সম্প্রতি একটি সমীক্ষায় ৫০ জন পুং-সমকামী ব্যক্তির ওপর একটি সমীক্ষা করে, প্রমাণ করা হয়েছে যে আহমেদাবাদ, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, মুম্বই, এবং লখনউয়ের মতো মেট্রোপলিটন শহরগুলির মধ্যে, কলকাতা-ই সেই একমাত্র শহর যেখানে, সমকামবিদ্বেষ, লিঙ্গ-যৌন হিংসা এবং যৌনবিদ্বেষের চূড়ান্ত নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই সমীক্ষা কলকাতাকে সমকাম-বিদ্বেষের পরাকাষ্ঠা হিসেবে দাগিয়ে দিল ঠিকই; তবে, নগরায়নের ইতিহাস দেখলে, কলকাতা, গত শতকের নয়ের দশক থেকেই; অর্থাৎ, উত্তর-গঠনবাদের ঢেউ ওঠার অব্যবহিত পর থেকেই, একদিকে যেমন বিদ্যায়তনিক, প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে; তেমনি অন্যদিকে সমাজকর্মের মধ্যস্থতায় নারীবাদচর্চা এগিয়ে নিয়ে গেছে।
সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন গণমাধ্যম তথা সামাজিক মাধ্যমে বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছে। ৫০ জন পুং-সমকামী ব্যক্তির ওপর একটি পরিসংখ্যানতাত্ত্বিক সমীক্ষা করে, এটি প্রমাণ করা হয়েছে যে আহমেদাবাদ, বেঙ্গালুরু, দিল্লি, মুম্বই, এবং লখনউয়ের মতো মেট্রোপলিটন শহরগুলির মধ্যে, কলকাতা-ই সেই একমাত্র শহর যেখানে, সমকামবিদ্বেষ, লিঙ্গ-যৌন হিংসা এবং যৌনবিদ্বেষের চূড়ান্ত নিদর্শন পাওয়া গেছে।
ঠিকই শুনেছেন; এই ঘটনা ঘটেছে সেই খাস কলকাতা-তে, যেখানে বিশ শতকের নয়ের দশকে, সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্বপ্রথম রামধনু-পদযাত্রা সংঘটিত হয়েছিল। দিল্লি বা লখনউয়ের মতো শহরে যেখানে রাত দশটার পর মহিলাদের বাড়ি থেকে বেরনোর ওপর সবিশেষ নিষেধ জারি থেকে, সেখানে সত্যাসত্য নিরূপণে উক্ত বয়ান-বিশ্বের একটু গভীরে যেতে হয় বইকি।
(সম)কামবিদ্বেষ আসলে কী? এটি একটি যৌন-মনস্তাত্ত্বিক অবভাস? না কি, এর সামাজিক, সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক তথা অস্তিবাদী ব্যাখ্যানির্মাণও সম্ভব? সত্যি কথা বলতে, সাধারণ অনুমানে ব্যতিক্রমী যৌনবিশ্ব সম্পর্কে প্রাথমিক প্রকল্পটি খানিকটা এমন– সমকামবিদ্বেষ এবং সমযৌনতা যতই পরস্পরবিরোধী শুনতে লাগুক, প্রকৃতার্থে এদের সম্পর্ক অনেকাংশেই দ্ব্যর্থব্যঞ্জক; অর্থাৎ, বিদ্বেষ (phobia) এবং যৌনিকতা (eroticism) যেন একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। মানবসমাজে প্রায়শই সমকামবিদ্বেষী এবং সমযৌনিক সত্তা-বিশ্বের মধ্যে এক-ধরনের কূটাভাসিক রোল-রিভার্সাল দেখতে পাওয়া যায়। বেশিরভাগ সময়েই যে মানুষটি সমকামবিদ্বেষী রূপে সমাজে পরিচিত হয়, তাকেই অতি-সংগোপনে সমযৌনিক কামনা চরিতার্থ করতে দেখা যায়। অবশ্যই এটি কোনও সাধারণ সত্য নয়। তাই সরলীকরণের প্রয়াস না করেই, সমকামবিদ্বেষের কারণ বিশ্লেষণে আলোচ্য প্রতিবেদনটির ওপর আতশকাচ ফেলা যাক।
