রুগন পৃথিবীর বুকে হয়তো একদিন কয়েক হাজার কৃত্রিম পতঙ্গ প্রজনন কেন্দ্র তৈরি হবে। ঢাউস ইগলুর মতো কাচের ঘরে চোখ ধাঁধানো আলোর মধ্যে হয়তো একদিন শ্যামাপোকার চাষ হবে। চৌখুপী কোন ঠান্ডা ঘরে হয়তো হবে প্রজাপতি প্রজনন কেন্দ্র। উচ্চিংড়ে, গাংফড়িং, ভ্রমর, বোলতা, গুবরে পোকা, ঝিঁঝি পোকা, জোনাকি, কেউ বাদ যাবে না। সবার জন্য কৃত্রিম আবহাওয়া তৈরি করে কৃত্রিম ‘হ্যাবিট্যাট’ বানিয়ে ফেলব আমরা। হয়তো সফলও হব। তবে সেদিন হয়তো আর কোনও গুবরে পোকা তার মৃত সঙ্গীকে সারা দুপুরের পরিশ্রমে সমাধিস্থ করবে না।
আমি তখন ক্লাস সিক্স। বিকেলে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে দেখি, মা কেমন উদাস চোখে উঠোনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। ঘরদোর অগোছালো। সাধারণত এই সময় মা সব কাজ সেরে খবরের কাগজ কিংবা গল্পের বই নিয়ে বসে। আজ কী হল! মা’র কি তবে শরীর খারাপ? ‘না, না, শরীর ঠিক আছে। এতক্ষণ এক অদ্ভুত জিনিস দেখছিলাম। মনটা কেমন ভার হয়ে আছে রে।’ তারপর মা সেই অদ্ভুত অভিজ্ঞতার কথা শোনাল আমায়।
আমাদের মাটির উঠোন। উঠোনের এক নির্দিষ্ট জায়গার ওপর একটা গুবরে পোকা ভোঁ ভোঁ করে উড়ে বারবার চক্কর কাটছিল। সেটা মা’র নজরে পড়ে। কৌতূহল হয়। মা লক্ষ করে, উঠোনের ওই জায়গাতেই পড়ে আছে এক মৃত গুবরে পোকা। উড়তে থাকা গুবরে পোকাটি এবার ওড়া থামিয়ে উঠোনের মাটি খুঁড়তে শুরু করে। তার সরু লিকলিকে পা দিয়ে মাটি সরিয়ে একটু করে গর্ত করে আর নিজে তার মধ্যে ঢুকে মাপ নেয়। বহুক্ষণ ধরে চলে তার খনন কার্য। যখন সে বুঝল নিজে সম্পূর্ণভাবে গর্তে এঁটে যাচ্ছে তখন সে মুখে করে টেনে আনে পাশে পড়ে থাকা মৃত গুবরে পোকাটিকে। গর্তের মধ্যে মৃত সঙ্গীকে রেখে চারপাশে জড়ো হওয়া মাটি দিয়ে ঢেকে দেয় সে কবর!
এখানেই শেষ নয়। বারবার নিজের পিছন দিয়ে টোকা মেরে কবরের ওপরের মাটিকে মসৃণ করে দেয়। মিশিয়ে দেয় উঠোনের সঙ্গে। যেন কেউ টেরটি না পায় মাটির নিচে ঘুমিয়ে আছে তার প্রিয় সঙ্গী। সব শেষে কবরের ওপর বার তিনেক চক্কর কেটে উড়ে গেল সে। একলা।
মা’র মুখে সবটা শুনে সেদিন আমারও মনটা খুব ভার হয়েছিল। একটা গুবরে পোকার শরীরে এত মায়া! এত ভালোবাসা! মৃত সঙ্গীকে সে এমন করে সমাধিস্থ করে! বিবর্তনবাদী জীববিজ্ঞানী এবং পরিসংখ্যানবিদ জে. বি. এস. হলডেন বলেছিলেন, ‘আকাশের তারা এবং গুবরে পোকার ওপর সৃষ্টিকর্তার অপার ভালোবাসা আছে’। সে নেহাতই সংখ্যার নিরিখে। পৃথিবীতে প্রায় দেড় মিলিয়ন প্রজাতির গুবরে পোকা আছে। হয়তো আপনি আমিও অনেক পোকা দেখেছি। দেখে ছিটকে সরে এসেছি বা এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়েছি। খেয়াল করিনি এরকম পোকাকে আগে দেখেছি কি না। কে বলতে পারে, আপনি শেষ যে পোকাটিকে গা থেকে এক ঝটকায় ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন, সেই পোকাটির প্রজাতি এখন এ পৃথিবীতে টিকে আছে কি না! যে পোকাটি তার সঙ্গীকে পরম মমতায় সমাধিস্থ করেছিল, সেই প্রজাতিরও আর অস্তিত্ব আছে কি না, তা-ই বা কে জানে! কারণ, প্রতিদিন এ পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কীটপতঙ্গ। হারিয়ে যাচ্ছে তাদের জীবনের মায়াবী গল্পও।
