বিভ্রান্ত করতেই একথা বলেছিলেন বিনয় মজুমদার। এক ফর্মার চটি বই ‘গায়ত্রীকে’-এর পরিবর্ধিত সংস্করণ ছিল ‘ফিরে এসো চাকা’। সেপ্টেম্বর, ১৯৬২। কবিতার সামান্য বদল ঘটিয়ে, কিছু কবিতা যোগ করে একটা পাণ্ডুলিপি বানিয়েছিলেন বিনয়। সুন্দর হস্তাক্ষরে রেক্সিনে বাঁধাই ডায়েরিতে কালো কালিতে লেখা পাণ্ডুলিপি। ডায়েরির ওপর ডিজাইন করা, তার ওপর কালো কাগজ কেটে লেখা ‘গায়ত্রীকে’।
শিবপুর বি. ই. কলেজের শতবার্ষিকী স্মরণিকা (১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দ) দেখাশোনা আর প্রকাশের দায়িত্ব পড়েছিল ‘গ্রন্থজগৎ’ প্রকাশনার কর্ণধার দেবকুমার বসু-র ওপর। এই কাজে সহায়তার জন্য তিনি কর্তৃপক্ষের কাছে দু’-তিনজন ছাত্রকে পাঠাতে অনুরোধ করেছিলেন। কর্তৃপক্ষ যে তিনজন ছাত্রকে পাঠিয়েছিলেন তাঁদেরই একজন বিনয় মজুমদার।
‘গ্রন্থজগৎ’-এ তখন সংস্কৃতি জগতের দিকপালদের আনাগোনা। প্রকাশ পাচ্ছে ‘মধুবংশীর গলি’ বা আরও অনেকের কাব্যগ্রন্থ। বি. ই. কলেজের ছাত্র তিনজন সপ্তাহে দু’-তিন দিন আসতেন। লেখা এনে দেওয়া, স্মরণিকা সাজানো এগুলো ছিল তাঁদের দায়িত্ব। স্মরণিকা প্রকাশ পেয়ে গেলে ছাত্রদের আর আসার প্রয়োজনীয়তা রইল না। এইরকম সময়ে একদিন একজন ছাত্র, বিনয় মজুমদার, প্রকাশনার কর্ণধারকে সসংকোচে জানালেন যে, তিনিও অল্প বিস্তর কবিতা লেখেন, প্রকাশককে একবার সেগুলো পড়াতে চান। সম্মতি পেতে নিয়ে এলেন একটি খাতা সেখানে যত্ন করে লেখা কিছু কবিতা। সেদিনের তরুণ প্রকাশক সেই খাতার থেকে বেছে একটি দুই ফর্মার বই করলেন মোট ১৪টা কবিতা নিয়ে। বইয়ের নাম ‘নক্ষত্রের আলোয়’। দেড় ফর্মার বই কিন্তু বোর্ড বাঁধাই। প্রচ্ছদ দেবব্রত মুখোপাধ্যায়, দাম এক টাকা। প্রায় সব কবিতাতেই অন্তমিল রয়েছে। সেই সময় বাংলা কবিতা যে ভাবে লেখা হত সেভাবেই লেখা। বইটির প্রকাশ তারিখ আশ্বিন ১৩৬৫, অর্থাৎ অক্টোবর ১৯৫৮। এর পরের বই প্রকাশ পেল বছর দুয়েক পরে। এক ফর্মার চটি বই ‘গায়ত্রীকে’, যার পরিবর্ধিত সংস্করণ বাংলা কবিতার এক যুগোত্তীর্ণ বই ‘ফিরে এসো চাকা’। তিন ফর্মার বই, প্রকাশ সেপ্ঢেম্বর ১৯৬২। এর পরেও আরও কিছু পরিমার্জনা করে, কিছু কবিতার সামান্য বদল ঘটিয়ে, কিছু কবিতা যোগ করে একটা পাণ্ডুলিপি বানিয়েছিলেন বিনয়। সুন্দর হস্তাক্ষরে রেক্সিনে বাঁধাই ডায়েরিতে কালো কালিতে লেখা পাণ্ডুলিপি। ডায়েরির ওপর ডিজাইন করা, তার ওপর কালো কাগজ কেটে লেখা গায়ত্রীকে। এই ডায়েরিটি প্রকাশ পায়নি কিছুদিন আগে অবধি। ২০১৮-’১৯ সাল নাগাদ এটি নজরে আসে পুরনো বই পরিষ্কার করতে গিয়ে। ‘যাপনচিত্র’ এই ডায়েরিটির ফ্যাক্সিমিলি