প্রথমত, সমকামবিদ্বেষের কারণ-বিশ্লেষণে যা সবার আগে বুঝতে হবে, তা হল সমকামী সত্তা-নির্মাণের কালানুক্রমিক ইতিহাসের নিরিখে, ভারতীয় উপমহাদেশের ব্যত্যয়ী লিঙ্গ-যৌনবর্গগুলি কীভাবে তৈরি হয়েছে? ‘সিগাল্ বুক্স্’, কলকাতা থেকে ২০০৭ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধ-সংকলন ‘The Phobic and the Erotic: The Politics of Sexualities in Contemporary India’-র মুখবন্ধটি পড়লে জানা যায় যে উত্তর-ঔপনিবেশিক জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশে সমসাময়িক ভারতীয় যৌনসত্তার নির্মাণ কখনওই একমাত্রিক নয়; বরং, বলা যায় ভারতে, ব্যতিক্রমী লিঙ্গ-যৌনসত্তার নির্মাণ, আধুনিকতা, উপনিবেশবাদ এবং বিশ্বায়নের যৌগিক ফসল। ফলে ‘গে’ বলতে যে বিশেষ যৌনসত্তার কথা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে তা বোধহয়, পাশ্চাত্য-বিশ্বের সর্বজনীন সেই সমকামী সত্তার অবধারণা, যাকে আমরা বলতে পারি এক-প্রকারের ‘universal gay subject’। এই সর্বজনীন সমরূপী যৌন বিষয়িতার অবধারণার পক্ষান্তরে, উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতের সমসাময়িক সমকামী সত্তা-সংরচনার বয়ান-বিশ্ব আদতে বিষমরূপী বা বিষমসত্তীয়। বিশ্বায়ন এবং উত্তরাধুনিকতার যুগপৎ ফসল হিসেবে উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতে, ‘MSM’ (‘Men-having-sex-with-men’) শীর্ষক যৌনবর্গটি, ‘LGBT/Q/K’ [Lesbian-Gay-Bisexual-Transgender/Queer/Kothi] এই বর্ণালীর ক্রমিক ধারাবাহিকতায় কোতি/ধুরানি/রূপান্তরকামী শীর্ষক এই সত্তাক্রমটিকে প্রতিচ্ছেদ করে যায়। এবং, এই কোতি/ধুরানি লিঙ্গ-যৌনবর্গগুলি আদতে সাংস্কৃতিক-প্রেক্ষিত নির্ভর। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে, এই ধরনের লিঙ্গ-যৌনসত্তার সংরচনা বা অনুধাবনের পদ্ধতিও ভিন্ন ভিন্ন, যার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা বুঝতে গেলে আমাদের নৈর্ব্যক্তিক পরিসংখ্যান দেখলে শুধু চলবে না; বরং, সাংস্কৃতিক-নৃবিজ্ঞান তথা সমাজতত্ত্বের বিভিন্ন ভাষ্যও খতিয়ে দেখতে হবে। ব্যতিক্রমী যৌনবিশ্বে ‘সমকামী’ শীর্ষক শব্দটি মূলত ঊনবিংশ শতকের মনোরোগবিদ্যা, মনঃসমীক্ষণশাস্ত্র এবং মনোবৈকল্যতত্ত্ব নিরূপিত একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক নির্মাণ। এবং সমকামী চিহ্নকটিতে শুধু যে ‘গে’-সত্তার চিহ্নায়ন আছে, তা