এ গল্পের নাম ‘বহুরূপী’। হরিদা কেন বহুরূপী সাজার মতো অনিশ্চয়তাময় পেশা আঁকড়ে বেঁচে আছেন? কারণ, কোনও ধরনের নিশ্চয়তাই যেন তাঁর অন্তর্জগতের দার্শনিক সত্তাকে, তাঁর মননের মধ্যে শেকড় বিস্তার করে বসা কবিকে মেরে ফেলবে। পেশার অনিশ্চয়তা ও রোমাঞ্চে তিনি যেন সবসময় আত্মপ্রশ্ন করার এবং উত্তর খোঁজায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চান।
জগতে নিজের বেঁচে থাকার স্বরূপটি কী? কোন আত্মতত্ত্বে তাকে বুঝে উঠতে পারব আমি? এ-প্রশ্ন শাশ্বত, চির-অনির্বাণ। নিজেকে বুঝতে চাওয়ার এই তাড়নাই মানুষকে জীবনরসিক করে। এ-ঘাট থেকে ও-ঘাটের জল খাইয়ে নাস্তানাবুদ ক’রে ছাড়ে। ১৯৪০-এ সুবোধ ঘোষ যখন ‘অযান্ত্রিক’ আর ‘ফসিল’ নিয়ে বাংলা সাহিত্যে এসে পড়লেন, সেটা বিভূতিভূষণ-মানিক-তারাশঙ্করের নির্মিত আখ্যান-পৃথিবীতেও একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল। বাস কন্ডাক্টরি, ট্রাক ড্রাইভারি, সার্কাস, ঝাড়ুদারি– এসব বিবিধ পেশায় সংযুক্ত থেকে তিনি যেন ওই রসপিপাসাকেই বাড়িয়ে নিচ্ছিলেন নিজের অজ্ঞাতসারে। তাই ছোটগল্পের রণক্ষেত্রে তাঁর পা-রাখাটা ছিল সময়ের অপেক্ষা। আত্মতত্ত্বের প্রশ্নটি মাথায় রাখলে তাঁর অ-সামান্য গল্প ভাণ্ডারে একটি ঈষৎ কোণাচে হয়ে থাকা গল্প চোখে পড়ে। তাঁর শ্রেষ্ঠ গল্পগুলোর মধ্যে ঠাঁই পাওয়ার যোগ্য কি না, সেটা বিতর্কের বিষয়, কিন্তু আত্মপ্রশ্ন যদি আলোচনার অভিমুখ হয়, তাহলে নিঃসন্দেহে ‘বহুরূপী’ গল্পটি আমাদের মনে পড়বে তার চরিত্রায়ণ, ন্যারেটিভ স্টাইল, সর্বোপরি এর দার্শনিক উচ্চতার কারণে। আমিহীনতাসর্বস্ব এক ‘আমি’-তে পৌঁছতে চাওয়ার কথা বলা আছে ভারতীয় দর্শনের প্রাচীন বইগুলিতে কিংবা কখনও ভারতীয় মহাকাব্যে। গীতা– যেমন দর্শনগ্রন্থ তেমনই কি কাব্যগ্রন্থ নয়? সুবোধ ঘোষের এই গল্পেও সেই সমবেত আদি-চেতনার প্রভাব পড়েছে কিংবা বলা ভালো, তিনি ভারতীয়ত্বকেই খুঁজতে চেয়েছেন এই গল্পের মাধ্যমে। তিনটি ভাগে বা অংশে বিভক্ত এই নির্মেদ গল্প শুরু হয় হরিদা নামের একজন ব্যক্তিকে নিয়ে যিনি বহুরূপী সেজে মানুষের মনোরঞ্জন করেন এবং তাঁরা খুশি হয়ে কিছু টাকা দিলে তাই দিয়ে হরিদার ক্ষুণ্ণিবৃত্তি হয়ে থাকে। এইভাবে সে বাইজি, পুলিশ, পাগল ইত্যাদি সেজে যেন জীবনের আত্মপ্রশ্নকেই আরও সুসংহত করতে চেয়েছে, সন্ধান করতে চেয়েছে মানব-আচরণের বিভিন্ন প্রকারের। কোথাও সে স্থির হয়নি, কোথাও সে শান্তি পায়নি। জীবনরহস্যের প্রান্তে পৌঁছনো যেন বাকি রয়ে গেছে তাঁর।
