‘রবিকাকা’র লেখা ‘জীবনস্মৃতি’-র ছবি গগনেন্দ্রনাথের জীবনে অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট। এই চিত্রমালায় তিনি যেন উজাড় করে দিলেন জাপানি শিল্পীদের ছবি আঁকার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। গগনেন্দ্রনাথ কালি-তুলির মায়াবী আঁচড়ে রচনা করে চলেছিলেন আলো-অন্ধকারে জড়ানো জোড়াসাঁকোর রূপকথা। সে হয়ে উঠেছে চিত্রিত অক্ষরমালা, ‘জীবনস্মৃতি’র প্যারালাল টেক্সট।
ভাবতে অবাক লাগে, দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রী গগনেন্দ্রনাথ প্রথম দিকে ছবি আঁকার প্রতি আকর্ষণ অনুভব করেননি। এদিকে ছোট ভাই অবনীন্দ্রনাথ সেই পর্বে রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। কিন্তু গগনের আগ্রহ তখন নাটক, মঞ্চসজ্জা আর ফোটোগ্রাফির দিকে। ফোটোগ্রাফি যে সেই সময়ে রীতিমতো আধুনিক শিল্পমাধ্যম– তা আমাদের অজানা নয়। তবে জোড়াসাঁকো বাড়ির কোনও নাটক গগনেন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে ভাবাই যেত না! পরবর্তী ‘ডাকঘর’, ‘ফাল্গুনী’ থেকে ‘রক্তকরবী’ পর্যন্ত তাঁর মঞ্চ-পরিকল্পনার খবর আমাদের জানা। শুধু কি তাই, পোশাক-পরিচ্ছদ নিয়েও তাঁর নানারকম ভাবনা। তা নিয়ে রীতিমতো পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতেন। জাপানি ‘কিমোনো’ আর তিব্বতি ‘বোকু’-কে মিলিয়ে রবীন্দ্রনাথের যে বিখ্যাত জোব্বা, সে পরিকল্পনা গগনের। অবন-গগন নিজেরাও পরতেন সেই পোশাক।
এখানে একটা গল্প না বললেই নয়। গগনেন্দ্রনাথের মেয়ের বিয়ে, বিয়ের আসরে সেজেগুজে কনেকে ভারি চমৎকার দেখাচ্ছে! পিতা যখন কন্যা সম্প্রদান করতে উদ্যত, সেই সময় বেঁকে বসলেন পাত্রপক্ষের কর্তা। বললেন, এ মেয়ের সম্প্রদান হতে পারে না। কারণ, কনের পরিধানের পোশাক নাকি সেলাই করা। আর তখনকার দিনে সেলাই করা কাপড়, অর্থাৎ বিয়ের কনে জামা পরলে সে মেয়ে সম্প্রদানযোগ্য নয়। বরপক্ষের কথায় চমকে উঠলেন বিয়েবাড়ির সকলে! অবশেষে গগনেন্দ্রনাথ বোঝালেন, আড়ালে নিয়ে গিয়ে দেখানো হল মেয়ের গায়ে সেলাই করা কোনও কাপড় নেই। তারপর সম্পন্ন হল শুভকাজ। বিয়ের কনেকে এমন করে শাড়ি পরানো হয়েছিল যে, দেখে বোঝাই যাচ্ছিল না– সে একবস্ত্রা। এই পোশাকের পরিকল্পক ছিলেন স্বয়ং গগনেন্দ্রনাথ। ভেবে দেখলে মনে হয়, গগন ঠাকুর আমাদের দেশের প্রথম আধুনিক কস্টিউম ডিজাইনার। শেষ এখানেই নয়, লর্ড কারমাইকেলের সহায়তায় তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘বেঙ্গল হোম ইন্ডাস্ট্রিস’। বাংলার কারুশিল্প, মুর্শিদাবাদের রেশমি কাপড়ের পুনরুজ্জীবন ওঁর হাত ধরেই। আবার স্বদেশি যুগের হাওয়ায় বিলেতি নকশার ফার্নিচার ফেলে দিয়ে দেশি ঢঙের আসবাবপত্র রচনাতেও গগনেন্দ্রনাথ ‘একমেব দ্বিতীয়ম’।
