কে এই ভদ্রলোক! এই মাপের এক অভিনেতা! এই রেঞ্জ! তাঁর বলা সংলাপ– ‘এটা আমার’ কিংবা ‘তং মত্ করো’– আপামোর বাঙালির সংলাপ হয়ে গিয়েছে। কিছু হারিয়ে গেলে, হঠাৎ ফিরে পেলে, ‘এটা আমার’ এই কথাটাই, সন্তোষ দত্তর ভঙ্গিতেই যেন বেরিয়ে আসে। সংলাপ প্রক্ষেপণ কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে, তা প্রমাণিত ওই জবানিতে। বড় মাপের অভিনেতা না হলে সংলাপ ‘কিংবদন্তি’র স্তরে পৌঁছতে পারে না। তিনি এ জিনিস অনায়াসেই করতে পেরেছেন।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
১৯৮০ সালের মাঝামাঝি। তখন অল্পসল্প কাজ শুরু করেছি। গিয়েছি টেকনিশিয়ান স্টুডিওতে। একটা শুটিং দেখতে। সেই শুটিংয়েই সন্তোষ দত্তকে প্রথম চাক্ষুষ দেখা। সেখানে সে সময়ের আরও দু’-তিনজন তাবড় তাবড় অভিনেতা রয়েছেন। একজন বিখ্যাত কৌতুকাভিনেতার সঙ্গে সন্তোষ দত্তর একটি দৃশ্যের রিহার্সাল চলছে। একটা ঘরের মধ্যে সন্তোষ দত্ত ঢুকবেন, ধুতি-পাঞ্জাবি পরা পুরোদস্তুর বাঙালি চেহারায়, আর সহ-অভিনেতা যিনি, তিনি ‘আসুন, আসুন’ বলে আপ্যায়ন করবেন। সন্তোষ দত্তকে বসাবেন একটি চেয়ারে। পিছনে সেই সহ-অভিনেতা, সামনের চেয়ারে সন্তোষ দত্ত, সংলাপ বলবেন। তখন ডিজিটাল যুগ নয় যেহেতু, পাকা অভিনেতাদের জন্যও এক-দু’বার অন্তত রিহার্সাল করে দেখে নেওয়া হত, সব ঠিকঠাক লাগছে কি না। মনে আছে, এই দৃশ্যের রিহার্সাল হয়েছিল দু’বার।
শট টেক করা হচ্ছে। আমি দেখলাম, সন্তোষ দত্ত ঢুকলেন ঘরে, সহ-অভিনেতা তাঁকে ‘আসুন আসুন’ বলে স্বাগত জানালেন, চেয়ারে বসালেন। সংলাপ বলতে যাচ্ছেন, এমন সময় সেই সহ-অভিনেতা পকেট থেকে একটা ছোট চিরুনি বের করলেন। তারপর সন্তোষ দত্তর চুল আঁচড়াতে থাকলেন। সন্তোষ দত্তর টাকমাথা, সে মাথায় চুল আঁচড়ালে হাসির উদ্রেক তো হবেই। বোঝাই যাচ্ছে, চমৎকার একটা হাসির দৃশ্য তৈরি হচ্ছে। কিন্তু এই সময় বাগড়া দিলেন স্বয়ং সন্তোষ দত্তই। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘কাট্ কাট্!’ সেই বিখ্যাত কৌতুকাভিনেতার নাম ধরে বললেন, ‘এটা কী করছেন? সিনটা করতে দিলেন না? কেটে দিলেন?’
এই মুহূর্তে সদ্য পেশাদার অভিনয়জীবনে পা রাখা আমি, স্পষ্টতই বুঝতে পারলাম, সন্তোষ দত্ত আসলে আদ্যন্ত এক সিরিয়াস ডিসিপ্লিনড অভিনেতা। ওঁর বক্তব্য ছিল, যদি রিহার্সালে এই জিনিসটা করতেন, তাহলে আমি ব্যাপারটাকে গ্রহণ করতে পারতাম। টাকে চিরুনি চালানোর ক্রিয়ায় অভিনেতা হিসেবে কিছু প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারতাম, কিন্তু যা রিহার্সালে করা হয়নি, তা ফাইনালে কেন?
