‘নববর্ষের বৈঠক’-এর বরাবরই হাল ধরতেন পঙ্কজদা, তবে আমারও সৌভাগ্য হয়েছে একবার সে ভূমিকা পালন করার। দেবাশিস সেনগুপ্তর প্রযোজনায় সেই নববর্ষের বৈঠকে অনেক নামী, গুণী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ছিলেন শ্রদ্ধেয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর উপস্থিতি ও আবৃত্তি সেদিনের সকালকে এক অন্য মাত্রায় উন্নীত করেছিল। বৈঠকে সৌমিত্রদার সেটাই প্রথম ও শেষবার আসা।
১৫.
ডিসেম্বর মাসের ঠান্ডায় আমরা গেলাম বিষ্ণুপুর শুটিং করতে। তখন সেখানে বিষ্ণুপুর মেলা বা বিষ্ণুপুর উৎসবের প্রস্তুতি চলছে। উৎসব অঙ্গনে প্রবেশ পথের তোরণটিতে চাটাইয়ের নিপুণ কাজ উৎপল চক্রবর্তী ও তাঁর শিল্পীদের করা। উৎপলদাই আমাদের তথ্যচিত্রের গল্প-বলিয়ে, অর্থাৎ ক্যামেরার সামনে আসবেন উনিই। শ্যাম-রাই মন্দির, জোড়বাংলা, দলমাদল কামান, মদনমোহন মন্দির ইত্যাদি বিভিন্ন জায়গায় দাঁড়িয়ে, বসে, চলতে চলতে তিনি বলবেন, প্রত্যেকটির বিষয়ে প্রচলিত গল্প, এটাই ছিল আমাদের তথ্যচিত্রের প্যাটার্ন।
এই শুটিং শুরু করবার আগে বিষ্ণুপুর উৎসব কভার করার জন্য আমাকে আসতে হল ক্যামেরার সামনে। কথায় বলে না যে, ‘ঢেঁকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে’, আমার দশা তাই! ভাগ্যিস সঙ্গে সামান্য কিছু সাজের সরঞ্জাম ছিল, কিন্তু হল কী, সকাল থেকে আমার গলা দিয়ে কোনও আওয়াজ বেরোচ্ছিল না, মেলার মাঠে ধুলো লেগে এই অবস্থা, সঞ্চালনা করব কী করে? যেখানে ছিলাম সেটা লোকালয়ের বাইরে, জঙ্গল ঘেরা এবং সেখানে অত্যন্ত অব্যবস্থা, জল গরম করার কোন সরঞ্জাম নেই। হঠাৎ খেয়াল করি, সামনের খোলা জায়গাটায় জঙ্গল থেকে গাছের ডাল, কাঠকুটো যোগাড় করে তা জ্বালিয়ে একটা পাত্রে জল গরম করছে জীবন (জীবন দাস, লাইটিং অ্যাসিস্ট্যান্ট, সুন্দরবনে শুটিংয়েরও ও ছিল আমাদের দলে)। গরম জল গলায় পড়তে ধীরে ধীরে স্বর বের হল। জীবনের জন্য এ-যাত্রা ব্যাপারটা উতরে গেল।
‘ভাসমান পরম্পরা’ ও ‘কিংবদন্তীর বিষ্ণুপুর’ দুটি তথ্যচিত্রের এডিটিং টেবিলে ঘষামাজা করে সামগ্রিক রূপ দেবার দায়িত্ব যার ছিল, তাঁর নাম সুব্রত ঘোষ। ‘কিংবদন্তীর বিষ্ণুপুর’ দূরদর্শন থেকে বিদেশে ডকুমেন্টারি ফেস্টিভ্যালে পাঠানো হয়েছিল এবং সুনাম অর্জন করেছিল। আজ সেই কাজের কোনও অস্তিত্ব নেই, রাখা হয়নি। ‘শিল্পীর সান্নিধ্যে’ নামে এক অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব ছিল সুবিনয় রায়কে নিয়ে, সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন গৌরী ঘোষ, শান্তিনিকেতনে শুটিং হয়েছিল। এরই দ্বিতীয় পর্ব মায়া সেনকে নিয়ে, সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আমি। অনেকটা শুটিং হয়েছিল আউটডোরে প্রকৃতির মাঝখানে, খানিকটা মায়াদির বাড়িতে। তপতী বিশ্বাস ছিল প্রযোজনায়। ভারি আনন্দ করে কাজটা হয়েছিল।