নয়; অর্থাৎ, ‘গে’ মানে সমকামী হতে পারে; কিন্তু সমকামী মানেই ‘গে’ নয়। এটাও বলতে পারি, কোতি/ধুরানি যৌনসত্তা সাধারণত স্ত্রীচিত্তায়িত (effeminate) সমকামী (অ)পুরুষ; তবে, পুরুষালি-কোতির অস্তিত্ব যে দক্ষিণ-এশিয়ার যৌনবিশ্বে নেই, এ-কথা কেউ হলফ করে বলতে পারে না। তাই, সমকামী শব্দচিহ্নকটি সমানভাবে, সমগুরুত্বে রূপান্তরকামিতা, বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার হিজড়া-বিশ্বকেও চিহ্নায়িত করে দেয়। সুতরাং রূপান্তরকামী/লিঙ্গান্তরিত যৌন-বিশ্ব বাদ দিয়ে, এই বিষমরূপী সমকামী যৌনবিশ্ব (Heterogeneous-Homosexual-World), বা সমযৌনচরাচর বোঝার চেষ্টা করলে, সেটা হয়ে যায় এক অতি-সরলীকরণ বা ‘reduction’।
দ্বিতীয়ত, উপর্যুক্ত প্রবন্ধ-সংকলনের সামাজিক নৃতত্ত্বের গবেষক অক্ষয় খন্না বিরচিত “Us ‘Sexuality Types’: A Critical Engagement with the Postcoloniality of Sexuality” শীর্ষক গবেষণাপত্র খুঁটিয়ে পড়লে জানা যায় যে উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতে, ব্যতিক্রমী যৌনতার অবভাস, বা কোনও ব্যক্তির ‘queer’ হয়ে ওঠা, শুধুই সমকাম-বিদ্বেষের ফলাফল নয়। এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, সমসাময়িক ভারতে কোনও ব্যক্তির যৌনব্যতিক্রম্যতার পিছনে নানাবিধ ঐতিহাসিক, সামাজিক, রাজনৈতিক যুক্তি বা কারণ থাকতে পারে। উপরন্তু, এই যুক্তিও দেওয়া যায়, যে কোনও সমষ্টিগত আচরণকে বিদ্বিষ্ট বলতে গেলে, তার সামাজিক প্রচ্ছদে, ‘সমকামী’ শব্দচিহ্নটির বা যৌনবর্গটির সামগ্রিক স্বীকৃতি থাকা একান্ত প্রয়োজন। অক্ষয় খন্না ওই প্রবন্ধে লিখছেন যে আমাদের চারপাশে লিঙ্গযৌনবিচ্যুতির স্বাভাবিকীকরণের মাত্রা এমনই যে, বর্তমান উত্তরাধুনিক সমাজে, সমকামী চিহ্নকটির উচ্চ/মধ্যবিত্ত শ্রেণিমননের বাইরে কোনও সামগ্রিক স্বীকৃতি নেই।
নিম্নবিত্তের অভ্যন্তরে লিঙ্গ-হিংসা হয়তো-বা থাকে; তবে, সেখানে সমকামবিদ্বেষের নিদর্শন সমমাত্রায় পাওয়া যায় না। তবে, এই বিদ্বিষ্টতা মাত্রেই বিষয়মুখী। বলা যেতে পারে যে সমকামবিদ্বেষের এই বিষয়মুখিনতা নির্ধারিত হয় দু’টি অক্ষের প্রতিচ্ছেদনে– (ক) ‘হেটেরোসেক্সিসম’ বা বিষমযৌনবাদ (খ) ‘হেটেরোনর্মেটিভিটি’ বা বিষমযৌনশৃঙ্খলা। বিষমকামিতার এই আধিপত্যবাদী পুং-তান্ত্রিক যৌনশৃঙ্খলা বা আবশ্যিক লিঙ্গ-দ্বিত্বতা নিয়ন্ত্রিত নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে লড়তে-লড়তেই সমকামী তথা সকল ব্যত্যয়ী যৌনসত্তার নির্মাণ ঘটে। এক্ষেত্রে বলতেই হয় যে পোশাক-আশাক ব্যতিক্রমী যৌনতার একটি উল্লেখযোগ্য নির্ণায়ক।
………………………………………..
