সন্তান না-চাওয়ার বিষয়টি এদেশে এতটা সংবেদনশীল কেন? কারণ, এদেশে এখনও আমরা ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি না, করি সামাজিক রক্ষণশীলতা ও নিয়মানুবর্তিতায়। বিশ্বাস করি যে সন্তানই বিবাহের ভিত্তিপ্রস্তর মজবুত করে, বিবাহিত জীবন সুখের করে। বিশ্বাস করি যে নিজের সারাজীবনের কষ্টার্জিত অর্জন সঁপে দেওয়ার জন্যে একটি অন্তত সন্তান প্রয়োজন; নইলে অ্যাদ্দিন ধরে চোখেমুখে গুঁজে এত রোজগার করলাম কীসের জন্য? বিশ্বাস করি যে, বৃদ্ধাবস্থায় প্রত্যেক মানুষের একটি অন্তত সহায় প্রয়োজন। ভেবে দেখুন, সন্তান চাওয়ার পিছনে উপরোক্ত প্রতিটি কারণই কী অসম্ভব নেতিবাচক। আমার ভঙ্গুর বিবাহের দায় নেবে আমার সন্তান। অর্থাৎ বিয়েটা করলাম আমি, অথচ তা টিকিয়ে রাখার দায় এমন একজনের, যে এখনও জন্মায়ইনি।
অ্যান্টিনাটালিস্ট। অর্থাৎ, জন্মবিরোধী। সেইসব মানুষেরা, যাঁরা মনে করেন যে নশ্বর এই পৃথিবীতে শিশুর জন্ম দেওয়াটাই একটি অনৈতিক কাজ। জার্মান দার্শনিক আর্থার স্কোপেনহারের ভাষায়, ‘কোনও শিশুকে এই যন্ত্রণাময় মানবজীবনের অভিজ্ঞতা করানোটাই একটি ঘোরতর দুষ্কর্ম।’
উনিশ শতকের গোড়ার দিকে যে-কথা বলে গেছেন স্কোপেনহার, সে-কথা আজ একুশ শতকে দাঁড়িয়েও আমাদের অতিপ্রাকৃত বা নভোস্থিত মনে হয়। মনে হয়, এসবই হল আমেরিকান বা ইউরোপিয়ান নিও-মডার্নিজম চিন্তাভাবনার উৎপাত। আসলে আমরা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি যে, বাকি সবকিছুর মতোই, মাতৃত্ব বা পিতৃত্বও একটি ‘চয়েস’ মাত্র। জীবনযাত্রার অক্সিজেন নয় মোটেই।
সম্প্রতি এই কথাটাই মনে করিয়ে দিলেন অভিনেত্রী রাধিকা আপ্তে। শুধু তো চরিত্রে নয়, বাস্তব জীবনেও বরাবরই অকপট, প্রতিষ্পর্ধী তিনি। প্রিমিয়ারে নিজের মা হওয়ার বিষয়টি নিয়ে কোনওরকম আদিখ্যেতা না করে সপাটে জানালেন, ‘ব্যাপারটা মোটেই তেমন ভালো লাগছে না, নিদ্রাহীন রাত কাটছে। আসলে কখনও ভাবিনি যে মা হব।’
বলা বাহুল্য, যে সুশীল সমাজ, রাধিকার ফ্যান মহলের একাংশ, নেটিজেন– অনেকেই এই নিয়ে সরব হয়েছে। গালে হাত দিয়ে ভাবতে বসেছে, মা গো মা, এ কেমন মেয়েমানুষ, যে কি না মা হতে চায় না!
