ‘দিনলিপি’ এবং অনেক মূল্যবান চিঠিপত্র। জানি না সেগুলো এখনও গ্রন্থবদ্ধ হয়েছে কি না। যদি না হয়ে থাকে, তবে তাঁকে আরও ভালো করে চেনার জন্যে হওয়াটা খুবই জরুরি।
বিনা বেতনের গৃহস্থালির কাজে সময় ব্যয় করে ২৮৮ মিনিট, পুরুষরা সেখানে ব্যয় করে ৮৮ মিনিট! অন্বিতার রান্না করে রেখে যাওয়া ভাত তাঁর স্বামী খেতে পেরেছে কি না জানি না, তবে আমাদের রক্ত চুষে দিব্যি ফুলে ফেঁপে বাড়ছে পুঁজি আর পিতৃতন্ত্র।