বস্তুজগতে যা আমাদের কাছে দৃশ্যমান, তা না-ও হতে পারে; অর্থাৎ, হতে পারে তা অনিত্য (contingent) – এই যুক্তি মেনে মানুষের অস্তিত্ব, ভাষাবয়ান, আচরণ-বিশ্ব, জ্ঞান, সত্তা, বিষয়িতা, মন এবং সেই মনের সত্য বা মিথ্যা, সবই অনিত্য। এবং তাই সব-ই ‘অ্যাবসার্ড’। অতএব, বিশুদ্ধ মনন বা ‘pure reflection’-এ, মানবমন যেন প্রতিনিয়ত নানাবিধ জীবনসংগ্রামে যুঝতে যুঝতে অপরায়িত হয়ে চলেছে। কারণ, আধুনিক সমাজের পিতৃতান্ত্রিক ভাবাদর্শের কপটতার কবলে পড়ে আমাদের মন, অপরের সিদ্ধান্তকে নিজের বলে মনে করে। ফলে অপরায়ণ ঘটে।
………………………………………..
এই নিবন্ধে ব্যতিক্রমী লিঙ্গ-যৌনচর্যায় পোশাকের রাজনীতি বিষয়ক উপ-বয়ান নির্মাণে, শেফালী মৈত্রের ‘উজানি মেয়ে: সিমন দ্য বোভোয়ার-এর জীবন ও দর্শন’ বইয়ে উল্লিখিত সার্ত্রীয় ধারণাকল্প, বা বলা ভালো, সিমন দ্য বোভোয়ার-এর ‘অনিশ্চয়তার নীতিশাস্ত্র’-মূলক যৌক্তিক কাঠামোর পুনর্ব্যবহার করব। ব্যতিক্রমী লিঙ্গ-যৌনতার মানুষের যৌনসংস্কৃতিবিশ্বে, তাঁদের পোশাকের অস্তিবাদী মনস্তত্ত্বায়ন কীরূপে সম্ভব? প্রশ্ন এটা নয় যে কোন কোন ধরনের পোশাক-পরিধানের মাধ্যমে ব্যতিক্রমী লিঙ্গের মানুষেরা তাঁদের লিঙ্গ-পরিচিতি বহির্বিশ্বে তুলে ধরেন? বরং, অপেক্ষাকৃত বেশি প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হল– ব্যতিক্রমী/ভিন্ন যৌনতার মানুষ, বিশেষ করে পুং-সমকামী/রূপান্তরকামী-নারী/কোতি/ধুরানি গোত্রীয় মানুষ কেন তাঁদের পোশাক-ব্যবহারে, বিপরীত-লিঙ্গের ব্যতিক্রম্যতা ব্যক্ত করে, এতটা বিদ্বেষের শিকার হন? তাঁদের এই পোশাক-রাজনীতির সঙ্গে মুক্তিচেতনার কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে কি?
বস্তুজগতে যা আমাদের কাছে দৃশ্যমান, তা না-ও হতে পারে; অর্থাৎ, হতে পারে তা অনিত্য (contingent) – এই যুক্তি মেনে মানুষের অস্তিত্ব, ভাষাবয়ান, আচরণ-বিশ্ব, জ্ঞান, সত্তা, বিষয়িতা, মন এবং সেই মনের সত্য বা মিথ্যা, সবই অনিত্য। এবং তাই সব-ই ‘অ্যাবসার্ড’। অতএব, বিশুদ্ধ মনন বা ‘pure reflection’-এ, মানবমন যেন প্রতিনিয়ত নানাবিধ জীবনসংগ্রামে যুঝতে যুঝতে অপরায়িত হয়ে চলেছে। কারণ, আধুনিক সমাজের পিতৃতান্ত্রিক ভাবাদর্শের কপটতার কবলে পড়ে আমাদের মন, অপরের সিদ্ধান্তকে নিজের বলে মনে করে। ফলে অপরায়ণ ঘটে। অপরায়ণের ফলে এঁদের শরীর-ভাবনাও তাই এই মিথ্যা বিশ্বাস, বা ফরাসি চিন্তক জঁ পল্ সার্ত্রে যাকে বলেন ‘মন্দ বিশ্বাস’, তার থেকে মুক্তির স্বার্থেই একভাবে বিপরীত-লিঙ্গের পোশাক পরিধানের প্রতি ধাবিত হয়। এই বিপরীত-লিঙ্গায়িত পোশাক-রাজনীতি তাঁদের স্বতঃযৌনস্ত্রীভাবের সঙ্গে সম্পর্কিত।
………………………………
আরও পড়ুন: নামে নয়, সর্বনামে যায় আসে
………………………………..