আমেরিকার পিউ রিসার্চ সেন্টারের সার্ভে কিন্তু বলছে যে এটাই বাস্তব। বিশ্ব সংসারের বহু মানুষই আপন সন্তান চান না। কিন্তু সবাই রাধিকার মতো সাহসী নন, তাই আপন ইচ্ছের কথা প্রকাশ করে উঠতে পারেন না। পরিবার ও সমাজের চাপে পড়ে মাতৃত্বে বাধ্য হন। ভেবে দেখলে এ-ও এক চরম সামাজিক নির্যাতন।
এর সঙ্গে যদিও অ্যান্টিনাটালিজমের সরাসরি সম্পর্ক নেই, কারণ অ্যান্টিনাটালিজমের দর্শনতত্ত্ব বিশ্বাস করে যে এ-পৃথিবী এতটাই তীব্র যন্ত্রণাদায়ক, যে পৃথিবী থেকে লব্ধ সুখের অনুভূতি সেই দুঃখ-কষ্টকে ছাপিয়ে যেতে পারে না। আর তাই, এই যাতনাময় জীবন নবপ্রজন্মকে উপহার দিতে চান না তারা। কিন্তু রাধিকার মতোও বহু মানুষ আছেন, যাঁরা এমনতর ভাবনায় বিশ্বাসী নন। শিশুদের ভালোবাসেন প্রাণ দিয়ে কিন্তু মা (বা বাবা) হতে চান না, আপন সন্তান চান না। আসলে সন্তান চাওয়া বা না-চাওয়া একটি নিতান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছের ব্যাপার। পরিসংখ্যান বলছে যে, আমেরিকার ৪৭ শতাংশ, কানাডার ৩০ শতাংশ, ইউরোপের ২০ শতাংশ আর দক্ষিণ কোরিয়ার ৫০ শতাংশেরও অধিক মানুষ আপন সন্তান চান না। আমাদের এই ভারতের ক্ষেত্রে এই শতাংশের কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য পাই না। কারণ এদেশে বিষয়টি এখনও এতটাই সংবেদনশীল যে, তা নিয়ে এখনও কোনও প্রামাণ্য রিসার্চের হদিশ নেই। তবে মোটের ওপর দেখতে পাই যে, বেঙ্গালুরুতে একটি বড়সড় এবং সক্রিয় অ্যান্টিনাটালিস্ট দল রয়েছে। পরিবেশ রক্ষা, ভেগান মুভমেন্টে বা খাদ্যের উদ্দেশ্যে প্রাণীহত্যার বিরোধিতার পাশাপাশি, এরা জন্মবিরোধী তত্ত্বেরও বিশ্বাসী। সেই উদ্দেশ্যে নানা কর্মসূচি বা প্রচার অভিযানও চালান এঁরা।
এখন প্রশ্ন হল এই যে, সন্তান না-চাওয়ার বিষয়টি এদেশে এতটা সংবেদনশীল কেন? কারণ, এদেশে এখনও আমরা ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করি না, করি সামাজিক রক্ষণশীলতা ও নিয়মানুবর্তিতায়। বিশ্বাস করি যে, সন্তানই বিবাহের ভিত্তিপ্রস্তর মজবুত করে, বিবাহিত জীবন সুখের করে। বিশ্বাস করি যে, নিজের সারাজীবনের কষ্টার্জিত অর্জন সঁপে দেওয়ার জন্যে একটি অন্তত সন্তান প্রয়োজন; নইলে অ্যাদ্দিন ধরে চোখেমুখে গুঁজে এত রোজগার করলাম কীসের জন্য? বিশ্বাস করি যে, বৃদ্ধাবস্থায় প্রত্যেক মানুষের একটি অন্তত সহায় প্রয়োজন। সন্তান ছাড়া সে-সহায় আর কেই বা হতে পারে?
ভেবে দেখুন, সন্তান চাওয়ার পিছনে উপরোক্ত প্রতিটি কারণই কি অসম্ভব নেতিবাচক। আমার ভঙ্গুর বিবাহের দায় নেবে আমার সন্তান। অর্থাৎ বিয়েটা করলাম আমি, অথচ তা টিকিয়ে রাখার দায় এমন একজনের, যে এখনও জন্মায়ইনি। তাই তাকে জন্ম দিতে হবে। যাতে তাকে কেন্দ্র করে আমার এই তাসের ঘরকে সমাজে আমি প্রতিষ্ঠা করতে পারি সুখী গৃহকোণ রূপে। এ-প্রসঙ্গে আমার এক বয়োজ্যেষ্ঠ শুভাকাঙ্ক্ষীর কথা মনে পড়ে। বিয়ের দু’-বছরের মাথায়ও সন্তান নিইনি দেখে তিনি আমায় বলেছিলেন যে, ‘শাদি কা প্যাহেলা এক-দো সাল হি আচ্ছা চলতা হ্যায়। ফির বাচ্চা তো লেনা হি পরেগা। এক-দুসরে কো কিতনা দিন প্যায়ার করোগে?’ এদেশের বেশিরভাগ মেয়ের মতো আমিও সেদিন বলতে পারিনি যে, ‘প্যায়ার নেহি হ্যায়, আয়সা শাদিমে রহেনা হি কিউ হ্যাঁয়, ভাবি?’ ভালোবাসা নেই এমন বিয়েতে থাকব কীসের তাগিদে? আর আপনারা যে বলেন সন্তানপ্রেম নাকি পৃথিবীর সবথেকে নিঃশর্ত ভালোবাসা? তাই যদি হবে, তাহলে প্রাথমিকভাবে নিজের ফেইল্ড ম্যারেজকে টিকিয়ে রাখার জন্যে যে একটি সন্তান নিয়ে আসব পৃথিবীকে, পাপ হবে না তাতে?