এবার দীপাবলি-তে শ্যামাপোকা তেমন চোখে পড়েনি। ঘরের টিউবলাইট থেকে প্যান্ডেলের জোরালো হ্যালোজেন, যেখানেই আলো, সেখানেই ঝাঁক বেঁধে উড়ে বেড়াত শ্যামাপোকার দল। হেমন্তের এই পতঙ্গ এক রাতের অতিথি। ভোরের আলো ফুটলে দেখা যেত আলোর তলায় বিছিয়ে আছে অজস্র মৃত শ্যামাপোকা। গায়ে মাথায় বা খাবারে পড়লে আমরা এতকাল বেজায় বিরক্ত হতাম! কিন্তু এবার তাদের অনুপস্থিতি আমাদের ভাবাচ্ছে। শুধু এ বছর নয়। গত দু’তিন বছর ধরেই শ্যামাপোকার সংখ্যা কমছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় পরিবেশ সচেতন মানুষেরা এই নিয়ে তাদের আশঙ্কার কথা লিখেছেন।
আপনি কি খেয়াল করেছেন, আপনার বাড়ির পাশের শিউলি গাছটির ডালে আর কোনও শুঁয়োপোকা নেই? শুঁয়োপোকার জন্যেই হয়তো আপনার শিউলি গাছ নিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে আপনার মনোমালিন্য হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগেও হয়তো আপনি দেখে থাকবেন গাছ থেকে নেমে আপনার জানলা বা মেঝে বেয়ে হেঁটে চলেছে ধূসর কালো শুঁয়োপোকা। গা-ভর্তি রোঁয়া। এ দৃশ্য এখন আর তেমন চোখে পড়ে না। ছোটবেলায় কত বিচিত্র রঙের প্রজাপতি দেখেছেন মনে আছে? আজ তার সিকিভাগও দেখা যায় না। ভারতেই প্রায় ১৮০০ প্রজাতির প্রজাপতির বাস ছিল। শুধুমাত্র অনিয়মিত শীতের কারণে, শীতঘুম দিতে না পেরে বিপন্ন এবং নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কয়েকশো প্রজাতির প্রজাপতি। মনে পড়ে, ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে মিটিস করে জ্বলে উঠেই নিবে যেত এক রহস্যময় আলো? শেষ কবে দেখেছেন জোনাকির আলো! নিকষ অন্ধকারের মতো জোনাকিও হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের জীবন থেকে। শুধু আমাদের দেশ না, পৃথিবী জুড়েই এমনটা ঘটছে।
এ পৃথিবীতে কম করে সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন কীটপতঙ্গের বাস। প্রায় ৮৯ শতাংশ কীটপতঙ্গের নাকি এখনো নামকরণই হয়নি। বছরে দুই থেকে আড়াই শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে কীটপতঙ্গের সংখ্যা। কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা দায়ী করছেন, বনাঞ্চল ধ্বংস করা, দ্রুত নগরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, কীটনাশকের ব্যাবহার, দূষণ, বিশেষ করে আলো দূষণ এবং এমন আরও অনেক বিষয়। দেশীয় গাছপালা কেটে বিজাতীয় গাছ লাগানোও কীটপতঙ্গ ধ্বংসের এক মস্ত কারণ। পাম বা, ইউক্যালিপটাসের মতো গাছেরা কোনও দেশীয় পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল নয়। বাস্তু হারিয়ে কীটপতঙ্গেরা বিপন্ন হয়ে পড়ছে। তারা তাদের ইকোসিস্টেমের বাইরে খাপ খাওয়াতে পারছে না। স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি এবং সরীসৃপের চেয়ে আট গুণ দ্রুত গতিতে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে কীটপতঙ্গরা।