এমন অভিনব শিল্পভাবনার মানুষটি প্রত্যক্ষভাবে ছবি আঁকতেন না বটে, তবে দেখার চোখ ছিল তীক্ষ্ণ– সেই সঙ্গে এক গভীর সংবেদী শিল্পবোধ। সর্বদা তাঁর শিল্পীমন পূর্ণ হয়ে উঠেছে বিচিত্র অভিজ্ঞতায়। বিদেশ থেকে তেলরঙের ছবির পাঠ নিয়ে সদ্য দেশে ফিরেছেন শশী হেশ। জোড়াসাঁকোয় আঁকছেন মহর্ষির দীর্ঘ প্রতিকৃতি, তার প্রত্যক্ষদর্শী গগনেন্দ্রনাথ। কিছুকাল পরেই ১৯০২ নাগাদ জাপানি মনীষী ও চিন্তক কাকুজো ওকাকুরা এলেন জোড়াসাঁকোতে। দেশে ফিরে পাঠালেন টাইকান আর হিশিদা সুনশো নামের দুই শিল্পীকে, তাঁদের আতিথ্য দিয়েছেন গগনেন্দ্রনাথ। সেই জাপানি শিল্পীরা এসেছিলেন কালি-তুলির কাজ শেখাতে। রথী ঠাকুর তাঁর ‘পিতৃস্মৃতি’-তে লিখেছেন, সে ছিল নাকি দেখার মতো ব্যাপার। ছবি আঁকার সময় শিল্পীদের তুলির ক্ষিপ্র আঁচড় দেখতে ‘সমস্ত বাড়ির লোক ভেঙে পড়ত’। যদিও গগনের ছবিতে জাপানি কালি-তুলির প্রত্যক্ষ প্রেরণা প্রকাশ পেতে আরও কিছুটা সময় লেগেছিল। ইতিমধ্যে তাঁর জীবনে নেমে এসেছে পুত্রশোকের নির্মম আঘাত। শখ করে কিশোর বয়সেই বড় ছেলে গেহেন্দ্রনাথের বিবাহ দিয়েছিলেন, এক বছরের মধ্যেই টাইফয়েড রোগে মৃত্যু হল পুত্রের। শোকে কাতর গগনেন্দ্রনাথ এমন আকুল হয়ে পড়লেন যে, কিছুতেই নিজেকে স্থির রাখতে পারেন না। এমত অবস্থায় সন্ধ্যায় আয়োজিত জোড়াসাঁকো বাড়ির কথকতা ও কীর্তনের আসর হয়ে উঠেছিল তাঁর নিবিড় শোকের একান্ত সান্ত্বনা। তন্ময় হয়ে কথক ঠাকুর ক্ষেত্র চূড়ামণির কথা শুনতে শুনতে একদিন কি এক অদৃশ্য টানে হাতে তুলে নিলেন কাগজ-পেনসিল। আসরে বসেই শুরু হল কথক ঠাকুরের ছবি আঁকা। অন্তরের দুঃসহ বেদনা যেন রেখার মধ্য দিয়ে প্রকাশের পথ করে নিতে চাইল। ক্রমে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে কুষ্ঠিয়া থেকে আসা নধরকান্তি শিবু কীর্তনিয়াও ধরা দিল গগনের খাতার পাতায়। ক্রমশ রেখা আর আকারের প্রতি আগ্রহ বেড়ে চলল। ধীরে ধীরে ঠাকুরবাড়ির কর্মচারীদের ছবি থেকে জোড়াসাঁকোয় আগত বন্ধু-পরিজনের প্রতিকৃতি ফুটে উঠতে লাগল তাঁর চিত্রপটে। তবে সে কোনও যশের আকাঙ্ক্ষায় নয়, একেবারে ভেতরের তাগিদ থেকে। শোনা যায়, তাঁকে কেউ কখনও আলস্য ভরে বসে থাকতে দেখেনি, সারাক্ষণ আপনমনে কিছু না কিছু এঁকে চলেছেন।