গল্পের শুরুতে আছে পাড়ার মান্যগণ্য ব্যক্তি জগদীশবাবুর কাছে এক সন্ন্যাসীর আগমন ও কথোপকথন দিয়ে। সেই সন্ন্যাসী চলে যাওয়ার সময় জগদীশবাবুর জোর করে ঝোলায় দেওয়া একশো টাকার নোট দেখে শুধু হেসেছিলেন। সেই হাসির অর্থ বোঝার ক্ষমতা জগদীশবাবুর ছিল না। সেই অর্থ বুঝেছিল পৃথক সময়বৃত্তে থাকা হরিদা। সেই হাসির মধ্যে গৃহী-জীবনের বস্তুলোভ ও মায়ার প্রতি একধরনের বিদ্রুপ ছিল। বিদ্রুপটি শুধু এক সন্ন্যাসীর নয়, শাশ্বত অধ্যাত্মবাদের। এই অধ্যাত্মবাদকে অস্বীকার করে শুধুমাত্র কোনও অজ্ঞানী মানুষই বেঁচে থাকার কথা ভাবতে পারেন। কিন্তু যাঁর আত্মপ্রশ্ন আছে, নিজেকে যিনি সময়ের ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে চান জ্ঞানের পরিপূর্ণ সাধনায়, তিনি নিশ্চিতভাবেই জানেন অর্থ-অহংকার, অর্থ-লোভের থেকে জ্ঞানমার্গের পথ আলাদা। ওই সন্ন্যাসীর বার্তা সংসারে গৃহী-এক- সন্ন্যাসীর কানে এসে মর্মে পশিল। এর ফল হল এই, বহুরূপের খেলা দেখিয়ে-বেড়ানো সামান্য এক প্রান্তিক মানুষ নিজেকে, তার কর্মের পথ ধরেই খুঁজে নিতে চাইল জীবন-স্বরূপের মধ্যে।
হরিদা কেন বহুরূপী সাজার মতো অনিশ্চয়তাময় পেশা আঁকড়ে বেঁচে আছেন? কারণ, কোনও ধরনের নিশ্চয়তাই যেন তাঁর অন্তর্জগতের দার্শনিক সত্তাকে, তাঁর মননের মধ্যে শেকড় বিস্তার করে বসা কবিকে মেরে ফেলবে। পেশার অনিশ্চয়তা ও রোমাঞ্চে তিনি যেন সবসময় আত্মপ্রশ্ন করার এবং উত্তর খোঁজায় নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চান। ঋক-বৈদিক যুগের সেই সমস্ত ঋষি-কবিও নিজেকে পৃথক রেখে নৈঃশব্দ্যকে অঙ্গীকার করে দিনযাপনের কথা ভাবতেন– তা কি নিজেকে সবসময়ে শানিত এবং প্রস্তুত রাখার জন্য নয়? বাল্মীকি, ব্যাসদেবের চেয়ে আর কেই-বা ভারতবর্ষের দার্শনিক নৈঃশব্দ্য এত সুনিবিড়ভাবে উপলব্ধি করেছিলেন? আমাদের মনে পড়বে নিশ্চয়ই, হাজারিবাগে জন্মানো ও শিক্ষা পাওয়া সুবোধ ঘোষ ঋষি, দার্শনিক, বহুভাষাবিদ মহেশচন্দ্র ঘোষের সংস্পর্শে এসেছিলেন। তাঁর সঙ্গই কি তাঁকে কোনওভাবে ভারতীয় অধ্যাত্ম ও দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট করে তুলেছিল?