মধুশ্রীদি (মধুশ্রী মৈত্র) আমার তৈরি স্ক্রিপ্ট বা সংকলন নিয়ে অনেক গানের অনুষ্ঠান করতেন, রবীন্দ্রনাথের গান। সঞ্চালনার কাজটা আমারই থাকত অবশ্যই। পথের গান ‘পথ ও পথিক’, রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিপত্র নিয়ে ‘লিখন তোমার’, শরতের গান নিয়ে ‘সেই তো তোমার পথের বঁধু’ এমন অনেক সংকলিত অনুষ্ঠান। যোগ দিতেন প্রবীণ-নবীন বহু শিল্পী। শিল্পী নির্বাচনেও আমার স্বাধীনতা থাকত।
একটি অনুষ্ঠানের কথা একটু বিশদে বলি। ‘নিভৃতবাসিনী বীণাপাণি’। রবীন্দ্রনাথের যেসব লেখায়, গানে রয়েছে বীণাপানি বন্দনা, তাকেই আমরা বিষয় করে তুললাম। এর জন্য আমি আর মধুশ্রীদি জোড়াসাঁকো বাড়ির লাইব্রেরিতে পুরনো পত্রপত্রিকা, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পাদিত ‘ভারতী’র পাতা থেকে ফটোকপি করে নানাবিধ তথ্যে সমৃদ্ধ করেছিলাম সে অনুষ্ঠান। দেবাশিস রায়চৌধুরী, প্রবুদ্ধ রাহা, রচয়িতা রায় গান গেয়েছিল আর কথায়, পাঠে আমি ছিলাম।
ছোটদের জন্য যখন ‘ছুটি ছুটি’ শুরু হল তখন আরেক মজা। ছোটদের জন্য গল্প বলতে আমার বেশ লাগে। শিশুমহলের ইন্দিরাদি আর গল্পদাদুর আসরের জয়ন্ত চৌধুরীর কাছ থেকে গল্প শোনার কথা মনে পড়ে যায়। ক’দিনের রেকর্ডিং আমরা একসঙ্গে করে নিতাম, পোশাক বদলে বদলে ক্যামেরার সামনে বসতাম। ‘ছুটি ছুটি’ অনুষ্ঠান খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।
……………………………………………
মধুশ্রীদি (মধুশ্রী মৈত্র) আমার তৈরি স্ক্রিপ্ট বা সংকলন নিয়ে অনেক গানের অনুষ্ঠান করতেন, রবীন্দ্রনাথের গান। সঞ্চালনার কাজটা আমারই থাকত অবশ্যই। পথের গান ‘পথ ও পথিক’, রবীন্দ্রনাথের লেখা চিঠিপত্র নিয়ে ‘লিখন তোমার’, শরতের গান নিয়ে ‘সেই তো তোমার পথের বঁধু’ এমন অনেক সংকলিত অনুষ্ঠান। যোগ দিতেন প্রবীণ-নবীন বহু শিল্পী। শিল্পী নির্বাচনেও আমার স্বাধীনতা থাকত।
……………………………………………
আর এক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘নববর্ষের বৈঠক’-এর উল্লেখ আগেও করেছি, তবে নতুন বাড়িতে আসার পর আরও নতুনত্ব শুরু হল। একবার রয়্যাল ক্যালকাটা গল্ফ ক্লাবের মাঠে হল, মনে আছে, তাতে ক্রেন শট ব্যবহার করা হয়েছিল। কখনও মেট্রো রেলে, কখনও ট্রেনেও বসেছে বৈঠক, যেবার ট্রেনে হল সেবার সলিল চৌধুরী গেয়েছিলেন, ‘এই রোকো, পৃথিবীর গাড়িটা থামাও…’। বরাবরই বৈঠকের হাল ধরতেন পঙ্কজদা, তবে আমারও সৌভাগ্য হয়েছে একবার সে ভূমিকা পালন করার। দেবাশিস সেনগুপ্তর প্রযোজনায় সেই নববর্ষের বৈঠকে অনেক নামী, গুণী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ছিলেন শ্রদ্ধেয় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। তাঁর উপস্থিতি ও আবৃত্তি সেদিনের সকালকে এক অন্য মাত্রায় উন্নীত করেছিল। বৈঠকে সৌমিত্রদার সেটাই প্রথম ও শেষবার আসা।
স্পেশাল ইভেন্টগুলো খুব উপভোগ করতাম, যেমন, নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে সেকেন্ড চ্যানেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, দিনটি ছিল ১৯ নভেম্বর, ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিন। সেবারের অনুষ্ঠানে কলকাতার বহু নামী শিল্পী যেমন ছিলেন, তেমন ছিলেন বম্বের অনেক নামজাদা সঙ্গীতশিল্পী।