সরকারি চাকরির নিশ্চিত রোজগার দেখে কয়েকদিন আগে পাড়ার এক কাকু বললেন, ‘এবার একটা অন্তত ছানাপোনা নাও, নইলে এসব খাবে কে?’ এখন বিয়ের দীর্ঘবছর অতিবাহিত। এসব প্রশ্ন সম্মুখীন হওয়ায় ধাতস্থ হয়ে উঠেছি। বললাম, ‘হাঙ্গার ইনডেক্সে একশো সাতাশটি দেশের মধ্যে ভারত একশো পাঁচ নম্বরে। তাই ভাবছি, মরার আগে এসবই দান করে দিয়ে যাব।’
কথাটা সৎ উদ্দেশ্যে এবং বিশ্বাস করেই বলেছিলাম। যদিও ওই কাকুর মনে হয়েছিল আমার উত্তরটি যথেষ্ট সম্মানপ্রদ নয়। কী আর বলা!
…………………………………………….
বিয়ের দু’-বছরের মাথায়ও সন্তান নিইনি দেখে এক শুভাকাঙ্ক্ষী আমায় বলেছিলেন যে, ‘শাদি কা প্যাহেলা এক-দো সাল হি আচ্ছা চলতা হ্যায়। ফির বাচ্চা তো লেনা হি পরেগা। এক-দুসরে কো কিতনা দিন প্যায়ার করোগে?’ এদেশের বেশিরভাগ মেয়ের মতো আমিও সেদিন বলতে পারিনি যে, ‘প্যায়ার নেহি হ্যায়, আয়সা শাদিমে রহেনা হি কিউ হ্যাঁয়, ভাবি?’ ভালোবাসা নেই এমন বিয়েতে থাকব কীসের তাগিদে? আর আপনারা যে বলেন সন্তানপ্রেম নাকি পৃথিবীর সবথেকে নিঃশর্ত ভালোবাসা? তাই যদি হবে, তাহলে প্রাথমিকভাবে নিজের ফেইল্ড ম্যারেজকে টিকিয়ে রাখার জন্যে যে একটি সন্তান নিয়ে আসব পৃথিবীকে, পাপ হবে না তাতে?
…………………………………………….
সত্যি বলতে কী, বলার মতো কথা এখনও মাঝে মাঝে খুঁজে পাই না। সেদিন বিয়েবাড়িতে এক নিকটাত্মীয় বললেন, ‘বাচ্চাকাচ্চা নিলে না, বুড়ো বয়সে দেখবে কে?’ বুড়ো হোক বা ছুড়ো– জীবনের কোনও একটা সময় অন্যের ‘দেখার’ ওপর ভরসা করে কাটাতে হবে, এমন একটা কষ্টকল্পনায় বিয়েবাড়ির আনন্দ মাটি না-করার তাগিদে তড়িঘড়ি বরের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললাম,
– ‘ও’।
– ‘ও যদি না থাকে তদ্দিন?’ ভ্রু নাচিয়ে আত্মীয় প্রশ্ন করলেন।
এই ৩৭ বছরের জীবন শিখিয়েছে যে সে যতই নির্মম, হৃদয়বিদারক প্রতিপক্ষরূপে উপস্থিত হোক না কেন, তার মোকাবিলা করতে হবে শক্ত হাতে। নিজের অন্তরে নিজেকে কষ্ট দিয়ে নয়। তাই এমন চূড়ান্ত অসংবেদনশীল কথা শুনে যে আমি আজ থেকে বছর পাঁচেক আগেও রাগে ফেটে পড়ে বলতাম যে নিজের ভগ্নীপতির সম্পর্কে এমন অদ্ভুত নেগেটিভ ভাবনা মাথায় আনেন কী করে? সেই আমিই ঠান্ডা মাথায় গলা খাটো করে বললাম,
– ‘সেক্ষেত্রে আরেকটা বিয়ে করে নেব ভাবছি।’
এসব কথা মুখে যতই বলি না কেন, স্বীকার করতে বাধা নেই যে পরিচিত, নিকটাত্মীয় কিংবা কাছের বন্ধুবান্ধব, প্রতিবেশী বা ভালোবাসার মানুষদের কাছ থেকে অপর প্রিয় মানুষটির সম্পর্কে এমন কথা শুনতে খারাপ লাগে আমাদের সকলেরই। শুনতে শুনতে সেই খারাপ লাগার ইন্টেন্সিটি হয়তো কমে যায়, আরও সময় পরে হয়তো খারাপ লাগার বোধই তৈরি হয় না আর; কিন্তু যে প্রশ্নটা তবু গাঢ় হয়ে দাগ রেখে যায়, তা হল এই বাক্যবাণ আর কষ্টের অনুভূতি মানুষ হিসেবে অন্য মানুষকে দেওয়া… জায়েজ তো?