এই যে শৃঙ্খলা, তা একেবারেই ওঁর নাটকের যাপন থেকে উঠে আসা। হতেই পারত, সন্তোষ দত্ত এই দৃশ্যটায় নিজের মতো করে প্রতিক্রিয়া দেখালেন, তা সম্ভবও ছিল, কিন্তু নাটকের শৃঙ্খলাই তাঁকে এটা করতে দিল না। এটা শিক্ষণীয় এক অভিজ্ঞতা হিসেবে থেকে গিয়েছে আমার মনে– সন্তোষ দত্তর মাস্টার-ক্লাস।
আমার দুঃখের তালিকায় অনেকটা উপরের দিকেই থাকবে সন্তোষ দত্তর মঞ্চাভিনয় না-দেখা। তাঁর অসামান্য মঞ্চাভিনয়ের কথা যদিও শুনেছি বহুবারই। ‘চলচ্চিত্তচঞ্চরী’ নাটকে ভবদুলালের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করতেন তিনি, সত্যজিৎ রায় সম্ভবত সেই অভিনয় দেখেই তাঁকে ছবির জন্য ভাবেন। আমার চরম দুর্ভাগ্য, না-মঞ্চে না-ফিল্মে– ওঁর সঙ্গে একবারও কাজ না করা। ব্যক্তিগত পরিচয় তৈরি হয়নি। কিন্তু যেটুকু চেনা, তা পর্দায়, ওঁর কাজ দিয়েই।
‘সোনার কেল্লা’য় জটায়ু দেখেই আমি প্রথম হতচকিত হয়ে পড়েছিলাম। কে এই ভদ্রলোক! এই মাপের এক অভিনেতা! এই রেঞ্জ! তাঁর বলা সংলাপ– ‘এটা আমার’ কিংবা ‘তং মত্ করো’– আপামর বাঙালির সংলাপ হয়ে গিয়েছে। কিছু হারিয়ে গেলে, হঠাৎ ফিরে পেলে, ‘এটা আমার’ এই কথাটাই, সন্তোষ দত্তর ভঙ্গিতেই যেন বেরিয়ে আসে। সংলাপ প্রক্ষেপণ কত সুদূরপ্রসারী হতে পারে, তা প্রমাণিত ওই জবানিতে। বড় মাপের অভিনেতা না হলে সংলাপ ‘কিংবদন্তি’র স্তরে পৌঁছতে পারে না। তিনি এ জিনিস অনায়াসেই করতে পেরেছেন। মনে হয়, সত্যজিৎ জটায়ুকে তৈরি করেছেন বটে, কিন্তু জটায়ুর কপিরাইট যেন সন্তোষ দত্তর কাছে!
‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতেও সন্তোষ দত্তর অভিনয় অবিশ্বাস্য! এ নিয়ে তাঁর শতবর্ষে আরও কথা হওয়া প্রয়োজন বলে মনে হয়। তিনিই হাল্লার রাজার চরিত্রে– শয়তান, কুচক্রী, লোভী, যুদ্ধের জন্য ফুঁসছেন! যাঁকে সাধারণ মানুষ ভয় করে, সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে। আর উল্টোদিকে তিনিই শুণ্ডির রাজার চরিত্রে– যিনি সদাখুশি, ঠান্ডা, শান্ত, দিলদার– কথা বললে যেন হাওয়া খেলে যায়। যাঁকে নিয়ে সাধারণ লোকের ভয়ভীতি নেই। এই দুটো চরিত্রই একই ছবিতে করেছেন একজনই– তিনি সন্তোষ দত্ত। ফলে তিনি শুধু কমেডিয়ান নয়, সিরিও কমেডিয়ান। প্রবল রাজনৈতিক শ্লেষ লুকিয়ে অভিনয়ের পরতে পরতে। তিনি রাজা নন, সত্যিই মহারাজা, তাঁকে সেলাম।
অথচ জানি না, ‘কমেডিয়ান’ নামের এই কাঁটার মুকুট অভিনেতাদের মাথা থেকে কবে সরবে? বিয়েবাড়ি থেকে বাজার, ‘একটু হাসান না!’– এই আবদার কবে ঘুচবে? বাংলা সিনেমার প্রযোজক-পরিচালকরা ভয় পান অন্যরকমের চরিত্র দিতে, বলা হয় ‘দর্শক চায়।’ দর্শক আসলে সবই চায়, তাদের দেওয়া হয় না। দর্শক না পেলে কী করে বুঝবে, সে আর কী কী চায়? ‘চারমূর্তি’ ছবির এই দৃশ্যটা মনে করুন। যখন টেনিদা, হাবুল, প্যালা, ক্যাবলাকে অসমের জঙ্গলে শিকারের গল্প শোনাচ্ছেন সন্তোষ দত্ত, তখন তিনি ধুতি আর সাদা ঘরে পরার গেঞ্জি পরে। ধীরে ধীরে তাঁর বলার দক্ষতায় হাফপ্যান্ট-হাফশার্ট-টুপি আর বন্দুক কাঁধে নেওয়া সন্তোষ দত্তকে দেখতে পাই। দেখতে পাই জঙ্গলে ঝোপ দিয়ে হেঁটে চলেছেন অসমসাহসী সন্তোষ দত্ত। এই দৃশ্যটি একার্থে সাদামাটা। কী আর এমন ছিল? একজন মাঝবয়সি ভদ্রলোক ছেলেছোকরাদের পেয়ে গল্প শোনাচ্ছেন। কিন্তু সেই গল্প বলার এমনই দক্ষতা, এমনই অভিনয় যে দর্শক বুঁদ হয়ে থাকে। দৃশ্যকে জ্যান্ত দেখতে পাওয়া যায়।
বাঙালির দুর্ভাগ্য, সন্তোষ দত্ত-ও এই বৃত্তে আটকে গেলেন। মূল চরিত্র হিসেবে রবি ঘোষ যেমন পেয়েছিলেন ‘গল্প হলেও সত্যি’, তুলসী চক্রবর্তী পেলেন ‘পরশপাথর’, কী পেলেন সন্তোষ দত্ত? কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসেবে একমাত্র ‘গোপাল ভাঁড়’? তাঁর বাড়াবাড়িহীন, স্তব্ধ করে দেওয়া অভিনয়ের ঝুলি কি ভরে উঠেছিল? নাকি ফাঁকা থেকে গেল অনেকটাই? জন্মশতবর্ষে তাঁকে যেন কাল্টিভেট করা জারি থাকে।