এই গ্লানি থেকে মুক্তির পথ হল স্বনির্বাচনে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। আর তা সম্ভব শুধুমাত্র একধরনের শব্দ-রাজনৈতিকতার মাধ্যমে, যার দ্বারা লেখক, সমাজ ও সাহিত্যভুবনের মধ্যে একপ্রকার দ্বান্দ্বিক সেতু নির্মাণ সম্ভব। ব্যতিক্রমী লিঙ্গ-যৌনতার মানুষেরা তাই জৈবিক লিঙ্গপরিচয়-মাফিক পোশাক-আশাক না পরে, বিপরীত-লিঙ্গায়িত পোশাক-পরিধানের মধ্য দিয়ে প্রথাসিদ্ধ লিঙ্গাদর্শের বিরুদ্ধাচারণ করে থাকেন। অতএব, অপর ব্যক্তি আমাকে যেভাবে দেখে বা আমার দিকে যেভাবে তাকায়, সেই ‘দৃষ্টি’র পিতৃতান্ত্রিক একাধিপত্যকে খারিজ করে, আমি যদি ভাবি যে এই মর্মে অপরের চাপিয়ে দেওয়া জীবন-শর্ত নাকচ করলাম, বা অপরের চাপিয়ে দেওয়া অর্থ বাতিল করে, জগতের ওপর অন্য অর্থ আরোপ করব, তাহলেই বোধহয় অপবিশ্বাসের কবল থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে।
যখন আমরা, তথা সকল ব্যতিক্রমী লিঙ্গ-যৌনমানস ঠিক করব কোন ধরনের স্বাধীন সিদ্ধান্ত আমরা নেব, কিংবা জড়বৎ বাঁচা থেকে নিজেদের বের করে নিয়ে এসে, অপরের সিদ্ধান্তকে নিজের বলে প্রচার করা বন্ধ করব, তখন-ই আমাদের এই জড়বৎ অস্তিত্ব, অপরের শর্তে তৈরি করা জগৎ থেকে মুক্ত হয়ে, স্ব-শর্তাধীন-জীববৎ-অস্তিত্বে, বা সার্ত্রীয় ‘বিয়িং-ফর-ইটসেল্ফ’-এ পর্যবসিত হবে। এই মর্মে তাই কেন সমকামী/রূপান্তরকামী/কোতি/ হিজড়া বর্গীয় মানুষেরা, অর্থাৎ, মেয়েলি-ছেলেরা, মেয়েলি পোশাক পরেন এবং মদ্দা-মেয়েরা পুরুষালি পোশাক পরে স্ব-লিঙ্গপরিচিতি ব্যক্ত করেন, সেই প্রসঙ্গেও একটি অস্তিবাদী ব্যাখ্যা নির্মাণ সম্ভব।
প্রতিবেদনটি, কলকাতাকে সমকাম-বিদ্বেষের পরাকাষ্ঠা হিসেবে দাগিয়ে দিল ঠিকই; তবে, নগরায়নের ইতিহাস দেখলে, কলকাতা, গত শতকের নয়ের দশক থেকেই; অর্থাৎ, উত্তর-গঠনবাদের ঢেউ ওঠার অব্যবহিত পর থেকেই, একদিকে যেমন বিদ্যায়তনিক, প্রাতিষ্ঠানিক স্তরে; তেমনি অন্যদিকে সমাজকর্মের মধ্যস্থতায় নারীবাদচর্চা এগিয়ে নিয়ে গেছে। খোদ এই কলকাতাতে ঢের সমকামী বিচরণ-চর দিব্য বিদ্যমান।
তাই, আবারও সার্ত্রীয় ‘ontology of gaze’-এর ধারণাকল্প অনুসরণ করে, বিদ্বিষ্টতার কারণ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করব। সার্ত্রীয় তত্ত্বপ্রস্থান অনুযায়ী ‘অপর’-কে আমি কীভাবে দেখছি, তা বহুলাংশেই নির্ভর করে অপর ব্যক্তিটি আমাকে কীভাবে দেখছে, তার ওপর। বিষম-পিতৃতান্ত্রিক জাঁতাকলে পুরুষালি যৌন