সন্তানহীন দম্পতিদের নিঃসন্তান বলার মধ্যে বেশ একটা রগরগে ব্যাপার আছে। ‘নিঃ’ মাত্রার শব্দ এক প্রবল শূন্যতার বোধের অনুভূতির জন্ম দেয় মনে। একই অনুভূতি জাগায় ‘চাইল্ডলেস’ শব্দবন্ধটিও। কারণ, যে কোনও ‘লেস’ বা কমতির ভাবনাই যথেষ্ট নির্মম। তাই ইংরেজিতে ‘চাইল্ডলেস’ শব্দটির বদলে এখন ব্যবহার করা হয় ‘চাইল্ড ফ্রি’। তবে এখানে বলে রাখি যে, আজকের দিনেও এই শব্দটির ব্যবহার খোদ ওয়েস্টার্ন সোসাইটিতেও যথেষ্ট কম এবং এদেশে তার ভাষাগত প্রতিশব্দ আজও জন্ম না নিলেও এই শব্দটি কিন্তু নেহাত আধুনিক আবিষ্কার নয়। বরং সঠিক করে বললে, আজ থেকে অন্তত ১২৩ বছর আগের। ১৯০১ সালে নারীবাদীরা এই শব্দের প্রয়োগ শুরু করেন সর্বপ্রথম। কারণ একথা কে না জানে যে সন্তানহীনতার শূন্যতার বোধ, প্রাচ্য হোক বা পাশ্চাত্য, টার্গেট করে মহিলাদের ওপর তৈরি করার সোশিও-পলিটিকাল পদ্ধতিটি বহু প্রাচীন।
………………………………………………..
আরও পড়ুন প্রহেলী ধর চৌধুরী-র লেখা: এ চিঠি আন্না সেবাস্টিয়ান পেরায়িলের মা লেখেননি
………………………………………………..
অথচ হিসেব বলছে যে, সারা বিশ্বের সন্তানহীন দম্পতিদের ৮০ শতাংশই কিন্তু সন্তান নেননি স্বেচ্ছায়। তাই সেখানে অপ্রাপ্তির কোনও অবকাশই নেই। বরং বেশ কিছু রিসার্চ প্রমাণ করে দেখাচ্ছে যে, সন্তানহীন দম্পতিরা আসলে বেশি সুখী। অর্থনৈতিক অসঙ্কুলান, পরিবেশ দূষণ ও তদজনিত স্বাস্থ্যাবনতি, সামাজিক অপরাধমূলক ঘটনার নাগাড়ে বাড়বৃদ্ধি, পরবর্তী প্রজন্মের অনির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ, অমানুষিক প্রতিযোগিতার আবহ, তাঁদের চাকুরি বা রোজগারের অনিশ্চয়তা এবং সর্বোপরি জাস্ট সন্তান নিতে চাই না বলে স্বেচ্ছায় সন্তান নেননি এঁরা। আর ইচ্ছা সত্ত্বেও বাবা মা হতে পারেননি সন্তানহীন দম্পতির মাত্র ১০ শতাংশ।
অতএব, একথা নিশ্চিত করে বলা যেতে পারে যে, সন্তান-শূন্যতার এই সামাজিক নির্মাণ আসলে কিন্তু অন্তঃসারশূন্য। সন্তানের জন্ম দিয়েই হোক বা না-দিয়ে ভালো থাকা আসলে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত একটি চয়েস।
……………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………