সংস্করণ প্রকাশ করে মোস্তাক আহমেদের সম্পাদনায়। আসলে ‘গ্রন্থজগৎ’ কোনও এক কারণে অভিমানবশত বন্ধ করে দিয়েছিলেন প্রকাশক। কিন্তু বেছে বেছে কিছু বই বাড়িতে রেখেছিলেন। বিনয়ের বইগুলো এর মধ্যে ছিল। ‘গায়ত্রীকে’ নামাঙ্কিত ডায়েরিটি পাওয়ার বছর দুয়েক পর আমারই বইয়ের স্তূপ থেকে আরও একটা ডায়েরি উদ্ধার হয়, লাল কাপড়ে জড়ানো বইয়ের মধ্যে ছিল। আগেও চোখে পড়েছে কিন্তু খুলে দেখিনি। খোলার পর দেখলাম বিনয়ের ডায়েরি। একসময় Soor’s diary খুব জনপ্রিয় ছিল। সেই ডায়েরিতে লিখতেন বিনয়। ডায়েরির একদিকে অ্যালজেব্রা করা অন্যদিকে কবিতা। পুরো ডায়েরির বেশিরভাগটাই এরকম। কয়েকটা পাতা টানা অ্যালজেব্রা করা। কবিতাতেও প্রচুর কাটাকাটি। শব্দ কেটে, কখনও বা লাইন কেটে অন্য শব্দ বা লাইন বসানো। কোথাও বা কোনও পত্রিকার নামোল্লেখ। অর্থাৎ, সেই পত্রিকায় লেখা পাঠানো হয়েছে৷ কখনও তারিখ উল্লেখও রয়েছে। কোনও কোনও পাতায় শুধুই হিজিবিজি কাটা। ডায়েরির ভিতরে একগুচ্ছ চিঠি। বিনয়ের বাবার লেখা, দাদার লেখা। তিনটে পোস্টকার্ড শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের লেখা।
বিনয় মজুমদারের প্রথম চার-পাঁচটা বইয়ের প্রকাশক ‘গ্রন্থজগৎ’ প্রকাশনার দেবকুমার বসু। একসময় বিনয়ের মনে হয় অন্য প্রকাশনী থেকেও বই প্রকাশিত হওয়া উচিত। কিন্তু প্রকাশ করবে কে? নানা কারণে বিনয়ের অস্বাভাবিক ব্যবহার তখন সকলের চোখে পড়ছে। ফলে বিনয় ঠিক করলেন নিজেই একটা নাম দিয়ে প্রকাশনী করবেন। ‘ব্যক্তিগত প্রকাশনী’ নাম দিয়ে নিজের বই প্রকাশ করবে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। কিন্তু ঠিকানা কী হবে? বিনয়ের তখন কোনও স্থায়ী ঠিকানা নেই। কলকাতায় একটা মেস বাড়িতে থাকেন। দিনের বেলায় সারাক্ষণই কাটে ‘গ্রন্থজগৎ’ দপ্তর অথবা কফিহাউসে। দেবকুমার বসুকে অনুরোধ করলেন তিনি যদি ঠিকানাটা ব্যবহার করতে দেন। ফলে বিনয়ের ‘ঈশ্বরী’ বইটি প্রকাশ পেল ‘ব্যক্তিগত প্রকাশনী’ নাম নিয়ে কিন্তু ঠিকানা রইল ‘গ্রন্থজগৎ’-এর দপ্তর। সব দেখাশোনাও করে দিলেন দেবকুমার। এই পর্বে কলকাতায় বিনয়ের চিঠিপত্রও আসত গ্রন্থজগতের ঠিকানায়, ব্যক্তিগত অনেক কিছু রাখাও থাকত ওখানে। ‘গ্রন্থজগৎ’ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর অনেক কিছুর সঙ্গে এই ডায়েরিটিও বাড়িতে আসে।