সকালবেলা বারান্দায় বসে তাঁর প্রাতরাশের পর্ব চলে। সেই সময়ে বারান্দার রেলিংয়ে কার্নিশে ভিড় করে আসে কাকের দল। তিনিও তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করেন তাদের। ক্রমে কালি-তুলিতে রচিত হয় কাকের সিরিজ। ভাবলে অবাক লাগে, অবনীন্দ্রনাথ ও তাঁর শিষ্যগণ যখন বাংলা কলমের চিত্রকলায় দেবদেবী আর পুরাণ-কল্পনায় মেতে উঠেছেন, তখন গগনেন্দ্রনাথের ছবি উঠে আসছে প্রতিদিনের নিখাদ আটপৌরে জীবন থেকে। কাব্যিক আতিশয্য ছাড়িয়ে ছবির বিষয় হয়ে উঠছে তথাকথিত হতশ্রী প্রান্তিক পাখির দল। যা আজ আধুনিকতার লেবেল-সাঁটা শিল্পীদের ভাবনার সমান্তরাল। তবে ‘রবিকাকা’র লেখা ‘জীবনস্মৃতি’-র ছবি গগনেন্দ্রনাথের জীবনে অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট। এই চিত্রমালায় তিনি যেন উজাড় করে দিলেন জাপানি শিল্পীদের ছবি আঁকার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা। অবনীন্দ্রনাথ যখন আয়ত্ত করছেন জাপানি ওয়াশ টেকনিকের গভীর কৌশল। গগনেন্দ্রনাথ তখন কালি-তুলির মায়াবী আঁচড়ে রচনা করে চলেছেন আলো-অন্ধকারে জড়ানো জোড়াসাঁকোর রূপকথা। সে হয়ে উঠছে চিত্রিত অক্ষরমালা, ‘জীবনস্মৃতি’র প্যারালাল টেক্সট। আবার কিছুদিন পরেই গগনেন্দ্রনাথ সরে যাবেন জ্যামিতিক আকারের ঘন বিন্যাসে, যাকে স্টেলা ক্রামরিশ তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলবেন ‘দ্য ফার্স্ট ইন্ডিয়ান কিউবিস্ট’। এদিকে তাঁর গায়ে ‘কিউবিস্ট’ তকমার অ্যালার্জিতে আক্রান্ত দেশীয় সমালোচকদের পরোয়া না-করে গগনেন্দ্রনাথ চিঠিতে জানাবেন, ‘I am practicing Cubism…’.
এভাবেই কি তিনি নির্মাণ করেছেন পূর্ব আর পশ্চিমের এক আশ্চর্য সেতু? ভাবতে ইচ্ছে করে, শিক্ষক হিসেবে দিকনির্দেশক কেমন ছিলেন তিনি? উত্তরে একটা গল্প দিয়ে শেষ করি। নন্দলালের নির্দেশে ছাত্র বিনোদবিহারী কলকাতায় গিয়েছেন গুরু অবনীন্দ্রনাথকে ছবি দেখাতে। মেজাজি অবনীন্দ্রনাথ কঠিন স্বরে বিনোদকে বুকুনি দিচ্ছেন, ‘রং অত্যন্ত নোংরা’, ‘এই সাঁওতাল ছেলে বাঁশি বাজাচ্ছে না কলা খাচ্ছে’, ‘ছবি নিয়ে যাও’ ইত্যাদি। বিনোদবিহারী সংকুচিত বিব্রত অপ্রস্তুত। কাছেই বসে ছবি আঁকছিলেন গগনেন্দ্রনাথ। বিনোদের ছবি ভালো করে দেখে কিছুটা ধমকের সুরেই ভাইকে বললেন, ‘অবন, সবাই যদি ঠিক তোমার মতো ছবি করে, তাহলে নতুন ছবি হবে কবে?’ শিল্পী গগনেন্দ্রনাথকে বুঝতে এই একটি বাক্যই কি যথেষ্ট নয়!
এ দেশে প্রসূতিসদন থেকে নবজাত শিশু ও প্রসূতিকে ছেড়ে দেওয়ার পরও স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে বেশ কয়েক মাস ধরে নিয়মিত একজন চিকিৎসক বাড়িতে এসে তাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে যান। এটা ছিল এখানকার জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি অপরিহার্য অঙ্গ।