আন্তঃরাষ্ট্র জীব বৈচিত্র এবং ইকোসিস্টেম নীতি প্ল্যাটফর্মের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কীটপতঙ্গরাই পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ কৃষিজ শষ্যের পরাগমিলন ঘটায়, যার বাণিজ্যিক মূল্য বছরে ৫৭৭ বিলিয়ন ডলার। প্রকৃতির ৮০ শতাংশ গাছপালাই বংশ বিস্তারের জন্যে কীটপতঙ্গের ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। নির্ভরশীল অগণিত পাখিও। খাদ্যের জন্যে। কীটপতঙ্গের সংখ্যা কমার সঙ্গে সঙ্গে কমছে তাদের ওপর নির্ভরশীল গাছপালা আর পশুপাখির সংখ্যাও। ২০২০ সালে ‘সায়েন্স’ জার্নালের এক প্রতিবেদন জানাচ্ছে, প্রতি দশকে প্রায় ৯ শতাংশ হারে স্থলবাসী কীটপতঙ্গ কমছে।
এ বিপন্নতাকে কোনও ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ হিসেবে দেখলে চলবে না। শুধুমাত্র সংরক্ষণের আওতায় এনেও এই জীবকুলকে বাঁচানো যাবে না। দরকার সুসংহত পন্থা-পদ্ধতির। বনজঙ্গল নিঃশেষ করে লাগামছাড়া নগরায়নের মাশুল গুনছে বনাঞ্চলবাসী প্রান্তিক মানুষেরা। তারা তাদের নিজভূমি থেকে উৎখাত হয়ে শহরমুখী হতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ এইসব প্রান্তিক ও আদিম জনজাতির হাতেই প্রকৃতি ও পরিবেশ লালিত হয়ে এসেছে এতকাল। তারাই জানে, কেমন করে জল, হাওয়া, মাটি, গাছ, পোকামাকড় এবং বন্যপ্রাণের পারস্পরিক বোঝাপড়ায় শুশ্রূষা পায় প্রকৃতি। প্রকৃতির প্রহরায় জেগে থাকে তাদের দু’চোখ। অথচ তাদেরই অরণ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে রাষ্ট্র। পরিবেশ আইনজীবি অর্পিতা কোডিভেরির সম্প্রতি প্রকাশিত বই ‘গভর্নিং ফরেস্টস’ এই বিচ্ছিন্নতার বিরুদ্ধে সরব। অরণ্যবাসী প্রান্তিক মানুষদের বাদ দিয়ে অরণ্য সংরক্ষণের ভাবনা যে এক বিশাল গলদ সেকথা রাষ্ট্র কবে বুঝবে! মহাশ্বেতা দেবীর উপন্যাস ‘ব্যাধখণ্ড’ও তো কবেই বোঝাতে চেয়েছে, প্রকৃতিকে আগলে রাখাই হল আরণ্যক জীবনের মর্মকথা। সে মর্মকথা অবশ্য রাষ্ট্রকল্পিত ‘উন্নয়ন’-এর খাপে পড়ে না। তাই অরণ্যবাসীর কাছ থেকে অরণ্য সংরক্ষণের শিক্ষা না নিয়ে কাচের ঘরে বসে নেওয়া হয় আমলাতান্ত্রিক পরিকল্পনা। তার ফল তো এমন হওয়ারই কথা! দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে বিপন্ন গাছপালা, পশুপাখি, কীটপতঙ্গের তালিকা। পাল্লা দিয়ে উন্নয়নের সূচক হৃষ্টপুষ্ট হবে। সাফল্যের উদযাপন করবে গর্বিত রাষ্ট্র।
রুগন পৃথিবীর বুকে হয়তো একদিন কয়েক হাজার কৃত্রিম পতঙ্গ প্রজনন কেন্দ্র তৈরি হবে। ঢাউস ইগলুর মতো কাচের ঘরে চোখ ধাঁধানো আলোর মধ্যে হয়তো একদিন শ্যামাপোকার চাষ হবে। চৌখুপী কোন ঠান্ডা ঘরে হয়তো হবে প্রজাপতি প্রজনন কেন্দ্র। উচ্চিংড়ে, গাংফড়িং, ভ্রমর, বোলতা, গুবরে পোকা, ঝিঁঝি পোকা, জোনাকি, কেউ বাদ যাবে না। সবার জন্য কৃত্রিম আবহাওয়া তৈরি করে কৃত্রিম ‘হ্যাবিট্যাট’ বানিয়ে ফেলব আমরা। হয়তো সফলও হব। তবে সেদিন হয়তো আর কোনও গুবরে পোকা তার মৃত সঙ্গীকে সারা দুপুরের পরিশ্রমে সমাধিস্থ করবে না। আলসে দুপুরে উঠোনের দিকে তাকিয়ে উদাস হবে না কোনও মা’র মন। না দেখা সেই দৃশ্য কল্পনা করে মনখারাপ হবে না কোনও আবেগী স্কুল পড়ুয়ার। আসুন, বিপন্নতার অভিধানে চোখ রাখি। মনকে শক্ত করার পাঠ নিই।