সেই পটই আঁকছেন কৃপাময়ী কর্মকার। পটের নাম ‘মহামারী পট’। মল্লভূমে কলেরার সময় মল্লরাজার স্বপ্নে দেবীর নির্দেশ ছিল তাঁর পট আঁকানোর। কিন্তু পরবর্তীকালে এই পট আঁকা নিষিদ্ধ। জনশ্রুতি: প্রথম যিনি এই পট আঁকেন, তিনি তিনদিনের মধ্যেই মারা যান। কিন্তু কৃপাময়ী সেই পট আঁকছেন, ২০১১ সাল থেকে আজ পর্যন্ত।
কৃপাময়ী আঁকছেন। নির্ভয়ে আঁকছেন তিনি। কিন্তু আঁকার সঙ্গে ভয়ের কী সম্পর্ক? আছে, অবশ্য়ই আছে। কারণ এ যে-সে পট নয়– মহামারী পট! তিনি আঁকছেন, এবং ভয়ের এই পট পরিবর্তন ঘটছে তাঁর হাত ধরেই।
গ্রামটির নাম বনবীরসিংহ। যে পট কৃপাময়ী আঁকছেন, তা যে শতাব্দী প্রাচীন, সাধারণ মানুষ চোখেই দেখেন না। নবমী নিশিতে যে পটের পুজো হয় সবার অলক্ষ্যে। যে পটচিত্র শিল্পীরা আঁকতে চান না অমঙ্গলের ভয়ে। পটশিল্পী কৃপাময়ী সেই পট এঁকে চলেছেন একমনে! গ্রামের বয়স্ক মানুষরা চিন্তায় পড়েছেন– কী অমঙ্গল, কী অমঙ্গল। নির্ঘাৎ অমঙ্গলজনক কিছু একটা ঘটবেই!
না, এখনও পর্যন্ত তেমন কিছু অঘটন ঘটেনি কৃপাময়ী কর্মকারের জীবনে। ২০১১ সালে বাঁকুড়ার পটশিল্পী কৃপাময়ী জামকুড়ি রাজ পরিবারের আগের শতাব্দী প্রাচীন জীর্ণ দুর্গাপটটিকে দেখে নতুন করে এঁকেছিলেন এই মহামারী পটটিকে। পাঠক, এই পর্যন্ত বলে এই ঘটনার আগের কথা আপনাদের একটু জানাই। আমার, আপনার– মোটামুটি প্রত্যেকেরই; মহামারী কী, তা আর আলাদা করে জানার-বোঝার কিছু নেই।
এখন মহামারী পট কী ও কেন, সেটা একটু বলে দিই আপনাদের। কয়েক শতাব্দী আগে মল্লভূমে একবার কলেরার প্রকোপ বেড়েছিল। হু হু করে মানুষ মারা যাচ্ছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে কথিত আছে, মল্লরাজ এক স্বপ্নাদেশে দেবীমূর্তি দেখতে পান। আদেশ পান এই দেবীর রূপ পটে এঁকে পুজো করলেই কলেরা থেকে মিলবে মুক্তি। মল্লরাজ এই স্বপ্নাদেশের পর সেই দেবীমূর্তি পটে আঁকিয়ে পুজো করেছিলেন। সেই পুজো এখনও হয়ে আসে জামকুড়ি মল্লরাজ পরিবারে। প্রচলিত বিশ্বাস এই যে, এই পট দেখা ও আঁকা নিষিদ্ধ। যিনি আঁকেন, তাঁর ভালো হয় না। আর এই দেবীর পুজো হয় নবমীর রাতে। যে পুজো হয় লোকচক্ষুর আড়ালে।
কলকাতায় এই মহামারী পট আনা হয়েছিল ‘বাংলার লোকশিল্পে দুর্গা’ নামক একটি প্রদর্শনীতে। তবে ২০১১ সালে কৃপাময়ী যে মহামারী পটটি এঁকেছিলেন, সেই পটটি আনা হয়নি। সেটি জামকুড়ি রাজবাড়িতে পুজো হয়। ২০১২ সালে তিনি আবার আরেকটি মহামারী পট আঁকেন। সেই পটটিকে আনা হয়েছে প্রদর্শনীতে। আর কৃপাময়ী নিজে বলছেন, ‘প্রথমে আমি যখন এই পট আঁকি, তখন কাউকে বলিনি। তারপর যখন জানাজানি হল, তখন অনেকেই শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তবে ২০১১ সাল থেকে এখন ২০২৩– ঠাকুরের আশীর্বাদে আমার কোনও সমস্যা হয়নি।’ জনশ্রুতি এই যে, প্রথম এই মহামারী পট যিনি এঁকেছিলেন, তিনি তিনদিনের মধ্যেই মারা গিয়েছিলেন।
কৃপাময়ী পট আঁকা শিখেছিলেন তাঁর শ্বশুরমশাই নিতাই কর্মকারের থেকে। নিতাইবাবুকে একাধিকবার জামকুড়ি রাজবাড়ি থেকে মহামারী পট আঁকার অনুরোধ করা হলেও তিনি আমৃত্যু এই পট আঁকতে অস্বীকার করেন। নিতাই কর্মকার মারা যান ২০০২ সালে। তারপরই কৃপাময়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি আঁকবেন মহামারী পট। কৃপাময়ী বলেন, ‘আমার শ্বশুরমশাইয়ের কাছে রাজপরিবারের থেকে একাধিকবার অনুরোধ আসলেও উনি মহামারী পট আঁকতে রাজি হননি।’ মহামারী পট না আঁকলেও নিতাই কর্মকার রাজবাড়ির জন্য তিনটি করে দুর্গাপট আঁকতেন। এখনও কর্মকার বাড়ি থেকে প্রতি বছর দুর্গাপুজার ষষ্ঠীর দিন তিনটি করে আলাদা দুর্গাপট যায় জামকুড়ি রাজপরিবারে। সেই তিনটি পটে পুজো হয়। তবে মহামারী পট যতদিন না জীর্ণ হয়, ততদিন পরিবর্তন করা হয় না। শিল্পীরাই যদি পট আঁকতে নারাজ হন, তাহলে পট পরিবর্তন হবেই বা কী করে!