তখন আমাদের একটি নয়, দু’টি চ্যানেল। Studio B অর্থাৎ ছোট স্টুডিও থেকে প্রথম চ্যানেলের টেলিকাস্ট চলত আগের মতোই আর দ্বিতীয় চ্যানেলের টেলিকাস্ট হত Studio A অর্থাৎ, বড় স্টুডিও থেকে। কখনও কখনও এমন হয়েছে, এক স্টুডিও থেকে ঘোষণা করে ছুটে গেছি অন্য স্টুডিওতে ঘোষণার জন্য, হয়তো সেদিন অন্য স্টুডিও-র announcer on duty কোনও কারণে আসতে পারেনি। সবরকম পরিস্থিতির জন্য সব সময় প্রস্তুত থাকতে হত আমাদের।
আগেও লিখেছি, ৯ অগাস্ট কলকাতা দূরদর্শনের জন্মদিন উপলক্ষে প্রতি বছরই বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান হত, তেমনই একবার আমরা ফিরে গেলাম আমাদের পুরোনো বাড়ি রাধা স্টুডিও-তে, আমরা মানে শাশ্বতী আর আমি এবং প্রযোজক কল্যাণ ঘোষ ও তাঁর টিম। কল্যাণের নির্দেশ মতো আমরা দু’জন ক্যামেরা রোল হলে কথা বলতে বলতে হাঁটতে শুরু করলাম কাঠচাঁপা গাছ পেরিয়ে স্টুডিও-র দিকে, সে কথার মধ্যে ছিল ওই অনুষ্ঠানে যা যা ঘটবে, সে-বিষয়ে তথ্য আর তার সঙ্গে ছিল রোমন্থন। সম্ভবত অনুষ্ঠানটির নাম ছিল ‘স্মৃতির সরণী বেয়ে’।
বড্ড নস্টালজিক সে সব মুহূর্ত।
……………………………. পড়ুন কেয়ার অফ দূরদর্শন-এর অন্যান্য পর্ব ……………………………
পর্ব ১৪: দূরদর্শনের জন্য প্রথম তথ্যচিত্র করা আসলে ছিল অ্যাডভেঞ্চার!
পর্ব ১৩: সেন্ট পল ক্যাথিড্রালকে ব্যাকগ্রাউন্ডে রেখে সারা দুপুর সাপ্তাহিকীর শুটিং হয়েছিল!
পর্ব ১২: দূরদর্শন ভবনের উদ্বোধনের দিন প্রধানমন্ত্রী স্মিত হাসি নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন দুই উপস্থাপকের দিকে
পর্ব ১১: প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আততায়ীর হাতে নিহত, গোলযোগের আশঙ্কায় দূরদর্শনের বাইরের গেটে ঝুলছিল তালা!
পর্ব ১০: সাদা-কালো থেকে রঙিন হয়ে উঠল দূরদর্শন
পর্ব ৯: ফুলে ঢাকা উত্তমকুমারের শবযাত্রার বিরাট মিছিল আসছে, দেখেছিলাম রাধা স্টুডিওর ওপর থেকে
পর্ব ৮: যেদিন বীণা দাশগুপ্তার বাড়ি শুট করতে যাওয়ার কথা, সেদিনই সকালে ওঁর মৃত্যুর খবর পেলাম
পর্ব ৭: ফতুয়া ছেড়ে জামা পরতে হয়েছিল বলে খানিক বিরক্ত হয়েছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস
পর্ব ৬: ভারিক্কিভাব আনার জন্য অনন্ত দাস গোঁফ এঁকেছিলেন অল্পবয়সি দেবাশিস রায়চৌধুরীর মুখে
পর্ব ৫: দূরদর্শনে মান্য চলিত ভাষার প্রবর্তক আমরাই
পর্ব ৪: রবিশঙ্করের করা দূরদর্শনের সেই সিগনেচার টিউন আজও স্বপ্নের মধ্যে ভেসে আসে
পর্ব ৩: অডিশনের দিনই শাঁওলী মিত্রের সাক্ষাৎকার নিতে হয়েছিল শাশ্বতীকে!
পর্ব ২: স্টুডিওর প্রবল আলোয় বর্ষার গান গেয়ে অন্ধকার নামিয়ে ছিলেন নীলিমা সেন
পর্ব ১: খবর পেলাম, কলকাতায় টেলিভিশন আসছে রাধা ফিল্ম স্টুডিওতে
স্বাধীন দেশে যেন ফিরে এসেছে একদা উপনিবেশ সংস্কৃতি। এ দেশের যাবতীয় প্রাকৃতিক ও ভূসম্পদ ব্যবহার করে বিদেশে রফতানি করে শোষণের যে নীতি গ্রহণ করেছিল ঔপনিবেশিক শক্তি, স্বাধীন দেশে স্বাধীন জনসমাজের চোখের সামনে তার প্রাকৃতিক সম্পদকে একইভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। লক্ষ্য অবশ্যই উন্নয়ন। ভারতের উন্নয়ন।