২
গল্পের দ্বিতীয়, অর্থাৎ মূল ভাগটিই এ-গল্পের এবং গল্পকারের মূল সাধনক্ষেত্র। পাঠকও যেন এই অংশটির অপেক্ষায় ছিলেন। কথাসাহিত্যে পরিবেশ রচনা ক’রে কোনও কিছুর অগ্রিম পূর্বাভাস দেওয়া, ন্যারেটিভের প্রতি আগ্রহ ও টেনশন বাড়ানো খুবই চেনা প্রক্রিয়া। জগদীশবাবুর বাড়িতেই হরিদা তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ বহুরূপের খেলাটি দেখাবেন। তার প্রস্তুতি হিসেবে এসেছে একটি অপরূপ সন্ধ্যার সময়। আর বিরাগীরূপী হরিদা যেন সেই সন্ধ্যার পাগল। কেমন সেই সন্ধ্যা? চন্দ্রালোকিত, চন্দ্রধৌত, স্নিগ্ধ, শান্ত উজ্জ্বলতায় ভরপুর। সেই সন্ধ্যায় জগদীশবাবুর বাড়িতে এলেন হরিদা। কিন্তু তিনি তখন হরিদা নন। হরিদার আইডেন্টিটি তাঁর মন থেকে মুছে গেছে; কিংবা এ-ও হতে পারে, বিরাগীর ছদ্মবেশে এই মানুষটিই হয়তো প্রকৃত, যাঁকে প্রতিদিন হরিদার অভিনয় করতে হয়। এই মানুষটি তাঁর ঝোলা থেকে বের করেন গীতা। কী-যেন দেখেন, তারপর নিজের মনে হেসে ওঠেন। এখানে গল্পের প্রথম পর্বের ওই হিমালয়ের সন্ন্যাসী আর হরিদা কোথায় এক হয়ে গেলেন এই বিদ্রুপপূর্ণ দার্শনিক হাসির সমাপতনে।
এই গীতার অনুষঙ্গতেই আমাদের মনে হয়, এই গল্পে আত্মপ্রশ্নের ডিসকোর্সটি গড়ে উঠেছে। এরপরে বিরাগীরূপী হরিদার যে বক্তব্য তার মধ্যেও তো সৃষ্টিরহস্যকে জানতে চাওয়ার মৌল আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। রয়েছে সমস্তরকম ভোগবাদ থেকে মুক্ত হয়ে, সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে পরম সুখে বিলীন হওয়ার কথা। বাইরের এই প্রকৃতির মধ্যে থাকার আনন্দ ত্যাগ করে গৃহী-সুখ একজন আত্মসন্ধানীর কাছে অর্থহীন। তাই জগদীশবাবু তাঁকে মহারাজ বলে সম্বোধন করলে তিনি নিঃসংশয়ে বলতে পারেন: ‘আমি এই সৃষ্টির মধ্যে এককণা ধূলি’। জগদীশবাবু একশো-এক টাকা দিতে চাইলে তিনি তাকে তৎক্ষণাৎ নস্যাৎ করেন। যা-কিছু আমাদের জীবনে আপতিক, তাকে নিয়ে বেঁচে থাকা তাৎপর্যহীন। অথচ আমরা কি এই সত্য বুঝে উঠতে পারি? আধুনিকতার আত্মগর্বে, সমাজতাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক প্রশ্নে এ-কথাই তো বারবার প্রমাণ হয়েছে– কতিপয় কিছু হৃদয়, যাঁরা সময় ও সমাজে কোণঠাসা; শহরের সবচেয়ে সরু গলিটার এক ঝিম-ধরা-ঘরে তাঁর কোনওমতে উনুন জ্বলে। আত্মপ্রশ্নের প্রজ্বলিত আগুন, প্রান্তিক হয়েও যা-কোনও দিন নিভে যায় না, নিভতে দেয় না। বেদান্তশাস্ত্রের মূল কথা কী? জীবিতাবস্থাতেই যখন হৃদয়ের গ্রন্থিসকল ( জাগতিক কামনাসমূহ) বিনষ্ট হয়, তখন মর মানুষ অমর হয়। গীতায় রসতাত্ত্বিক শ্রীকৃষ্ণই হোন কিংবা ‘বহুরূপী’-র হরিদা, তাঁরা তো সেই কথাই বারবার বিষয়ীকে বোঝাতে চান। বেদান্তশাস্ত্রের যা মূল কথা, বেদনাশাস্ত্রেরও তাই নয় কি?