কীরকমভাবে কবিতা পরিমার্জনা করতেন বিনয়? একটি কবিতার প্রথম পঙ্ক্তিটি লিখেছেন, ‘কোনো সফলতা নয়, বৃক্ষগুলি অপেক্ষায় আছে’। পরে পঙ্ক্তিটি কেটে করা হয়েছে, ‘কোনো সফলতা নয়, আকাশের কৃপাপ্রার্থী তরু’। কবিতাটির কোনও নাম নেই৷ উপরে লেখা আছে ‘দেশ’। অর্থাৎ এটি ‘দেশ’ পত্রিকায় পাঠানো হয়েছিল। অথবা বিনয়ের বহু পঠিত কবিতা ‘ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?’ এর তৃতীয় ও চতুর্থ পঙ্ক্তি যা বইতে রয়েছে, ‘হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।/এ আমার অভিজ্ঞতা। পারাবতগুলি জ্যোৎস্নায়’। ডায়েরিতে প্রথমে এই পঙ্ক্তি দু’টি লেখা হয়েছিল এইভাবে, ‘হাসি, জ্যোৎস্না, ভালোবাসা, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না। /এ আমার অভিজ্ঞতা। ডানার বাতাসে কৃষ্ণাভ’। এরকম কাটাকুটি, নতুন পঙ্ক্তি বা শব্দ আরও অনেক কবিতাতেই রয়েছে। ডায়েরির নানা জায়গায় বহুবার করে ‘মিনু’ নামটি লেখা। মিনু কোনও মেয়ের নাম, হয়তো তার আবির্ভাব হয়েছিল কবির জীবনে।
বিনয়ের ডাক নাম ছিল ‘টু’। ওঁর বাবাও চিঠিতে ওঁকে ‘টু’ বলেই সম্বোধন করেছেন। সব চিঠিতেই পিতৃস্নেহ ও উদ্বিগ্নতার ছোঁয়া। পিতার চিঠি সবই শিমুলপুর থেকে লেখা। বিনয় তখন দুর্গাপুরে চাকরিরত, মাইনে ৩২৫ টাকা। চিঠির তারিখ ৯.৬.৬২। বিনয়ের বাবা লিখছেন, ‘আমার ইচ্ছে তোর ট্রেনিং শেষ হলেই তোকে বিয়ে দেব। ৩২৫ টাকায় তোর চলে যাবে। তখন শান্তিতে থাকতে পারবি।’ চাকরিতে মন বসছিল না বিনয়ের। বারবার কলকাতা চলে আসতে চাইছিলেন। চাকরির দরখাস্ত করছিলেন নানা জায়গায়। জ্ঞানচন্দ্র পলিটেকনিকে পড়ানোর দরখাস্তও করেছিলেন। কিন্তু কোথাও থেকে সদুত্তর না পেয়ে ঠিক করেছিলেন চাকরি ছেড়েই চলে আসবেন। এই সময় আমরা কবি শক্তির লেখা চিঠিতে পাই (২৯.৮.৬২), শক্তি লিখছেন, ‘হঠাৎ চাকরি ছেড়ো না যেন। শেষ পর্যন্ত দেখ চাকরি যদি সত্যিই খুব কষ্ট করে করতে হয়, তবে ছেড়ে দেওয়াই ভালো হবে।’
কিন্তু বিনয়ের কীসের এত অস্থিরতা যা আরও বছর দুয়েক পর উন্মাদনায় পরিবর্তিত হবে? জনৈক সলিল চক্রবর্তীর একটা চিঠিতে গায়ত্রীর প্রসঙ্গও এসেছে। ২১.৭.৬২ সালের চিঠিতে তিনি লিখছেন, ‘গায়ত্রী আমেরিকা চলে গেছে। ওর সম্বন্ধে কৌতূহল না থাকাই ভালো।’
এই গায়ত্রীর সঙ্গে বিনয়ের কিন্তু বার দুয়েক দেখা হয়েছে, তাও সৌজন্য সাক্ষাৎ। কোনও একভাবে এই গায়ত্রী তাঁর কল্পরাজ্যে মায়া বিস্তার করছেন। তাঁর ভালো লাগছে। পরবর্তী সময় এই গায়ত্রী নিয়ে বলতে গিয়ে পাঠককে বিভ্রান্ত করেছেন এই বলে যে, এই গায়ত্রী হিন্দু হস্টেলের সুপার জনার্দন চক্রবর্তীর কন্যা। কিন্তু জনার্দন চক্রবর্তীর আদতে কোনও কন্যাই ছিল না।
বিনয় সম্পর্কে নানা রহস্য সবসময় থাকবে। কিন্তু যে কবিতার জন্য বিনয় বাংলা সাহিত্যে স্তম্ভ, সেই বিচ্ছুরণ ’৬৪ সাল অবধিই। পরবর্তী বিনয় তার ছায়া মাত্র।