কর্তৃত্বের কাছে, LGBT/Q/K সত্তা অপরায়িত হয়, কারণ LGBT/Q/K সত্তাবিশ্ব সর্বদাই আবশ্যিক বিষমকামিতার লেন্সে মার্কামারা; শৃঙ্খলার এই ব্যত্যয় তাঁদের জীবনে হিংসা এবং বিদ্বেষের জন্ম দিয়ে থাকে। তাই, এর উল্টোদিকের ভাষ্য তৈরিও দরকার হয়ে পড়ে, যাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর উত্তরাধুনিক চিন্তায় বলা হয়ে থাকে এক-প্রকার ‘রিভার্স ডিসকোর্স’ বা প্রতিবয়ান। সুতরাং এটাই বলব যে, কোনও নৈর্ব্যক্তিক পরিসংখ্যানের ওপর নির্ভরতার বদলে, সমকাম-বিদ্বেষের কারণ-বিশ্লেষণে যদি এই উত্তরাধুনিক, উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতের তামাম লিঙ্গবর্গীয় অভেদ (identity) এবং কামবাসনার চরিত্রের পর্দা তোলার চেষ্টা করা যায়, তবেই বোধহয় আমরা এই বিদ্বেষের মূলে কিছুটা পৌঁছতে পারব।
আবার বর্তমানে ফিরে আসি; সম্প্রতি আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জিতেছে। তাই এক-কথা নেহাতই দ্বিরুক্তি যে দক্ষিণপন্থী আগ্রাসনের প্রাথমিক হাতিয়ার, পারমাণবিক ধ্বংসের খাঁড়া সারাক্ষণ সবার সামনে ঝুলছে। যে কোনও মুহূর্তেই গোটা মানবজগতের সমবেত সামগ্রিক প্রস্থান সম্ভব। এই বৈশ্বিক মরণেষণার থেকে যৌন বা অযৌন কারও রেহাই নেই। তাই আজকের ‘eros’ বা রতি-কে বুঝতে গেলে, সমকামবিদ্বেষের পরিস্থিতিকে বুঝতে গেলে, ‘globalized thanatos’ বা বিশ্বায়িত মরণেষণার উল্লেখ না করে উপায় নেই। তাই এই মর্মে এই নিবন্ধ শেষ করি, সাহিত্যিক শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়ের ২০০৭-এ প্রকাশিত ‘Approaching the Present: Pre-text: The Fire Controversy’ শীর্ষক প্রবন্ধের জের টেনে যা আজও প্রাসঙ্গিক। শিবাজী এই দীর্ঘ প্রবন্ধে ক্ষেদোক্তি করেছিলেন যে, ‘আমরা প্রতিনিয়ত ক্রমশ-প্রতীয়মান এক ত্রাসের রাজত্বে বাস করছি; যেন-বা অসহায়ভাবে কোনো এক গভীর বিপর্যয়; কোনো এক অপূরণীয় ক্ষতির আশঙ্কায় সদাই তটস্থ আমরা। এই বৈশ্বিক মরণেষণার মধ্যস্থতায় যেন আমরা প্রতিনিয়ত শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ে চলেছি; এই মৃত্যু-এষণার বিশ্বায়িত সমবায়ের ভিতর দিয়েই যেন-বা মানুষ, মৃত্যুকে, তার কালানুক্রমিক সময়ানুবর্তিতার বদলে, আবিষ্কার করছে এক স্থানানুক্রমিক আকস্মিকতায় যার প্রকোপে ক্রমশ বদলে যাচ্ছে অস্তিত্ব এবং শূন্যময়তার অনুপাত; সূচিত হচ্ছে অস্তিবাদী পরিকল্পে এক সামগ্রিক পটপরিবর্তন’।